প্যাট্রিক মোদিয়ানো by আহমদ মতিউর রহমান

জাপানের হারুকি মুরাকামি, সিরিয়ার এডোনিস ওরফে আলি আহমদ সাঈদ, কেনিয়ার নগুই ওয়া থিয়োঙ্গো, বেলারুশের সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ এবং আলবেনিয়ার ইসমাইল কাদারের মতো নামকরা লেখকদের পেছনে ফেলে এ বছর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার জিতে নিয়েছেন ফ্রান্সের প্যাট্রিক মোদিয়ানো। হ্যাঁ, ১০ জনের তালিকায় মোদিয়ানোর নাম ছিল; কিন্তু পুরস্কার ঘোষণার এক দিন আগেও তাতে জ্বলজ্বল করছিল মুরাকামির নাম। জল্পনা-কল্পনায় এগিয়ে ছিলেন তিনি। ছিলেন দীর্ঘ দিন ধরে তালিকায় আসা এডোনিস, ইসমাইল কাদারে, নগুই আর সভেতলানা; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিচের দিকে থাকা মোদিয়ানোর ভাগে শিকে ছিঁড়ল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার দখলকার নাৎসি বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন ও ফরাসিদের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার চিত্র তার সাহিত্যে নিপুণভাবে তুলে ধরার জন্য নোবেল কর্তৃপক্ষ তাকে এ পুরস্কারে ভূষিত করেছেন।

২.
তার পুরো নাম জ্যাঁ প্যাট্রিক মোদিয়ানো। জন্ম ১৯৪৫ সালের ৩০ জুলাই, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের পশ্চিম প্রান্তের উপশহর বলোনেতে। সময়টা তখন খুবই উত্তাল। মাত্র দুই মাস আগে শেষ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। চার দিকে মৃত্যু ধ্বংস আর হাহাকার। মোদিয়ানোর বাবা আলবার্ট মোদিয়ানো ছিলেন ইতালীয় বংশোদ্ভূত ইহুদি। আর মা লুইজা কলপিন ছিলেন বেলজিয়ামের একজন অভিনেত্রী। নাৎসি দখলদারির সময় প্যারিসে কষ্টে জীবন কাটিয়েছেন তার বাবা-মা। তিনি বড় হয়ে এগুলো জানতে পারেন। তার লেখকজীবনে এই ঘটনা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে। মোদিয়ানোর শৈশব কেটেছে তার নানা নানীর সাথে। সে সময়ে শিখতে হয়েছে বেলজীয় ফেমিশ ভাষা। তার বাবা-মা প্রায়ই কাজের প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। এ কারণে তাকে সরকারি সাহায্য নিয়ে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়েছে। একাকিত্ব মোচনে এ সময়ে তার সাথে ছিল তার ভাই রুডি। সেই ভাইটিও মাত্র ১০ বছর বয়সে এক অসুখে মারা যায়। এই মৃত্যু তাকে খুবই বিচলিত করে তোলে। তার স্মৃতিকথায় একটি বিরাট অংশে রয়েছে এই বিবরণ। মোদিয়ানো ১৯৬৭ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত তার সব লেখা তার মৃত ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি নিবেদন করেন। তার উচ্চমাধ্যমিক ও তৎপরবর্তী শিক্ষাজীবন কেটেছে প্যারিসের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানে। লাইসি চতুর্থ হেনরি হাইস্কুলে পড়ার সময় তার জ্যামিতি শিক্ষক ছিলেন লেখক র‌্যামন্ড কুইনিউ। ফরাসি উচ্চারণ র‌্যামো কুনো। তার সংস্পর্শ মোদিয়ানোর লেখকজীবনকে প্রভাবিত করেছে। যুদ্ধপরবর্তী ডামাডোলে মোদিয়ানো তার শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি। ১৯৭০ সালে মোদিয়ানো বিয়ে করেন দোমিনিক কারুফুসকে। সেই বিয়েও এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। তাদের রয়েছে দু’টি কন্যাÑ জিনা ও মেরি। মোদিয়ানো যতখানি সাহিত্যিক ততখানিই চলচ্চিত্রকর্র্র্মী। তিনি নানাভাবে চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার কয়েকটি উপন্যাসও চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে।
৩.
