পা হারানো ছেলেটির যুদ্ধজয় -নিষ্ঠুরতার বিচার চান লিমন ও তাঁর মা

অবশেষে এক পা হারানো ছেলেটি সত্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে জয়ী হলেন। এখন তাঁর চাওয়া, অন্যায়কারীদের বিচার। র‌্যাবের গুলিতে বাঁ পা হারানোর তিন বছর সাত মাস পর র‌্যাবের করা দ্বিতীয় মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন ঝালকাঠির রাজাপুরের লিমন হোসেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সহকারী সরকারি কৌঁসুলি মো. হোসেন আকনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে করা এ মামলা থেকে লিমনকে অব্যাহতির আদেশ দেন ঝালকাঠির মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. আবু শামীম আজাদ। এর আগে লিমন অস্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের চাপের মুখে গত বছরের ৯ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লিমনের বিরুদ্ধে করা দুটি মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক না থাকায় দ্বিতীয় মামলাটি এক বছরের বেশি সময় ঝুলে ছিল। গত ১০ সেপ্টেম্বর ঝালকাঠির মুখ্য বিচারিক হাকিম পদে যোগ দেন আবু শামীম আজাদ। গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে করা মামলার ধার্য তারিখে শুনানি শুরু হলে লিমন কৃত্রিম পায়ে ভর করে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ান। আদালতে উপস্থিত ছিলেন লিমনের মা হেনোয়ারা বেগমও।
শুনানি শেষে বিচারক লিমনকে কাঠগড়া থেকে নেমে আসতে বলেন। লিমন নিচে নেমে দাঁড়ালে বিচারক বলেন, ‘আপনাকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪(ক) ধারায় জিআর ৪৬(ক)/১১ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।’
আদালত থেকে বেরিয়ে লিমন প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘র‌্যাবের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে আজ আমি চিরতরে পঙ্গু। তারা আমাকে সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা করেছে। আমার বিরুদ্ধে দুটি মামলা দিয়েছে। আমি তাদের বিচার চাই।’ একই সঙ্গে সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণও দাবি করেন লিমন। মা হেনোয়ারা বেগম বলেন, ‘র্যাব আমার নির্দোষ ছেলেকে গুলি করে পঙ্গু করেছে। আমি তাদের বিচার চাই।’
লিমনের আইনজীবী মানিক আচার্য্য জানান, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ র‌্যাবের গুলিতে পা হারান ঝালকাঠির রাজাপুরের কলেজছাত্র লিমন হোসেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৬ বছর। এ ঘটনার পর বরিশালে র্যাব-৮-এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) লুৎফর রহমান বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে এবং সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে লিমনসহ আটজনের বিরুদ্ধে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা করেন। রাজাপুর থানার পুলিশ ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল অস্ত্র মামলায় এবং ২০১২ সালের ৮ জুলাই সরকারি কাজে বাধাদানের মামলায় লিমনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।
আইনজীবী জানান, লিমনকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তাঁর মা বাদী হয়ে রাজাপুর থানায় র‌্যাবের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। পুলিশ ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে এ মামলা থেকে র‌্যাবের সদস্যদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে। ওই বছরের ৩০ আগস্ট লিমনের মা ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন। ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. শাহীদুল ইসলাম ওই নারাজি আবেদন খারিজ করে দেন। একই বছরের ১৯ মার্চ লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারিক হাকিমের খারিজ আদেশের বিরুদ্ধ রিভিশন আবেদন করেন।

গত এক বছর নয় মাসে সরকারপক্ষের কৌঁসুলির বারবার সময়ের আবেদনের কারণে এই রিভিশন আবেদনের শুনানি হয়নি। এ পর্যন্ত ১১ বার রিভিশনের শুনানির তারিখ পড়েছে। হেনোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারপক্ষের অনাগ্রহের কারণে এত দিনেও রিভিশনের শুনানি হয়নি। শুনানি হলে আশা করি আমি ন্যায়বিচার পাব।’
গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন লিমন। এ কারণে এক বছর পর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। এখন লিমন ঢাকার সাভারে গণবিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ছেন।
২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর ইউনিয়নের সাতুরিয়া গ্রামে নিজ বাড়ির পাশে মাঠ থেকে গরু আনতে গিয়ে ‘র‌্যাবের নিষ্ঠুরতার’ শিকার হন দরিদ্র পরিবারের কলেজপড়ুয়া সন্তান লিমন। ওই দিন সন্ধ্যায় তাঁকে রাজাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করায় র্যাব। অবস্থার অবনতি হলে ওই রাতে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এরপর ২৫ মার্চ তাঁকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ২৭ মার্চ চিকিৎসকেরা লিমনের জীবন বাঁচাতে তাঁর বাঁ পা ঊরুর নিচ থেকে কেটে বাদ দেন।
‘চরম নিষ্ঠুরতা’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ৬ এপ্রিল এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ঘটনাটি মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। তাঁকে চিকিৎসায় এগিয়ে আসেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাঁদের সাহায্যে তাঁর চিকিৎসা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র তাঁকে আইনগত সহায়তা দেয়। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিন পান লিমন।
লিমনের মায়ের মামলাটি চালিয়ে যেতে হবে: লিমনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করায় সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি বলেছেন, লিমনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা মিথ্যা হলে, র‌্যাবের বিরুদ্ধে লিমনের মায়ের দায়ের করা মামলাটি সত্য। এই মামলাটি বিবেচনায় এনে বিচার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। এতে বিচারকদের স্বাধীনতার সুফলের ক্ষেত্রটি তৈরি হবে।
আমাদের মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার কৈট্টায় প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান এসব কথা বলেন। এমপাওয়ারমেন্ট থ্রো ল ফর দ্য কমন পিপল (ইএলসিওপি) আয়োজিত এক সেমিনার শেষে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
লিমনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করবে—এ আশা ব্যক্ত করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের সঙ্গে এ রকম আচরণ করা যায় না। মিথ্যা মামলা দিয়ে কাউকে যদি হয়রানি করা হয়, তবে কমিশন ভুক্তভোগী ব্যক্তির পাশে দাঁড়াবে।
মিজানুর রহমান বলেন, লিমনের বিরুদ্ধে কেন মিথ্যা মামলা করা হয়েছিল, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আদালতের ওপর বর্তায়। মিথ্যা মামলা করা হলে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে পারেন। তিনি বলেন, বিচারকদের দৃষ্টান্তমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রমাণ হয়।

No comments

Powered by Blogger.