রক্তের গ্রুপ ‘এ’ না ‘বি’ by কাজল ঘোষ

এক অদ্ভুত সময় অতিক্রম করছি আমরা। চলছে বিভক্তির সংস্কৃতি। এটা যে শুধু রাজনীতিতে তা নয়। শিক্ষক সমাজ বিভক্ত। সাংবাদিক সমাজ বিভক্ত। আইনজীবীরা বিভক্ত। কবি-সাহিত্যিকরা বিভক্ত। শ্রমিকরা বিভক্ত। পুরো জাতিই আজ বিভক্তিতে বিদীর্ণ। যারা এর বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান কোথায়? একটু ভেবে দেখুন তো আপনি কোন এক মামলায় জড়িয়ে আইনের আশ্রয় চাইতে গেলেন আদালতে। সেখানে যে আইনজীবীর দ্বারস্থ হলেন তিনি এক ভিন্নমতের। তাতে কি আপনি সরে আসবেন ন্যায়বিচার পাবেন না এ আশঙ্কায়? অথবা যে আইনজীবীর মক্কেল হলেন তিনি যদি জানতে পারেন আপনি তার দলের সমর্থক নন, তাহলে তিনি কি আপনাকে উল্টো প্রতিকারের চেয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন? একই অবস্থা যদি দাঁড়ায় আমাদের শিক্ষাঙ্গনে, কি দাঁড়াবে? এবার যে পদ্ধতিতে এসএসসি ও এইচএসসিতে ফল বাড়িয়ে দিয়ে পাসের হার বাড়ানোর কথা শোনা যাচ্ছে, ঠিক একই পদ্ধতিতে যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলে দেয় যারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বাইরে আছে তাদের ফেল করিয়ে দাও- তাহলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে? এখন যেমন হলগুলোতে চলছে। সেখানে থাকতে হলে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনে যুক্ত হতে হবে। পরিচিত এক ছাত্রের কথা জানি, যে কিনা কোন দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকার অপরাধে হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। কি রীতি চলছে আমাদের এখানে, যেখানে দলভুক্ত হতেই হবে। পেশাগত পরিচয়ে আমি একজন সাংবাদিক। কিন্তু দুঃখ হয় এ পেশাতেও বিভক্তি দেখে। দেশের যতগুলো জেলা-উপজেলা যাওয়ার সুযোগ হয়েছে খোঁজ নিয়েছি সেখানকার প্রেস ক্লাবের কি অবস্থা? বেশির ভাগ জায়গাতেই দেখেছি প্রেস ক্লাব দু’টি। এটা কোন শিক্ষার মধ্যে পড়ে। যেখানে সাংবাদিক হচ্ছে সব মানুষের বিপদের বন্ধু। সাংবাদিকতা হচ্ছে একটি নৈতিক মানদণ্ডে উন্নীত পেশা। যা সমাজের দর্পণ বলে পরিচিত। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো যেখানে ব্যর্থ হয়, মানুষ যখন থানা পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার কাছে কোন অন্যায়ের প্রতিকার পায় না- তখন মানুষ ছুটে আসে সাংবাদিকদের কাছে। অথচ এখানেও বিভক্তির ঝাণ্ডা। জাতীয় প্রেস ক্লাবও এর বাইরে না। একেক সরকারের সময় তারা সমর্থনপুষ্ট দলীয় লেবাসের সাংবাদিকরা পুষ্ট হন। পকেট আর পেট ভারি করেন। দেশ-বিদেশে ট্যুর করে বেড়ান। যারাই এ বিভক্তির হোতা তারাই আবার সমাদৃত দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণেই। জানি না, কবে সাংবাদিক সমাজের উপলব্ধি হবে। সারা দেশে এক প্রেস ক্লাবে নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সামিল হবে। কোন দলের নয় সবার পরিচয় হবে পেশার ভিত্তিতে। আমাদের লিখতে হবে না তিনি অমুক গ্রুপের সাংবাদিক আর উনি অমুক গ্রুপের সাংবাদিক। লিখতে হবে না সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) অমুক গ্রুপ। আর দুস্থ সাংবাদিকতার তালিকায় ঠাঁই পেতে ফ্ল্যাটের মালিকরাও ছুটবেন না। প্লট পেতে ধর্না দেবেন না মন্ত্রীদের দপ্তরে।