মোদিয়ানোর লেখকজীবনও শুরু হয় লেখক কুনোর সহযোগিতায়। বলতে গেলে তিনিই মোদিয়ানোকে সাহিত্য ও প্রকাশনা জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। র‌্যামো কুনো আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুলের সমবয়সী কবি ও ঔপন্যাসিক। ফরাসি সাহিত্যে তাঁর অবদান অনেক। বলা যায় কুনো লোক চিনতে ভুল করেননি। তার হাত ধরে মোদিয়ানো আজ খ্যাতির শীর্ষে।
১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় মোদিয়ানোর প্রথম উপন্যাস ‘লা কোস দো লেতোয়াল’। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে একজন ইহুদি কোলাবোরেটরের জীবনকাহিনী। তবে এই উপন্যাসের প্রতি মোদিয়ানোর বাবা রুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি এতটাই রুষ্ট হয়েছিলেন যে, এর সব কপি কেনার চেষ্টা করেছিলেনÑ যাতে এর প্রচার না হয়। মনে হয়, এতে বর্ণিত গল্প ও বর্ণনাভঙ্গি তার মনোপুত হয়নি। ২০১০ সালে এ বইয়ের জার্মান অনুবাদ প্রকাশিত হলে তা ‘সাউথ ওয়েস্ট রেডিও বেস্ট অব দ্য লিস্ট’ পুরস্কার পায়। এর ফলে এটি হয়ে ওঠে হলোকস্ট-পরবর্তী অন্যতম প্রধান উপন্যাস। তবে এখনো এটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি।
১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘লা রঁদে দো মুইট’। এর ইংরেজি অনুবাদ ‘নাইট রাউন্ডস’ প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। এরপর ১৯৭৭ পর্যন্ত নিয়মিত ব্যবধানে প্রকাশিত হয় রিং রোডস, ভিলা ট্রিস্ট, লিভরেট দো ফ্যামিলি। এ ছাড়া চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও লেখেন মোদিয়ানো। পরে তিনি চলচ্চিত্রের সাথে আরো বেশি করে যুক্ত হন, করেন এই শিল্পের নানামাত্রিক কাজ। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় মোদিয়ানোর সেরা উপন্যাস ‘মিসিং পারসন’। ১৯৮০ সালে এটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
মিসিং পারসন একজন স্মৃতিভ্রষ্ট গোয়েন্দার কাহিনী। এই গোয়েন্দা তার শেষ কেস হিসেবে নেয় আত্ম-আবিষ্কারকে। সে খুঁজে ফেরে নিজের জীবনকাহিনীÑ তার মনে প্রশ্ন সে কে? ঘটমান ইতিহাসের পাতায় পাতায় তার পদক্ষেপগুলো কী, আর তা সঠিক না বেঠিক, তার হিসাব মেলানোর চেষ্টা।
মিসিং পারসন উপন্যাসের জন্য মোদিয়ানো ১৯৭৮ সালে মর্যাদাবান প্রিঁ গঁকুর পুরস্কারে ভূষিত হন। এটাই তার প্রথম পুরস্কার অর্জন। এরপর অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। মোদিয়ানোর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছেÑ এ ট্রেস অব ম্যালিস, উনে জেনিস, ক্যাথারিন সার্টিচিউড, হানিমুন, আউট অব দ্য ডার্ক, ডোরা ব্রুডার ইত্যাদি। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছেন মোদিয়ানো। ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত তার বইয়ের সংখ্যা ৪০-এর বেশি। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর বদলে গেছে তার বইয়ের জগৎ। দ্রুত তার লেখা বই প্যারিসের বইয়ের দোকানগুলোতে জায়গা করে নেয়। ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস তার তিনটি উপন্যাসিকার সঙ্কলন ‘সাসপেন্ডেন্ট সেনটেন্সেস’ প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া তার প্রকাশক গোদিন তিনটি বই ক্যাথারিন সার্টিচিউড, হানিমুন ও মিসিং পারসন পুনর্মুদ্রণের আদেশ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী তার বইয়ের প্রতি পাঠকদের আগ্রহ নিবিষ্ট হয়েছে।
৪.
