গণিকাপ্রণাম by রাশেদ রহমান

কান্দুপট্টিতে ভীষণ হইচই পড়ে গেছে। পড়ারই কথা। বেশ্যাবাড়ির কেউ বাপের জন্ম কোনোদিন এ ধরনের ঘটনা দেখেনি, শোনেওনি। শরৎচন্দ্রের কোনো গল্প-উপন্যাসে- বিভাবতীর উঠোনে এইমাত্র যে ঘটনা ঘটল, এ ধরনের কোনো ঘটনার উল্লেখ থাকলেও থাকতে পারে- আমার জানা নেই। কোথাও আমার চোখে পড়েনি। শরৎচন্দ্রে না থাকলে অন্য আর কোথাও থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরও পাঠক, আপনারা যারা দেশ-দুনিয়ার খবর রাখেন তাদের কারও ঘটে এ ধরনের ঘটনা-কাহিনী সঞ্চিত থাকলে দয়া করে আমাকে তা জানাবেন। আমি একটি গল্প-সৃজনে মনস্থির করেছি, আপনাদের জানানো আখ্যান অবলম্বনে গল্প লিখতে চেষ্টা করব- বাকিটুকু গুরুর কৃপা...।
বিভাবতীর ঘরের সামনে মানকচুর পাতার মতো একচিলতে উঠোন। উঠোনের মাঝখানে একটা বকুলগাছ। গোড়া বাঁধানো। এখানে সবসময়ই দু-চারজন গণিকা বসে থাকে। খদ্দরের সঙ্গে গল্প-গুজব করে। ঘটনা যখন ঘটে, তখনও দুই গণিকা ছিল। ওরাই পাড়ায় রাষ্ট্র করেছে, কে এক পাগল এসেছে বকুলতলায়; এসেই প্রণাম করেছে বিভামাসীকে; মা-মা করে কী যেন বলছে লোকটি, ঠিকমতো বোঝা যায় না। তবে লোকটি পাগল হলে কী হবে, দেখতে ভারি সুন্দর; সুপুরুষ। লেখাপড়া জানা লোক...।
‘মা, এক বুড়ি বেশ্যা এই জারজ আধুনিক সভ্যতার মূল মাতামহী। জারজ, কারণ- অফিসিয়ালি এই সভ্যতার পিতামহ ঈশ্বর নন। আর এই পৌত্রটি ভারি ভণ্ড ও সেয়ানা, তার চোখে তার মাতামহী অতি নিন্দিত, ঘৃণিত, বর্জিত এক প্রাণী...।’
অরুণদা’র কথার অর্থ, এখানে কেউ ধরতে পারবে- কার সাধ্য। সত্যি কথা বলতে কী, আমিও অরুণদার সব কথার অর্থ বুঝতে পারি না। তার অনেক বন্ধু, তাকে না বুঝে এড়িয়ে চলে। অরুণদাকে বোঝে ভালো কমল; কবি অর্ঘ কমল। অরুণদার কত কবিতা যে কমলের মুখস্থ- তার কোনো লেখাজোখা নেই। ওর সঙ্গে দেখা হলেই, শোনা যাবে; ওর কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছে- ‘জন্ম ও যোনির ঘাস ঢেকে দেয় নক্ষত্রের মুখ/শূন্যতাকে শুষে নেয় শেকড় ছড়িয়ে...।’ যাই হোক, এখন, উৎসুক গণিকারা অরুণদাকে ঘিরে আছে। তার কথা বুঝুক বা না-বুঝুক। লোকটি ফেরারি-টেরারি হতে পারে, বিভামাসীকে প্রণাম করে ভজাতে চাইছে, ভাবছে কেউ কেউ...।
বিভাবতী ধমক দিল গণিকাদের। ‘এই তরা এহন যা। বাবার আমার চোখ-মুখ কেমন শুকাইয়া গেছে। আগে জলটল কিছু মুখে দিক...।’
গণিকাদের আক্কেলগুড়–ম! বিভামাসী কখনও মাগি-ছাগী ছাড়া কথা বলে না। আজ হল কী? পাগল মার্কা লোকটাকে বাবা বলছে...।
- তুমি কুচবিহার থেকে পালালে কেন, মা? পৃথিবীর কত জায়গায় তোমাকে খুঁজেছি...।
কোথায় কান্দুপট্টি আর কোথায় কুচবিহার! তাছাড়া বিভাবতী কুচবিহার ছিলই বা কবে? আগন্ত জন্মে ছিল কিনা তা সে জানে না। সবাই পূর্বজন্মের কথা মনে করতে পারে না। বিভাবতীও পারছে না। কিন্তু লোকটিকে এখন কী বলবে সে! সে তো কোনোদিন কুচবিহারে ছিল না। পালানোর প্রশ্ন উঠছে কেন? লোকটি তাকে প্রণাম করেছে, মা ডাকছে...।
