মেরি অ্যান্ডারসন- আগুনে পুড়ল শত বছরের ঐতিহ্য by আসিফ হোসেন

আগুন মুহূর্তে সবকিছু পুড়িয়ে দেয়। বাছবিচার করে না কিছুই। গত বুধবার রাতেও তার তেজে যেমন পুড়ল ভাসমান রেস্তোরাঁ মেরি অ্যান্ডারসন। একটি কাঠামোই পুড়ল না, পুড়ল শত বছরের ঐতিহ্য। ব্রিটিশ আমলে ১৯১৮ সালে নির্মিত মেরি অ্যান্ডারসন নামের জাহাজটি নারায়ণগঞ্জের পাগলায় বিআইডব্লিউটিএর ভিআইপি জেটিতে নোঙর করা ছিল। এটি ছিল বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন। বুধবার রাত ১১টার দিকে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে জাহাজটি পুড়ে যায়। আগুনে দ্বিতলবিশিষ্ট জাহাজটির স্টিলের ছাদ ধসে পড়ে। ডেকের নিরাপত্তাবেষ্টনী গলে ভেতরে থাকা আসবাবসহ বিভিন্ন মালামাল ভস্মীভূত হয়। এর পাশেই অবস্থানরত পর্যটন করপোরেশনের এমভি শালুক নামের অপর একটি প্রমোদতরি ও তিনটি স্পিডবোটও পুড়ে যায়। মেরি অ্যান্ডারসন ভাসমান রেস্তোরাঁ অ্যান্ড বারের দায়িত্বে থাকা পর্যটন করপোরেশনের ইউনিট ম্যানেজার মো. নজরুল ইসলাম জানান, তৎকালীন লর্ড ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা নদীতে প্রমোদভ্রমণ করতেন মেরি অ্যান্ডারসনে চড়ে। পাকিস্তান আমলে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) সফরে এলে এই জাহাজে চড়েই নৌভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালের আগ পর্যন্ত জাহাজটি বিআইডব্লিউটিএর অধীনে ছিল। তারপর এর দায়িত্ব দেওয়া হয় পর্যটন করপোরেশনকে। তখন থেকে দেশের একমাত্র ভাসমান রেস্তোরাঁ অ্যান্ড বার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল মেরি এন্ডারসন। ২০০৪ সাল পর্যন্ত করপোরেশন এটি সরাসরি পরিচালনা শুরু করে। ২০০৫ সালের পর হক ট্রেডার্স নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বার্ষিক ২৩ লাখ টাকা ফিতে ১৫ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয় জাহাজটি। নজরুল ইসলাম জানান, ২০০ ফুট লম্বা ও ৬০ ফুট প্রস্থের মেরি এন্ডারসনে একসময় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটক আসতেন। এখানে নানা স্বাদের খাবার পাওয়া যেত। কিন্তু আগুনে সবকিছু পুড়ে গেল। তিনি বলেন, আগুনে অন্তত ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখন এটি মেরামত করতে পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকা খরচ হবে।
নজরুল ইসলাম আরও বলেন, মেরি এন্ডারসনে কোনো ইঞ্জিন না থাকায় অন্য নৌযানের সাহায্যে এটিকে টেনে নিতে হয়। তবে পাগলায় ভিআইপি জেটিতে এটি সব সময় নোঙর করা থাকত। আগে অনেক পযর্টক এলেও দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় বিদেশি পর্যটক কমে গেছে। তবে প্রতিদিনের বেড়ানোর স্থান হিসেবে মেরি এন্ডারসনের সঙ্গ বেছে নিতেন নারায়ণগঞ্জবাসীর অনেকেই। তাই আগুনের খবর পেয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন ছুটে এসে জাহাজটির অগ্নিদগ্ধ অবস্থা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। প্রায় শত বছরের পুরোনো জাহাজটি পুড়ে যাওয়ায় এটি অবিলম্বে মেরামতের দাবি জানান তাঁরা। ফতুল্লার আলীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা মো. জুয়েল বলেন, মেরি এন্ডারসনের আগুনে তাঁর মনও পুড়ে গেছে। কারণ তিনি প্রতিদিনই ভ্রমণের জন্য এখানে আসেন। আগুন লাগার সময় তিনি জাহাজ থেকে ১৫-২০ গজ দূরে ছিলেন। আগুন দেখেই ছুটে আসেন। তিনি বলেন, এ সময় জাহাজ থেকে কর্মীদের বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেন তিনি। আগুন লাগার বিষয়টি নাশকতা বলে দাবি তাঁর। রেস্তোরাঁটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা হক ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক মো. সালাউদ্দিনও একই কথা বললেন। তাঁর অভিযোগ, কেউ আগুন না লাগালে জাহাজটি এভাবে পুড়ত না।

তদন্ত কমিটি গঠন
গতকাল দুপুরে মেরি এন্ডারসন পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান অপরূপ চৌধুরী জানান, ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান জানান, মেরি এন্ডারসনে আগুন লাগার ঘটনায় পৃথক দুটি জিডি করা হয়েছে। একটি করেছেন জাহাজটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা হক ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক মো. সালাউদ্দিন। অন্যটি করেন ইউনিট ম্যানেজার নজরুল ইসলাম। দুটি জিডির একটিতেও অগ্নিকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করা হয়নি। পুলিশ অভিযোগ তদন্ত করছে।

No comments

Powered by Blogger.