মোদিয়ানো নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পঞ্চদশ ফরাসি লেখক। তাকে বিজয়ী ঘোষণার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি বলেছে, ‘১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত জার্মান দখলদারীর সময় সাধারণ মানুষের জীবনের গল্প নিজের লেখায় নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মোদিয়ানো। স্মৃতির শিল্প দিয়ে তিনি মানুষের ভাগ্যের সেই সব দিক বর্ণনা করেছেন যেগুলো মুঠোয় ধরা সবচেয়ে কঠিন।’
মোদিয়ানোর নিজের জবানিতেও এসেছে একই কথা। তার কথায়Ñ আমার সব বই যেন একই কাহিনীর প্রলম্বিত অংশ। যেন একটি বইই লিখে চলেছি। অর্থাৎ ঘুরেফিরে নাৎসি নির্যাতনবিরোধী বক্তব্য বন্দিজীবনের গুমোট স্মৃতি ভাস্বর হয়ে উঠেছে। ক্রমাগত লিখে গেছেন মোদিয়ানো। এ কারণে ফ্রান্সে তার সাহিত্যের পঠনপাঠন নিতান্ত কম নয়। ফরাসি পাঠকেরা তাকে গ্রহণ করেছেন ভালোভাবেই। নোবেল কমিটির সেক্রেটারি পিটার ইংলান্ড তাকে এ যুগের প্রুস্ত বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। মার্সেল প্রুস্ত ফরাসি সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মোদিয়ানোকে তার সাথে তুলনা করে নোবেল কমিটি তাকে আরো মহিমান্বিত করে তুলেছেনÑ এ কথা বলতেই হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কঠিন সময়ে মোদিয়ানোর শৈশব-কৈশোর স্বাভাবিকভাবে কাটেনি। তাই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারেননি তিনি। নিজ সাহিত্যজীবন সম্পর্কে তার অকপট বর্ণনাÑ ‘আসলে আমি কখনো অন্য কিছু করার কথা ভাবিনি। আমার কোনো ডিপ্লোমা ছিল না, অর্জনের জন্য কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যও ছিল না। তবে তরুণ লেখক হিসেবে শুরু করাটা কঠিন ছিল।
প্রথম জীবনে রচিত অনেক কাঁচা লেখা পরিণত লেখকজীবনে এসে ভালো লাগে না। মোদিয়ানোর জীবনেও এমনটা হয়েছে। তিনি যে সময়ের সাহিত্য সম্পর্কে বলছেনÑ ‘আমি আমার প্রথম দিককার বইগুলো না পড়তেই পছন্দ করি। তার মানে এই নয় যে, আমি এগুলো অপছন্দ করিÑ তবে এগুলোতে আমি নিজেকে খুঁজে পাই না...।’
এ বছর প্রকাশিত হয়েছে ‘সো দ্যাট ইউ ডোন্ট গেট লস্ট ইন দ্য নেইবার হুড’। এটির ইংরেজি অনুবাদও হয়েছে। এটা পারিপার্শ্বিক অবস্থায় দিশা হারিয়ে ফেলার বিষয় নিয়ে লেখা। তিনি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে এই বইটির প্রতি তার দুর্বলতার কথা প্রকাশ করে পাঠককে এটা পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
ফরাসি সাহিত্য বিশ্বব্যাপী আদৃত নানা মাত্রিকতায়। আত্ম-আবিষ্কার, জীবনের সারৎসার আর মনোজগৎকে আবিষ্কারের নানা কাহিনী নিজস্ব ভাষা-ভঙ্গিমায় প্রকাশ করেছেন ফরাসি লেখক ও ঔপন্যাসিকেরা। ফরাসি সাহিত্যের সেই ধারায় যুক্ত হলো আরো একটি নামÑ মোদিয়ানো। এর আগে আরো ১৪ জন নোবেল বিজয়ী ফরাসি লেখক বিশ্বসাহিত্যে তাদের বিজয়গাথা গেয়ে গেছেন। মোদিয়ানোকেও হয়তো তারা গ্রহণ করবেন। শুধু ফ্রান্স কেন, নোবেল অঙ্গনে নেতৃত্বের আসনে আছে ইউরোপ। ২০১২ সালে চীনের মো ইয়ান আর গেল বছর কানাডার এলিস মুনরো এই শিরোপাকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য ঠিকানায়। মোদিয়ানোর হাত ধরে এবার তা আবারো ফিরে এলো ইউরোপে। এশিয়া, আফ্রিকা আর আরব দুনিয়া কি বঞ্চিত হলো এর মধ্য দিয়ে? হবে হয়তো!

No comments

Powered by Blogger.