বিভাবতী প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল, ‘তুমি বসো বাবা। ঘরে বেল আছে। শরবত বানাইয়া দেই। বকুলতলা বইয়াই খাও। কারেন্ট নাই। ঘরে খুব গরম...।’
কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন অরুণদা। ‘হেমন্ত আর শীতে আমরা গ্রামের দিকে চলে যাই/গ্রীষ্ম আর বর্ষা আমরা শহরের গলিতে কাটাই/বসন্তে সারা অরণ্যে জ্বলে ওঠে আগুন আমাদের/মনে পড়ে না শহরে, অরণ্যে আর গ্রামে কীভাবে/বেড়ে উঠেছে আমাদের সন্তান,/ আমাদের মনে পড়ে না কী জন্য আমরা পৃথিবীতে এসেছিলাম...।’
একমনে কবিতা আবৃত্তি করছেন অরুণদা। কুচবিহার শহরের গণিকালয়ে প্রৌঢ়া গণিকা বিভাবতীর সামনে তরুণ বয়সে যে রকম করতেন! আজ এই বুড়ো বয়সে, বাংলাদেশে এসে যেন সেই হারিয়ে যাওয়া বিভাবতীকে খুঁজে পেয়েছেন। এখন আর অরুণদার অন্য কোনো খেয়াল নেই। আমি যে তাকে পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এলাম, তার পাশেই বসে আছি- এখন, সে খেয়ালও নেই তার...।
দুপুর বেলা। বাইরে করাতের দাঁতের মতো ধারাল রোদ। কোথাও যাওয়ার জো নেই। আমি ঘরে শুয়ে-শুয়ে ‘শব ও সন্ন্যাসী’র কবিতা পড়ছিলাম। ‘জয়পুর থেকে আমার চিঠি যায়/তুমি ডাকপিয়নের কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে নিয়েছ সেই চিঠি/আমি ভাবতে পারি, তোমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে.../আমার হাত ধরে সেই ছেলেবেলায় যেখানটায় এসেছিলে/সেইখানেই থেকে গেলে চিরটা দিন/আমি তো কত দেশ ঘুরে বেড়ালাম কত সরাইখানায়/আকণ্ঠ মদ্যপানের পর আমার স্বপ্নহীন ঘুম/শেষ হয়ে গেল/এক সরাইখানা থেকে আরেক সরাইখানায় হেঁটে যাওয়ার পথে/আমার সঙ্গে আলাপ হ’ল বেশ্যাদের.../মা আমার, চিঠি শুকে দেখো তুমি- সেই গন্ধ/সেই পুরনো গন্ধ- যা তোমারই, তোমার গর্ভের...।’
কবিতা পড়তে পড়তে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। তখনই বাইরে গলার আওয়াজ। জলদগম্ভীরকণ্ঠ। ‘সুমিত বাড়ি আছ...?’
ডাক শুনে আমার তন্দ্রা কেটে গেল। এত রোদের মধ্যে কে এলো! আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, কাঁধে খদ্দরের ব্যাগ; সৌম্যদর্শন এক প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটিকে কোথায় দেখেছি...?
- আপনি...?
- আমি অরুণেশ, অরুণেশ ঘোষ...।
- আপনি অরুণেশ ঘোষ? অরুণদা...!
পা ছুঁয়ে সালাম করলাম অরুণদাকে। দাদা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন...।
- এখন কোত্থেকে এলেন...?
- জাঙ্গালিয়া...।
- কুচবিহার থেকে কবে এসেছেন...?
- দিন-তিনেক হল...।
- খবর দেননি কেন? কমলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে...?
- তোমার বোধহয় ক’দিন ধরে কমলের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ফোন-টোন করনি। এসেই ওকে ফোন করেছি। ওর ফোন বন্ধ। দেখ, এখনও ওর কোন বন্ধ। তোমার নম্বর জানা থাকলে তোমাকে ফোন করতাম...।
ফোন বন্ধ রেখে পানকৌড়ির মতো ডুব মারা কমলের স্বভাব। মাঝে মধ্যেই কোথায় যে ও ডুব মারে, কে জানে...!