সাংবাদিক সমাজ বিভক্ত থাকলে কোন ঘটনার কি ধরণের মর্মান্তিক পরিণতি হতে পারে তা নিকট অতীতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে আন্দোলনের সলিল সমাধির দিকে তাকালে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যাবে। বিচারের দাবিতে দল-মত-নির্বিশেষে একটি ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচির পরিণতিহীন ইতি ঘটলো অল্পদিনেই। এ দম্পতি হত্যার বিচার নিয়ে কঠোর থেকে কঠোরতর আন্দোলনের কর্মসূচি মিইয়ে গেল দৃশ্যমান কিছু সভা-সমাবেশেই। সেখানে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছিল দলের বাইরে এসে পেশাগত পরিচয়কে বড় করে দেখার। কিন্তু না, তা বেলুনের মতোই চুপসে গেল অদৃশ্য হস্তক্ষেপে। আওয়ামী লীগ টেবিল আর বিএনপি টেবিলে বিভক্ত সাংবাদিক সমাজ এভাবেই থেমে গেল। নেতাদের এক গ্রুপ ছুটলেন বর্তমানের নগদ সুবিধার আশায় আর অন্য গ্রুপ থামলেন ভবিষ্যৎ প্রাপ্তির প্রত্যাশায়।
সাম্প্রতিক বেশ ক’টি ঘটনা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে কোনদিকে যাচ্ছে দেশ। এখানে লাশ আর জানাজা নিয়ে চলছে নির্লজ্জ রাজনীতি। প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসা টকশোর সরব কণ্ঠ ছিলেন। সরকারের নানা জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় মুখর ছিলেন শেষ দিন তক। কিন্তু পরিণতি কি দেখলাম, যেহেতু সরকারের সমালোচনা করেছেন সুতরাং যেনতেনভাবে তাকে হেনস্তা করা হলো। জীবদ্দশায় সরকার সমর্থক এক সাংসদ এবিএম মূসাকে ঠ্যাং ভেঙে দেয়ার কথা বলেছিলেন। অনেকেই সিঁদেল চোর, জ্ঞানপাপী বলে মন্তব্য করেছিলেন। যা-ই হোক এ মানুষটি যখন প্রয়াত হলেন তখনও তাকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা হয়েছে নানাভাবে। একজন এমপির জানাজা সংসদ প্লাজায় পাওয়ার বা হওয়ার হক রয়েছে। তার ব্যত্যয় ঘটেনি এবিএম মূসা ছাড়া অন্য কারও বেলাতেই। এ বিষয়ে সংসদ সচিবালয়ও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন মাননীয় স্পিকারও। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। কারণ একটাই, সরকারের সমালোচনা করা ছিল মানুষটির অপরাধ। পত্র-পত্রিকাতে কলাম পর্যন্ত খুব একটা লেখা হয়নি। যদি আবার সরকার পক্ষের তালিকার সাংবাদিক থেকে নাম কাটা যায় এ ভয়ে। একই ধরনের বিতর্ক দেখা গেল ভাষাসেনাপতি আবদুল মতিনকে নিয়েও। তিনি প্রয়াত হলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার দাবি ওঠে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী খুব সহজেই বলে দিলেন প্রটোকল সমস্যার কথা। কিন্তু এবিএম মূসার ক্ষেত্রে কোন প্রটোকল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে জবাব ওনারাই ভাল দিতে পারবেন। এখন বিতর্ক চলছে ড. পিয়াস করিমকে নিয়ে। এক পক্ষ শহীদ মিনারে নেয়ার বিষয়ে একাট্টা, আরেকপক্ষ দাঁড়িয়ে গেছেন বাধা দেয়ার জন্য। একজন মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে এ ধরনের বিতর্ক ও সাংঘর্ষিক অবস্থান কোন সুস্থ সংস্কৃতির জন্যই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা?
