বাংলাদেশে সহিংসতার ঝুঁকির শঙ্কা রয়ে গেছে -যুক্তরাজ্য

বাংলাদেশে সহিংসতার ঝুঁকির শঙ্কা রয়ে গেছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ- কান্ট্রি কেস স্টাডি আপডেট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। কেস স্টাডিটি ২০১৩ সালের ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটিক রিপোর্ট’-এর অংশবিশেষ। প্রতিবেদনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে নাগরিক সমাজ (সিভিল সোসাইটি) ও মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব করার সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সেভেন মার্ডার প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সহিংসতার ঝুঁকির শঙ্কা রয়ে গেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে বিক্ষোভ-সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সহিংসতা কমে এলেও এনজিওগুলো নির্বাচনের পর থেকে বিচার-বহির্ভূত হত্যা এবং গুম ব্যাপকভাবে বাড়ার কথা জানিয়েছে। ২০১৪ সালে গৃহীত নতুন নীতি ও আইন নাগরিক সমাজের ব্যাপ্তি ও মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব হওয়া নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হলে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না মনে করে বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ওই নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হওয়ার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ উপর্যুপরি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য জয়ী হয়। ওই নির্বাচনের দিন ২১ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক স্কুলভিত্তিক নির্বাচনী কেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হয়। নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে, ২০১৩ সালের চেয়ে অনেক কমসংখ্যক হরতাল ও অবরোধ হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ জানুয়ারি ওই সময়ের মানবাধিকারবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারোনেস ওয়ার্সি রাজনৈতিক জবাবদিহিতা সমাধানে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি সব দলের ভীতি প্রদর্শনমূলক কর্মকা- এবং অবৈধ সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা জোরদার এবং কোনো ধরনের ভীতি প্রদর্শন বা প্রতিহিংসার আশঙ্কা ছাড়াই ভবিষ্যতের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের আগ্রহ ও সক্ষমতা সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার বাংলাদেশের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্চে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে সব প্রধান দল প্রার্থী দেয়। প্রথম দুই দফা নির্বাচনে বিএনপির চেয়ে পিছিয়ে পড়ার পর শেষ তিন দফায় আওয়ামী লীগ অধিকাংশ আসনে জয়ী হয়। এনজিও ও মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী এটা ঘটেছিল ভীতি প্রদর্শন ও নির্বাচনীপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে।
ব্যারোনেস ওয়ার্সি বিষয়টি নিয়ে ১৩ মে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারের সাথে আলোচনা করেছিলেন। তিনি এসব খবরের পূর্ণ ও স্বচ্ছ তদন্ত করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মার্চে ওই সময়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের প্রতিমন্ত্রী অ্যালেন ডানকান বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার সাথে বৈঠক করে আরো টেকসই রাজনৈতিক সমঝোতার প্রাথমিক প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে, গণতন্ত্রে সহিংসতার কোনো স্থান নেই।
এতে বলা হয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৩ সালের রিপোর্টে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দায়মুক্তি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। এনজিওগুলো জানিয়েছে, ২০১৪ সালের প্রথম ছয় মাসে বিচার-বহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দৃশ্যত আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীগুলোর হাতে ক্রসফায়ারে বিপুলসংখ্যক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
এতে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জে প্রকাশ্য দিবালোকে সাতজনকে অপহরণ এবং পরে তাদের লাশ নদীতে পাওয়া যাওয়ার ঘটনায় দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এই হত্যার সাথে র‌্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগের পর বাংলাদেশের সংসদ, হাইকোর্ট ও নাগরিক সমাজ বিষয়টির তদন্তের আহ্বান জানায়। সরকার প্রতিশ্রুতি দেয়, অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হবে। এই মৃত্যুতে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়েছে তিন র‌্যাব সদস্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ দাখিল করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার নতুন আইন প্রণয়ন কিংবা বিদ্যমান আইনগুলোতে সংশোধন আনায় নাগরিক সমাজের ব্যাপ্তির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ডিজিটাল মিডিয়ার আশ্রয় নিয়ে যারা সরকারের সমালোচনা করছে, তাদের তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে আটক করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রস্তাবিত ‘ফরেন ডোনেশনস অ্যাক্ট’টি নাগরিক সমাজের কার্যক্রম সীমিত করে দিতে পারে।
আরো দুটি ঘটনা নাগরিক সমাজের মধ্যে এই ধারণা জোরদার করেছে যে, বাংলাদেশ সরকার সমালোচনা ও ভিন্নমত প্রকাশের সম্ভাব্য চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। সদ্য প্রণীত জাতীয় সম্প্রচার নীতি মিডিয়া স্বাধীনতার ওপর রাশ টেনে ধরবে বলে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দুটি টিভি চ্যানেল এবং একটি সংবাদপত্র পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নাগরিক সমাজের অনেক সংগঠন ক্রমবর্ধমান নজরদারি, হয়রানি ও ভীতিপ্রদর্শনের কথা বলেছে। আরো সম্প্রতি সরকারের নতুন সংবিধান সংশোধনের ফলে সংসদীয় কর্তৃপক্ষ বিচার বিভাগের সদস্যদের অভিসংশন করার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ জুলাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেন। ক্যামেরন নির্বাচন নিয়ে তার উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেন। উভয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং মিডিয়ার স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানায় এমন উন্মুক্ত সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপে একমত হন।

No comments

Powered by Blogger.