পাবনা-১ আসনে যেভাবে নির্বাচন by অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ

কখনও কখনও মানুষের জীবনে ব্যক্তিক ঘটনা ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। ইতিহাসে এর উদাহরণ বিরল নয়। জাতীয় জীবনে সংকটময় মুহূর্তে সত্য-মিথ্যা, কুৎসিত-সুন্দর এবং প্রতিশ্রুতি ও প্রতারণা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে উন্মোচিত হলে দেশ ও জাতি উপকৃত হয়। এ কথা মনে রাখা আবশ্যক যে, সরকার সম্পর্কে সমালোচনার অর্থ এই নয় যে, সে সরকারের শত্রু। বরং রাষ্ট্র সম্পর্কে সমালোচনা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কথাটি এ প্রসঙ্গে বলছি যে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ও নির্বাচনী প্রার্থী হিসেবে কীভাবে ভোট ডাকাতি, কারচুপি অনুষ্ঠিত হয় তার কিঞ্চিৎ বিবরণ তুলে ধরা বিবেকী দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধ থেকে কিছু ঘটনা উপস্থাপনের উপলব্ধি আমার মনে ক্রিয়াশীল, এ কারণে ভবিষ্যতে সুন্দর, সুষ্ঠু, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক একটি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অনিবার্যতায় তা প্রয়োজন হতে পারে।
১. চারদিকে ঘন কুয়াশা। নির্বাচনের আগের রাত প্রায় সাড়ে ৮টা। তীব্র শীত। তিনটি গাড়ি কুয়াশা কেটে এগিয়ে এলো। গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো-চ ৫৩-০৯৬০, ঢাকা মেট্রো ১১-৯৭৩৫, ঢাকা মেট্রো-চ ১৩-০৪৫৯ ও হাজী মক্কা ট্রাভেলস মিনিবাস। বাস থেকে নামল কমপক্ষে ৩০ জন বহিরাগত সন্ত্রাসী। উঠল টুকুর ভাই ১৬ বছর ধরে মেয়র পদ দখলে রাখা আবদুুল বাতেনের তিন তলা বাড়িতে। নির্বাচনের দু'দিন আগে থেকে যান চলাচল বন্ধ। কিন্তু এ গাড়িগুলো এলো কীভাবে? খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানো হলো। জানানো হলো র‌্যাব ও বিজিবিকে। তারা অতিশয় ভদ্রভাবে বললেন, বিষয়টি তারা দেখছেন। কিছুই যখন হলো না, প্রায় এক ঘণ্টা পর বেড়া কলেজে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে তাদের বিশেষভাবে জানালাম, এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে নির্বাচন নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু হবে না। বললেন, দেখি পেট্রল পার্টি পাঠানো যায় কি-না। ইতিমধ্যে বিষয়টি আন্দাজ করে সন্ত্রাসীরা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তখন তাদের ধরে কে? খাওয়া-দাওয়া করে বল্গুপ্রিন্ট মোতাবেক বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসীরা চলে যায়।
২. ভোট শুরু হওয়ার আগে ঘন কুয়াশায় সকাল ৯টায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কথিত এপিএস দোলনের নেতৃত্বে পাইকরহাটি শহিদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রায় ২০ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা চালায়। ভোটকক্ষের কয়েকটি বুথে প্রবেশ করে বই নং ২৩৩১, ২৩৩২, ২৩৫১ ছিনিয়ে নিয়ে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। এসব ব্যালটের অপর পৃষ্ঠায় কোনো অফিসারের সহি-স্বাক্ষর নেই। তালা মার্কার পোলিং এজেন্টকে পিস্তল ঠেকিয়ে রাখে। এর মধ্যে সে চিৎকার করলে জনগণ এগিয়ে আসে। আধা ঘণ্টা বারবার মোবাইল করে র‌্যাব, বিজিবিকে পাওয়া গেলে তারা সেখানে যান এবং সন্ত্রাসীরা তাদের দখল ছেড়ে দেয়। এর পর তারা বীরদর্পে সাটিয়াকোলা মাদ্রাসা, বরাট কেন্দ্র, মেহেদীনগর, কাবারিকোলা, শ্রীধরকোলা এলাকায় গিয়ে এজেন্টদের বের করে দিয়ে নৌকা মার্কায় বেপরোয়া ভোট কেটে বাক্সে ঢুকায়। কোথায় পুলিশ, র‌্যাব বা কোথায় বিজিবি?
৩. পৌর মেয়র আবদুুল বাতেনের নেতৃত্বে হাড়িয়া, চরপাড়া, ভুলবাড়িয়া, ডহরজানি, ধুলাউড়ি মাদ্রাসায় তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে কর্তব্যরত সহকারী পুলিশ সুপারকে দিয়ে তালা মার্কার মিন্টুসহ এজেন্টদের বের করে দেয় এবং সেখানে ভোট কাটার মচ্ছব শুরু হয়। একইভাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বড় ছেলে আশিক শামস রঞ্জনের নেতৃত্বে মিয়াপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সামান্যপাড়া, বিষুষ্ণপুর, ক্ষেতুপাড়া, খালইভরা প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকক্ষে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে তালা মার্কার এজেন্টদের বের করে দেয় এবং নির্বিচারে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ভোট কাটতে থাকে।