গণতন্ত্রের শক্তি হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। অথচ আমাদের দেশ চলছে উল্টোপথে। এখানে কেউ আমার বিরুদ্ধে গেছে তো সে খারাপ। কেউ আমার সমালোচনা করছে তো সে মন্দ। একে অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে জীবন পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন এমন ব্যক্তিও ছিলেন এককালে। কিন্তু আমাদের এখানে কেউ কোন নতুন মত হাজির করলে তার বিরুদ্ধে দলগতভাবে মিথ্যা প্রচারণা ও কুৎসা রচনার ডিজিটাল এক নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে। সত্যমিথ্যা মিলিয়ে যা খুশি স্ট্যাটাস দিলেই হলো। এবিএম মূসা যখন প্রয়াত হলেন তার ক’দিন পর আবদুল গাফফার চৌধুরী এক কলামে লিখলেন, এবিএম মূসা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চাইবেন বলেছিলেন। কথা হচ্ছে, তা মৃত্যুর পরই সবাইকে জানতে হলো। এবিএম মূসার এমন ঐকান্তিক ইচ্ছার খবর যারা দেশে কাছাকাছি ছিলেন তারা জানার সুযোগ পেলেন না। কিন্তু দূর প্রবাসে ইথারে-ইথারে সেই অন্তিম ইচ্ছার খবর জানলেন গাফফার চৌধুরী। গত মাসেই স্কটল্যান্ডে গণভোট হয়ে গেল। সেখানে বৃটেনের পক্ষে থাকার বিষয়েই রায় হয়েছে। ৪৫ ভাগ লোক সেখানে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছে। ঐতিহাসিক এ ভোটের পরে সেখানে স্বাধীনতার পক্ষে থাকা স্যামন্ড জনগণ আরও এক ধাপ এগিয়েছে স্বাধীনতা প্রশ্নে- এই বলে অপেক্ষা করতে বলেছেন। অথচ এখানেই স্বাধীনতা চেয়ে উইলিয়াম ওয়ালেসকে জীবন দিতে হয়েছিল। সংস্কৃতি বদলাচ্ছে। সেখানে এখন আর মতের বাইরে থাকা লোকদের নিশ্চয়ই রাজাকার বলা হচ্ছে না। ভাবুন তো বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটলে চিত্রটা কি হতো। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে হলেও এ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে উদ্যোগ নিয়েছে। অল্প পরিমাণে হলেও রায় বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। কিন্তু এ বিচার নিয়ে যখন নানা কারসাজি আর আড়ালে সমঝোতার কথা শোনা যাচ্ছিল, ঠিক তখনই তরুণ প্রজন্ম জেগে উঠেছিল। এটা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়। কিন্তু এ আন্দোলন এমন এক পর্যায়ে গেল তখন গণজাগরণ মঞ্চের গঠনমূলক সমালোচনা করলেই যে কেউ তাদের রোষানলে পড়তো। মঞ্চ থেকেই তখন বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া হতো। চামড়া তুলে নেয়ার আওয়াজ আসতো। দালালরা হুঁশিয়ার, সাবধান- স্লোগান হতো। কিন্তু সময় বদলেছে। পদ্মা-মেঘনায়ও অনেক জল গড়িয়েছে। আজ গণজাগরণ মঞ্চ হয়েছে তিন টুকরো। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দালাল ঠাউরাচ্ছে দিবারাত্রি। তাহলে সে সময় যাদের গঠনমূলক সমালোচনাকে দালাল-রাজাকার বলা হয়েছে তার কি হবে? এখনও যারা ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করছেন, বিচার প্রক্রিয়ার মন্থর গতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তারা কি তাহলে রাজাকার? শেষ করতে চাই বিবেকের কাছেই কিছু প্রশ্ন রেখে।  কেউ সামান্য ব্যঙ্গ বিদ্রুপের জন্য যদি বিচারের আওতায় আসেন, জেল জরিমানা ভোগ করেন- তাহলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের রাজনীতিকরা যে ধরনের কুৎসা রটান, গালমন্দ করেন, মিথ্যাচার করেন, সংসদ অপবিত্র করেন তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনা জরুরি নয় কি? যে কোন মানুষের মতকেই দলভুক্ত করে তাকে বিরুদ্ধ কাতারে ফেলে দেয়া কোন সুস্থ সংস্কৃতি হতে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে তার খেসারত দিতে হবে। মনে রাখতে হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি বদলায়। পরিবর্তিত বাস্তবতায় নতুন নতুন ঘটনাপ্রবাহ ও অভিজ্ঞতা যুক্ত হয় কালের প্রবাহে। কিন্তু পরমতসহিষ্ণুতা; ভিন্নমত চলমান। যে কোন বিষয়েই সুস্থ বিতর্ক জরুরি। না হলে ভবিষ্যৎ যেদিকে যাচ্ছে তাহলে রোগীর চিকিৎসা দিতে ডাক্তাররা আবার রক্তের গ্রুপ মিলিয়ে চিকিৎসা দেবেন না তো। কার রক্তের গ্রুপ ‘এ’ আওয়ামী লীগ আর কার রক্তের গ্রুপ ‘বি’ বিএনপি- এই ভিত্তিতে যদি দেশ চলতে শুরু করে তবে কি ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে- একটিবার ভাবুন তো ?

No comments

Powered by Blogger.