ঘুরপাকে ইউরোপীয় রাজনীতি by সরাফ আহমেদ

ইউরোপীয় রাজনীতি কিছুদিন থেকেই একটা ঘুরপাকের মধ্যে পড়েছে, ইউরোপীয় ঐক্যের প্রবক্তারা দীর্ঘদিন থেকেই চেষ্টা চালিয়ে আসছেন বিশ্ব ভূ-রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছড়া না বেঁধে একটি নিজস্ব রাজনৈতিক বলয় গড়ে তুলতে। কিন্তু নিজেদের কিছু দুর্বলতা, অর্থনৈতিক ও কিছু অনৈতিক স্বার্থ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মারপ্যাঁচে বারবারই সেই উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে।
এক.
ইউক্রেনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে সৃষ্ট সংকটে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ, শেষে অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র ক্রিমিয়া উপদ্বীপ হাতছাড়াসহ দেশটির উত্তরের কিছু অংশ রুশ বংশোদ্ভূত বিদ্রোহীদের হাতে চলে যাওয়া আর পরে ইউরোপপন্থীরা ক্ষমতায় এলেও দেশটিতে এখনো যুদ্ধ-সংকট কাটেনি। ইউরোপের ভুল রাজনীতির কারণে রাশিয়া তাদের আঞ্চলিক রাজনীতিতে আপাতবিজয়ী বলেই মনে করছে। ইউক্রেন রাজনীতিতে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের দোহাই দিয়ে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়ার সঙ্গে নানা বিনিময় বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও রাশিয়া তা আমলে নেয়নি। হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড, বুলগেরিয়া, স্লোভাকিয়া, গ্রিস, জার্মানির মতো দেশগুলো রাশিয়ান গ্যাসের প্রতি ভালো রকমের নির্ভরশীল রয়েছে, আর তা রাশিয়ার রাজনীতিকেরা ভালো করেই জানেন। পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়া গ্যাস রাজনীতি শুরু করলে ইউরোপের বহু দেশেই প্রচণ্ড ঠান্ডায় গ্যাসচালিত হিটার বেশি দিন চলবে না।
দুই.
গত জুলাই মাসে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যখন ফিলিস্তিনের গাজার পশ্চিম তীরে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ও জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনূদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় আকাশ থেকে বেপরোয়া বোমা নিক্ষেপ করে ধ্বংস আর ঘরে ঘরে প্রবেশ করে দুই হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করল, তখন ইউরোপীয় রাজনীতি অস্বস্তিতে ছিল বটে৷ তবে কোনো জোরালো সমালোচনা, প্রস্তাব গ্রহণ বা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হলো না। ৮ জুলাই থেকে গাজা উপত্যকায় এই আক্রমণ শুরু হলেও ২২ জুলায় জার্মানি, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যৌথ উদ্যোগে জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবসহ গাজায় জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব আর আলোর মুখ দেখেনি আর বলার অপেক্ষা রাখে না—ইসরায়েলের জন্মলগ্ন থেকে গত ৬১ বছরে জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব গৃহীত হলেও তা থোড়াই তারা আমলে নিয়েছে।
অথচ গত ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া বক্তব্যে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তাঁর দেশের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি এই আক্রমণকে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করলে, যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে তা প্রতিবাদ করে একে অপমানজনক বক্তব্য বলে সমালোচনা করে। আর এখন যুদ্ধের প্রায় তিন মাস পর এই ১২ অক্টোবর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান ক্যাথি অ্যাশটন ঘোষণা দিয়েছেন, যুদ্ধ-উপদ্রুত গাজায় পুনর্নির্মাণ খাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৪৫০ মিলিয়ন ইউরো সাহায্য দেবে। যে যুদ্ধে দুই হাজার ১০০ লোকের প্রাণহানি হলো, অসংখ্য মানুষ হতাহত হলো আর ১৮ হাজার বসতি ধ্বংস হলো, সেই যুদ্ধ আক্রমণের কারণ নিয়ে কোনো আলোচনা বা জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত ফিলিস্তিনি এলাকায় বসতি নির্মাণ বন্ধ হলো না, তা নিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞাও জারি হলো না, কিন্তু পুনর্নির্মাণ খাতে আর্থিক সাহায্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানবিকতা কেনার চেষ্টা করছে।
তবে সময় পাল্টাচ্ছে, জুলাই মাসে গাজায় যুদ্ধের সময় ইউরোপজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে। ইউরোপের সংবাদপত্রগুলোয় ইসরায়েলের কড়া সমালোচনা হয়েছে। সম্প্রতি সুইডেন সরকার ইসরায়েলের পাশে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে আর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের সদস্যরাও ১৩ অক্টোবর ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন, স্কটল্যান্ডও সত্বর স্বীকৃতির ঘোষণা দেবে বলে শোনা যাচ্ছে।