- কাপড়-চোপড় পরে রেডি হও। জরুরি কাজে এসেছি। বিভাবতীকে খুঁজতে যাব, তোমাদের কান্দুপট্টিতে...।
- বিভাবতী...!
- তুমি চিনবে না। গণিকা। আমার তরুণ বয়সে কুচবিহার থেকে হারিয়ে গেছে...।
- বলেন কী? আপনার তরুণ বয়সে যে মহিলা নিখোঁজ হয়েছে, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে? তাও আবার আমাদের কান্দুপট্টিতে...?
- আমার মন বলছে, মাসীমা তোমাদের এখানেই আছে...।
- থাকলে ভালো। আপনি এখন বিশ্রাম নিন। বিকালে যাওয়া যাবে। এই দুপুরবেলা...?
- গণিকালয়ে যাব, সময় বেছে-বেছে যেতে হবে...?
- কিন্তু...।
- বুঝেছি। তুমি ভয় পাচ্ছ। কেউ দেখে ফেলবে- কবি কথাকার সুমিত জহির বেশ্যাবাড়ি ঢুকল- সেই টেনশন করছ! ধিক তোমাকে। গল্প-কবিতা লিখছ, কিন্তু তুমি এখনও মানুষ চিনতে পারনি- পবিত্র মাটি তোমার অচেনা। পৃথিবীতে মুচি-মেথর-ডোম, মাতাল-পাগল-গণিকা; ওরাই প্রকৃত মানুষ- ওরা কোনো ভান করে না; কারও সঙ্গে প্রতারণা করে না। সমাজের ভদ্রবেশী টাকাওয়ালা মানুষগুলোই জোচ্চোর। শুনে রেখো সুমিত- গণিকালয়ের মাটির চে’ পবিত্র মাটি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই...।
আমি বিমূঢ়ের মতো অরুণদার কথা শুনছি। জীবন-জগৎ যে এ রকম হতে পারে, কোনো মানুষ তথাকথিত নিচু স্তরের মানুষদের নিয়ে এভাবে ভাবতে পারে- তাদের সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে পারে- এটা আমার কল্পনার মধ্যেও ছিল না...।
অরুণদা আবার বলতে শুরু করলেন- তোমার এখন বয়স কত? তিরিশ পার করেছ। এ বয়সেও তুমি বেশ্যাবাড়ি যেতে ভয় পাচ্ছ! তোমার তো লেখক-জীবনই বৃথা। পাঁচ বছর বয়সে আমার প্রথম গণিকাদর্শন ঘটে...।
- তাই নাকি? বলেন কী...!
- তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? চল, হাঁটতে হাঁটতে সেই গল্প তোমাকে শোনাই...।
অরুণদার যে শৈশবেই গণিকাদর্শন ঘটে, তার মুখেই যে আমরা সেই গল্প শুনব- তা আমি আগেই বলেছি। পাঠক, চলুন, আমরা অরুণদার মুখেই তার গণিকাদর্শনের গল্প শুনি...।
শোনো সুমিত, তোমরা হয়তো কিছুটা জান। ছিটেফোঁটা পড়েছ কোথাও কোথাও। জাঙ্গালিয়ার জোতদার শ্রীকান্ত তরফদার ছিলেন আমার তালুই, মানে আমার মায়ের মাতামহ। গাঁয়ের সবচেয়ে ‘ধনাঢ্য’ ব্যক্তি। সেই আমলে বাড়িতে পাকা ঘর। বাড়ির সামনে ঘাট বাঁধা বিশাল পুকুর। পুকুরের ওপারে প্রাচীন কালীমন্দির। বাড়িতে পূজা-অর্চনা লেগেই থাকে...।
শ্রীকান্ত তরফদারের একটি মাত্র মেয়ে ছিল- সুহাসিনী, আমার দিদিমা। সুহাসিনীর বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রাম নন্দনপুর। অকালবৈধব্য ঘটে দিদিমার। তখন, স্বামীর বাড়ি আর তার থাকা হয়নি। আমার মাসহ দুটি মেয়ে নিয়ে দিদিমা বাবার বাড়ি চলে আসে, চিরতরে। আমার মামাবাড়ি বলতে শ্রীকান্ত তরফদারের বাড়িকেই বুঝতাম। কুচবিহার থেকে মা-বাবাসহ আমরা এসে উঠতাম দিদিমার ঘরে। আমার শৈশবের বহুদিন কেটেছে এ বাড়িতে...।
তরুণ বয়সে বিপত্নীক হন শ্রীকান্ত তরফদার। তখনকার দিনে ধনাঢ্য বিপত্নীকদের কোনো আত্মীয়া বা বাড়ির দাসী-বাদীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক থাকত। কিন্তু শ্রীকান্ত তরফদারের তা ছিল না। তার নৈতিকতাবোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর। তবে, বাড়ির, গ্রামের সবাই বলত- গোপালপুর বাজারে তার একটি সুন্দরী রক্ষিতা আছে।
কথাটি আমিও শুনতাম। শ্রীকান্ত তরফদার আমার প্রৌঢ় বন্ধু বলে- নিজে নিজে বোঝার চেষ্টা করতাম, লোকে যে বলে; শ্রীকান্ত তরফদারের রক্ষিতা আছে; রক্ষিতা কী জিনিস? রক্ষিতা কাকে বলে?