৪. স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছোট ছেলে নাসিফ শামস রনি চাকলা ইউনিয়নে ফারুকের সন্ত্রাসী দল নিয়ে চাকলা বিদ্যালয়, পাচুরিয়া মাদ্রাসা, নতুন ভারেঙ্গা ও পূর্ব শ্রীকণ্ঠদিয়ায় এক দারোগার স্ত্রী হাবিবা জোরপূর্বক তালা মার্কার এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোট কেটে নেয়।
৫. স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী স্বয়ং আতাইকুলা এলাকার সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান কোরবান আলীকে সঙ্গে নিয়ে আড়িয়াডাঙ্গী ভোটকেন্দ্রে ঢুকে পড়েন। এজেন্ট টিটুকে অপহরণ করে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেন। তিন মাইল দূরে এসে তাকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। এ সময় ছয়টি বুথের ১২টি বই (প্রতিটি বই ১শ পাতার) নিয়ে কেটে বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। একইভাবে বৃহস্পতিপুর সেন্টারে তার বাহিনীসহ ঢুকে পাঁচটি বই কেটে বাক্সে ঢুকিয়ে দেন।
৬. এ রকম প্রায় ৪০টি সেন্টারে সরাসরি শুধু এজেন্ট নয়, প্রিসাইডিং অফিসারদের পিস্তল ঠেকিয়ে ভোট ডাকাতির নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, দুই পুত্র, ভাই বাতেন, তার কথিত তিন এপিএস, হালিম, চোদ্দ, বাবুল, টুটুল, মুকুল, জিয়া, সালাম, ইসরাফিল, চাদ, সেলিম, লিটন মোল্লা, কল্লোল, বাবুল (নন্দনপুর), লতিফ, শফিক, ইকবাল, আশরাফ মেম্বার, আজাদ, আসাদ, পল্টন, জহুরুল মাস্টার, সরওয়ার, মন্ত্রী, টুটুল, জামাল, জরিফ, রঞ্জু, ইউনুস মাস্টার, লালু, সাত্তার, শামীম, নজরুল, পিন্চু, আমজাদ প্রমুখ সন্ত্রাসী বাহিনী। ৪২টি সেন্টারে এজেন্টদের বের করে দিয়ে সন্ত্রাসীরা যেখানে পালাক্রমে একেকজন ১০-১৫টি ভোট দিয়েছে। এসব জায়গায় তালার গড় ভোট ৩৫০ এবং নৌকার গড় ভোট ৪৬১। অন্য ৩৫টি সেন্টারে গড় ফলাফল তালা ৫৪২ ভোট ও নৌকা ৩৯২ ভোট।
৭. উল্লেখ্য, সকাল সাড়ে ১১টায় সাঁথিয়ায় রিটার্নিং অফিসার বরাবর এসব কেন্দ্রে চলমান ভোট ডাকাতির অভিযোগ দিয়েছি। কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিভিল প্রশাসন চেষ্টা করলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সেভাবে সক্রিয় ছিল না বলে প্রতীয়মান। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসীদের ধরেও কার নির্দেশে ছেড়ে দিয়েছে_ তা জনগণের কাছে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। ভোটের আগের রাতে তালা মার্কার এজেন্টদের পুলিশ বাড়িছাড়া করেছে। অভিযোগে কোনো কাজ হয়নি। এমনকি এসব ঘটনা রিটার্নিং অফিসার ও প্রধান নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে ভোট ডাকাতির সেন্টারগুলো স্থগিত করার আবেদন জানিয়েছিলাম ওই দিন বিকেল ৩টার মধ্যে। কিন্তু কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশন জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন_ ভোট নিরপেক্ষ হবে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আসলে তাদের মুখের কথা ও বাস্তবতা এক কি-না? সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমি ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রমাণিত হয়েছে_ এই ৬৮ পাবনা-১ নির্বাচনী এলাকার জনগণ হুমকি-ধমকি, ভয়-ভীতি, সন্ত্রাস ও প্রতারণার শিকার হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ব্যাপক চাপের মুখে রাখা হয়েছে। এমনকি মারপিট করা হয়েছে। এভাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি লণ্ডভণ্ড করেছেন। সরকার, নির্বাচন কমিশন_ সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর মুখে অমোচনীয় কালিমা লিপ্ত করেছেন। জনগণের ভোটকে জবাই করেছেন তারই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। এই দায় ও দায়িত্ব কে বহন করবেন?
রাজনীতিবিদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও খসড়া সংবিধান কমিটির অন্যতম সদস্য

No comments

Powered by Blogger.