ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধেক শিক্ষার্থী টেকে দ্বিতীয়বারে by আসিফুর রহমান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি বছরের ভর্তি পরীক্ষায় মোট উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪৮ শতাংশই দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়েছেন। এঁদের অনেকেই প্রথমবার অপছন্দের বিষয়ে ভর্তি হয়ে এ বছর আবার পরীক্ষা দিয়েছেন। কেউবা ভর্তির সুযোগ না পেয়েও বছরভর পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা আকস্মিকভাবে এক বছর আগে উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় মোট উত্তীর্ণ ৪৫ হাজার ৫৩ জনের মধ্যে ২১ হাজার ৪৯৩ জনই দ্বিতীয়বারের পরীক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে এসব ছাত্রছাত্রী চাকরির বাজারে চাহিদা থাকা ­বিষয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ আর পাবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরীও।
প্রতিবছর সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজার চাহিদা না থাকা বিষয়গুলোতে প্রায় চার হাজার আসন ফাঁকা থাকছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে। এই প্রেক্ষাপটে সব আসনে শিক্ষার্থী ধরে রাখার দাবি জোরদার হলেও উপায় খুঁজে পাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে করছে, নতুন ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে আসন ফাঁকা থাকার প্রবণতা অনেকাংশে কমবে। তবে আজাদ চৌধুরীর মতে, আসন ফাঁকা থাকা সমস্যার রাতারাতি ও সহজ কোনো সমাধান নেই।
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দেওয়াকে নীতিগতভাবে সমর্থন করলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে। তবে তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নতুন সিদ্ধান্ত আগামী বছরের পরিবর্তে ২০১৬ থেকে কার্যকরের পক্ষে মত দেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, দেশের ৩৪টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আসন রয়েছে ৯০ হাজারের কাছাকাছি। পরিসংখ্যান বলছে, আসন শূন্য থাকার বিষয়টি আগে থেকে চলে এলেও তা ক্রমাগত বাড়ছে।
তবে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজগুলোতে সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো আসন খালি হচ্ছে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার পর আসন ফাঁকা থাকার পরিমাণ কমে আসে। অন্যদিকে মেডিকেল কলেজগুলোতে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকলেও এ জন্য প্রাপ্ত মোট নম্বর থেকে পাঁচ কাটা হয়।
প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবার এক বিষয়ে ভর্তি হয়ে দ্বিতীয়বার অন্য বিষয়ে চলে যাওয়ার কারণে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ৪২১টি, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৪১৬টি ও ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৪২৯টি আসন ফাঁকা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এটা ঠেকাতে এক বছর আগে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ বন্ধ করা প্রয়োজন।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, দ্বিতীয়বার যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়, তাদের দীর্ঘ প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ থাকে। ফলে পরীক্ষায় একটি অসম প্রতিযোগিতা হয় এবং কোচিং-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করলে আসন খালি থাকার সংখ্যাও কমবে বলে মনে করেন উপাচার্য।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি আসন খালি থাকছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হিসাবে, সেখানে কমপক্ষে ৫ শতাংশ আসন ভর্তির পরের বছরই খালি হয়ে যায়। এই হিসাবে প্রায় দেড় শ আসন ফাঁকা থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ওহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের অপছন্দের বা বাজার চাহিদা কম থাকা বিষয়গুলোর আসন এক বছর পর ফাঁকা হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে তারা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো বিষয়ে বা ঢাকাসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বা বুয়েটে ভর্তি হয়।
রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটিতে এক শ থেকে দেড় শ আসন দ্বিতীয় বছরে গিয়ে শূন্য হয়ে পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন ফাঁকা থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, এটা উচ্চশিক্ষার একটি বড় সংকট। কিন্তু দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ না দিলেই যে আসন ফাঁকা হবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। তবে এ প্রবণতা হয়তো কিছুটা কমবে।
ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেন, এই সমস্যার সমাধান চাইলে গভীরে যেতে হবে। উচ্চশিক্ষার বাজার চাহিদা, পরিবারের চাওয়া, শিক্ষার্থীর আগ্রহ, চাকরির সুযোগসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা করতে হবে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্বল বা বাজার চাহিদা না থাকা বিষয়গুলোতেই বেশি আসন ফাঁকা থাকছে। এসব বিষয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেরই লক্ষ্য থাকছে পরের বছর ভালো বিষয়ে ভর্তি হওয়া। মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেরই লক্ষ্য থাকে পরের বছর চিকিৎসা বা প্রকৌশল বিষয়ে ভর্তি হওয়া।
এ প্রসঙ্গে এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন বিষয় খোলা ও আসন বাড়ানো হয়েছে। এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো থেকে পাস করা মানেই কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেকার হওয়া।
অবশ্য বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাকাজের বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বলে সম্প্রতি ‘হাই ইউনিভার্সিটি এনরোলমেন্ট, লো গ্র্যাজুয়েট এমপ্লয়মেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। ওই প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার।
ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেন, আসন ফাঁকা থাকার সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত এবং সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের লক্ষ্যে একটি শাখা খোলা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় দফা ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করায় শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটির সভায় দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুবিধা বাতিল করা হয়। এই সিদ্ধান্ত আগামী ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।
চলতি ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পাননি, এমন একাধিক শিক্ষার্থী প্রথম আলো কার্যালয়ে ফোন করে বলেন, সিদ্ধান্তটি পরবর্তী বছর থেকে কার্যকর করা হোক।
এ বছর প্রথমবার পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগ না পাওয়া ছাত্রী সামিয়া শরীফ বলেন, দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে অনেকেই ভালো করছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর এ বছর ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় খুব কম ছিল। তাই দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়া উচিত।
এ বছর প্রথম পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগ না পাওয়া এক ছাত্রীর বাবা মোহাম্মদ আবু নোমান বুখারি জানান, একবার পরীক্ষা দেওয়ার পর অনেক শিক্ষার্থী অভিজ্ঞ হয়ে পরের বছর ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষার্থীরা এই সুযোগে বেশি উপকৃত হচ্ছে। তাই এটা হঠাৎ করে বন্ধ করা উচিত হবে না।

No comments

Powered by Blogger.