রক্ষিতা কাকে বলে, অচিরেই যে টের পাব- তা আমার মাথায় ছিল না...।
একটা দুধ সাদা ঘোড়া ছিল শ্রীকান্ত তরফদারের। সেই ঘোড়ায় চেপে রোজ সন্ধ্যায় গোপালপুর বাজারে যেতেন তিনি। আমি যতদিন ওই বাড়িতে থাকতাম, ছিলাম তার নিত্যসঙ্গী। শ্রীকান্ত তরফদার কেন যে তার পুতিটিকে এতটা ভালোবসতেন, তা আমার জানা ছিল না। আমারও ভালো লাগত তাকে, তার সঙ্গ...।
গোপালপুর বাজার তখন পাটের ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ। বৈরান নদীর তীরে বাজার। বাজারে লালমোহন সাহার বড়ো গদি। এখানেই শ্রীকান্ত তরফদারের আড্ডা...।
আড্ডার এক ফাঁকে শ্রীকান্ত তরফদার আমাকে গদির কর্মচারীদের জিম্মায় রেখে কেটে পড়তেন- আমি টেরই পেতাম না। এখানে খুঁজি, ওখানে খুঁজি। কোথাও নেই। কী কাণ্ড কোথায় গেলেন মিছা?
আমরা বাড়ির ছেলে-ছোকরারা শ্রীকান্ত তরফদারকে ‘মিছা’ বলে ডাকতাম। কেন তাকে মিছা ডাকতাম- এ গল্পে সে ব্যাখ্যা অপ্রয়োজনীয়। আমরা মূলগল্পে ফিরে যাই...
আমার ছটফটানি দেখে গদির কর্মচারীরা বলত, ‘খোকা বইসো। বড়োকত্তা এখনই আইবো। ধলাঘোষের চমচম আইনা দেই। চমচম খাও...।’
সুমিত, তোমাকে বলে রাখি- আমি তখনই অকালপক্ব ছিলাম, ৫ বছর বয়সেই। উদাহরণ দিলে অনেক দেয়া যাবে- সেদিকে যাচ্ছি না। একদিন আমি তক্কে-তক্কে থাকলাম, কোথায় যান মিছা?
লালমোহন সা’র গদি ছেড়ে পাশের গলিতে ঢুকলেন মিছা। সামান্য এগিয়ে, বাঁ দিকে মোড় নিয়ে আরও একটা গলি। চাপা, সরু। গলির দু’পাশে লাগালাগি সারি-সারি ঘর। কোনটা টিনের চৌয়ারী, কোনটা দো’চালা। সব ঘরের সামনে গুচ্ছগুচ্ছ মেয়ে- ফুলের মতো। মিছা ধুতির কোঁচা মুঠো করে দ্রুতপায়ে হাঁটছেন। গলায় গুনগুন গান। কী আশ্চর্য! তাকে তো কোনোদিন সুর ভাজতে দেখিনি...।
আমি নিঃশব্দ পায়ে তার পিছু নিয়েছি। অবশ্য এটাও বুঝে ফেলেছি, মিছা যেভাবে যাচ্ছেন- পেছন ফিরে তাকাবার ফুরসত তার নেই...।
গলিপথ পেছনে রেখে, গোলাপ-গাঁদা-স্থলপদ্মের ছোট্ট বাগানওয়ালা সুদৃশ্য একটি কাঠের বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন মিছা। অদূরেই নদী। মিছা বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে ডাক দিলেন- অভয়, অভয়...।
ঘরের ভেতর থেকে রিনরিনে গলার আওয়াজ এলো- ‘দরজা খোলাই আছে। আইসেন...।’
মিছা স্বল্পালোকিত, সুসজ্জিত সেই ঘরে ঢুকলেন- তার পেছনে যে আমি সে সম্পর্কে তখনও তিনি অচেতন। কীসের মোহে যে ছোটে মানুষ...!