তিন.
মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া, ইরাকসহ লিবিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রতিপত্তি যত বাড়ছে, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনাও বাড়ছে, আর পশ্চিমাদেরও বিরাট মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে ইসলামিক স্টেটের কার্যকলাপ। দুই দশক আগে ছিল তালেবানরা, তা শুধু আফগানিস্তান আর পরে পাকিস্তানে৷ পরে হলো আল-কায়েদা, তারা দেশজুড়ে দখল না নিয়ে বিশ্বজুড়ে নানা জায়গায় সন্ত্রাসী হামলা করেছে আর এখনকার ইসলামিক স্টেটের গেরিলারা বাগদাদ দখল করতে উদ্যত হচ্ছে, তারা ইরাক ও সিরিয়ার বহু এলাকা দখল করে নিজ নিজ দেশের মানুষকে হত্যা-জুলুম, নারীদের প্রতি অত্যাচার, ইসলামের নানা পবিত্র স্থান ধ্বংসসহ চারজন পশ্চিমা সাধারণ মানুষকে গলা কেটে হত্যা করেছে। আর এই স্বঘোষিত ইসলামিক স্টেটের জিহাদে যোগ দিতে ইউরোপের নানা দেশ থেকে তিন হাজার তরুণ ইরাক বা সিরিয়ায় চলে গেছেন, জিহাদি রোমান্টিকতা বা অতি উৎসাহে কিছু তরুণীও সিরিয়ায় গিয়েছেন।
লন্ডনের মেয়র বরিস জনসন ১০ অক্টোবর দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যুক্তরাজ্য থেকে পাঁচ থেকে ছয় শ যুবক আল-কায়েদ বা ইসলামিক স্টেটের জিহাদি যুদ্ধে যোগ দিতে ইতিমধ্যেই সিরিয়া বা ইরাকে গিয়েছেন আর তাঁদের অর্ধেকের বসবাস লন্ডনে। তিনি আরও বলেছেন, এসব যুবক ফিরে এলে তাঁদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়াটি বেশ কঠিন হবে। জার্মানিতেও সালাফিস্ট নামের ইসলামিক আন্দোলন ইদানীং বেশ পরিচিতি পেয়েছে, জার্মানিতে তাঁদের প্রায় পাঁচ হাজার অনুসারী রয়েছেন, যাঁদের ইসলামিক স্টেটের জিহাদি আন্দোলনের সমর্থক বলে মনে করা হয়, এই জাতীয় আন্দোলন যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে বেশ আগে থেকেই জেঁকে বসেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স থেকেও ইসলামিক স্টেটের জিহাদি আন্দোলনে যোগ দিতে বহু যুবক ইরাক, সিরিয়া বা তুরস্কে গিয়েছেন, সেখান থেকে নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইউরোপে অন্য সাথিদেরও তঁাদের সঙ্গে শামিল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
ইদানীং একটা নতুন বিতর্ক ইউরোপে দানা বেঁধেছে, আর তা হলো ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি বা সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ আদতে অগণতান্ত্রিক বা স্বৈরশাসক হলেও তা পশ্চিমাদের জন্য বোধ হয় নিরাপদ ছিল। একসময় সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি বা বাশারকে সরাতে যাদের অর্থকড়ি আর অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল, তারাই আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের চক্ষুশূল।
সেই স্বৈরশাসকদের আমলে নিদেনপক্ষে দেশগুলোয় এতটা হানাহানি আর রক্তক্ষয় ঘটেনি, যা এখন ঘটছে। একটি দেশে বোমাবর্ষণ নানা ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়ে স্বৈরশাসককে অপসারণ করলে আর সেখানে কিছু পুনর্বাসন কর্মসূচি দিয়ে সেখানে গণতন্ত্র ফিরে আসবে—এই পশ্চিমা নীতি অসাড় বলে প্রমাণিত হয়েছে। পশ্চিমারা দেশগুলোয় গণতন্ত্রায়ণের চেষ্টা না করে যুদ্ধ আর বলপ্রয়োগের চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল আর তার ফলে ইসলামিক স্টেটের জিহাদি অভিযান দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
কানাডায় জন্ম নেওয়া অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মিশাইল চোসুডভস্কি আগামী ডিসেম্বরে তাঁর প্রকাশিতব্য যুদ্ধের বিশ্বায়ন, মানবতার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ যুদ্ধ শিরোনামের বইয়ে লিখেছেন, নিজ দেশের সীমানা রক্ষা সব দেশেরই দায়িত্ব, কিন্তু নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে পৃথিবীর নানা স্থানে যুদ্ধাবস্থা পরিবেশ তৈরি ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ বিশ্ব মানবিকতার পরিপন্থী। একই কথা বলছে ইউরোপের বুদ্ধিজীবী মহল।
বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনৈতিক স্বার্থ অভিন্ন না হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ও পরবর্তী সময়ে পশ্চিম ইউরোপের পুঁজিবাদী দর্শনের অভিন্ন অনুসারীরা চাইলেও নানা কৌশলগত কারণে, বিশ্বজুড়ে আমেরিকার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার ফাঁদ থেকে বের হতে পারছে না। তবে ইউরোপজুড়ে এই ঘুরপাক খাওয়া রাজনীতি বা মানবিকতার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ খেলা ও হত্যাযজ্ঞে সমর্থন বা অংশগ্রহণের বিরুদ্ধ-নিন্দা ও লেখালেখি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।
Sharaf.ahmed@gmx.net

No comments

Powered by Blogger.