দেয়াল জোড়া আয়নার সামনে বসে প্রসাধনে ব্যস্ত এক পরমাসুন্দরী। এ মহিলাই তবে শ্রীকান্ত তরফদারের রক্ষিতা! আয়নার ভেতর দিয়েই সে এক ঘর্মাক্ত, বিস্মিত, হতচকিত বালককে দেখে। মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘কারে সঙ্গে নিয়া আইছেন বড়কর্তা...?’
মিছাও তখন পেছনে তাকান। দেখেন, আমি। স্তম্ভিত। নির্বাক। ঘরের ভেতরে তখন এমনই নিস্তব্ধতা যে- সেই রূপবতীর হাত থেকে হাতির দাঁতের চিরুনি খসে পড়ে...।
আমার মতো অকালপক্ব, হাড়বজ্জাত পুতিটির ওপর মিছা কখনও ক্রোধ প্রকাশ করেননি- হাজার অন্যায় করার পরও। আজও করবেন না, এটা আমার বিশ্বাস ছিল। ফলে গেল আমার বিশ্বাস। অনেকক্ষণ পর মিছা হেসে বললেন, ‘আমার পুতি। মেজো নাতনির পোলা...।’
রমণী হাত বাড়িয়ে দিলেন। ‘আসো বাবা, কাছে আসো। আমি তোমার আর একটা মা...।’
বুঝলে সুমিত, এভাবেই আমার প্রথম গণিকাদর্শন। মিছার রক্ষিতা অভয়াকে আমি ‘ছোটমা’ ডাকতাম। সে কবিতা লিখত। তার একটা বাঁধানো কবিতার খাতা আমার কাছে এখনও আছে। শুনবে তার কবিতা?
‘আমি এক অভাগিনী মৃত্যু নাহি মোর/আমি এক বিষধর, বিষে জ্বর-জ্বর/এই বিষ বেঁটে দিই পুরুষে-পুরুষে/কী ছিলাম কী হইলাম কপালের দোষে...।’
কথক সুমিত আবার ঢুকল গল্পে...
এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো অরুণদার প্রথম গণিকাদর্শনের গল্প শুনছিলাম।
আমরা হাঁটছিলাম আকুরটাকুরের ভেতরের রাস্তা দিয়ে। এ রাস্তায় প্রচুর গাছপালা। বকুলগাছ, নিমগাছ, বহেড়াগাছ...। রোদ কম। হাঁটতে হাঁটতে কখন কান্দাপট্টির সামনে, চৌরাস্তার মোড়ে এসে পড়েছি, টেরই পাইনি। গল্প শোনায় মগ্ন ছিলাম বলেই পথ এত দ্রুত সরেছে। টের পেলাম অরুণদার কথায়। দাদা বললেন, ‘সুমিত আমরা এসে পড়েছি...।’
- তাই তো! আপনি বুঝলেন কী করে...?
- পবিত্র মাটির গন্ধ পাচ্ছি। ‘এ যেন আমাদের ছোট শহরের বেঁটেখাটো আর দাড়িওয়ালা ঈশ্বরের সঠিক নির্দেশ/একগাঁ থেকে আরেক গাঁয়ে/পালিয়ে না-বেরিয়ে সোজা চলে আয় আমার এখানে।/এই ভাঙা বাড়ি, নেশুড়ে আর বেশ্যাদের আস্তানায়...।’ বুঝলে সুমিত, বেশ্যাবাড়ির কাছাকাছি গেলেই, আমি বুঝতে পারি- মা আমাকে ডাকছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে...।
আমরা, এখন, আবার বিভাবতীর ঘরের সামনে। বকুলগাছের বাঁধানো গোড়ায় বসে আছি। গল্প নিজে-নিজেই সৃজিত হোক...।
বিভাবতী একগ্লাস বেলের শরবত দিল অরুণদার হাতে। ‘খাও বাবা। শরবতটুক খাও। গা-গতর জুড়াইয়া যাবো...।’
শরবতের গ্লাস গাছের গোড়ায় রেখে দিয়ে অরুণদা চড়া মেজাজে বললেন, ‘আমি শরবত খাই না। শরবত খেতে এখানে আসিনি। আমাকে মদ দেন...।’ অরুণদা যখন কেবল হাফপ্যান্ট ছেড়ে পাজামা পরছেন, গোঁফের রেখা ফুটে উঠছে, সেই তখন থেকেই মদ ধরেছেন। সকালে খালি পেটেই তরল আগুন পেটে চালান করেন। চলে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। সেই লোকটি খাবেন শরবত! শরবতের গ্লাস দেখেই তার মেজাজ চড়ে গেছে। তিনি ভুলে গেছেন, এটা কুচবিহার না। এটা টাঙ্গাইল শহরের কান্দাপট্টি। তিনি এখানে বিভাবতীতে খুঁজতে এসেছেন, মেজাজ দেখানো ঠিক না...।
অরুণদার কথা শুনে বিভাবতীর শরীরে বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মতো ঝাঁকুনি খেল। আর কী আশ্চর্য! শরীরে ঝাঁকুনি খাওয়ার পর থেকেই সে তার পূর্বজন্মের সব ঘটনা দেখতে লাগল চোখের সামনে...।
কুচবিহার শহরের বাঁ-পাশ ঘেঁষে গণিকাপল্লী। পল্লীর উল্টোদিকে রাস্তার ওপারে বিশাল এক পুকুর। পুকুরের ওপর বিভাবতীর দোকান। কাঠের পাটাতন পাতা। বিভাবতী আগে গণিকাবৃত্তি করেছে। এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। গণিকাবৃত্তি করে না। দোকানে ভাত-রুটি-চা বিক্রি করে। রাতে বেচে মদ...।
একদিন, গা-ঝলসানো দুপুর; ১৬-১৭ বছর বয়সী অরুণেশ, কেবল গোঁফের রেখা উঠেছে- ঢুকল বিভাবতীর দোকানে। রোদে শরীর পুড়ে কালো হয়ে গেছে। অরুণেশকে দেখে মায়া হল বিভাবতীর। বলল, ‘বইসো বাবা, বইসো। শরবত বানাইয়া দেই, শরবত খাও...।’
অরুণেশ রাগী চোখে বলল, ‘আমি শরবত খাই না। মদ দেন...।’
অরুণেশের কথা শুনে বিভাবতী হতবাক। ছেলে বলে কী...?
- আমি বেশ্যা হইতে পারি বাবা, কিন্তু আমার একটা নীতি আছে। দিনে মদ বেচি না। ওই যে ভাটিখানা, ওইখানে যাও, মদ পাইবা। অরা দিনরাইত মদ বেচে...।
বিভাবতীর নীতিবাক্য শুনে অরুণেশের রাগ আরও চড়ে গেল। সে বলল, ‘আপনার আর কী-কী নীতি আছে, শুনি...?’
বিভাবতী শান্ত, ধীরস্থির। মুখে চিকচিকে হাসি। সে বলল, ‘সেসব শুইনা আর কী করবা? আমি যখন ঘরে লোক নিতাম। কিন্তু...।’
ততক্ষণে অরুণদারও স্থির বিশ্বাস জন্মেছে- এই রমণীই কুচবিহার থেকে হারিয়ে যাওয়া বিভাবতী। অরুণদা জিজ্ঞেস করলেন- আগে বলুন, আপনি কি কুচবিহারের বিভাবতী নন?
- হ্যাঁ বাবা, আমি সেই অভাগিনী...।
- পালালেন কেন?
- ছেলেকে একটার পর একটা চিঠি লেখতাম। তোমার মতোই এক ছেলে আমার হয়ে চিঠি লেইখা দিত। কিন্তু ছেলের উত্তর এলো না কোনোদিন। ছেলের চিঠি না-পাইয়া, দ্যাশটাই আমার কাছে নরক হইয়া উঠছিল, বাবা। কিন্তু, তুমি কে? তোমারে দেইখা যে আমার মনে হইতাছে- তোমারে আমি কতকাল ধইরা চিনি...।
- চিনবেন না কেন? আমি যে আপনার সেই ছেলে, অরুণেশ। আমিই আপনাকে চিঠি লিখে দিতাম...।
- অরুণেশ! বাবা, তুমি অরুণেশ...?
‘মা/ আমাদের আর কোনো দুঃ

No comments

Powered by Blogger.