কাঠকয়লায় লেখা আমীরুলের ছড়া

আয়রে পাখি লেজ ঝোলা/ তোরে দেবো দুধ কলা/ খাবিদাবি কলকলাবি/ খোকাকে তুই ঘুমপাড়াবি ছেলে বেলায় এই সব ছড়া ছিল আনন্দদায়ী। একটা লেজ ঝোলা পাখি কল্পনা করতাম এবং নিজেই খোকা হয়ে যেতাম ঘুমাবার ছলে। আরেকটা ছড়া- ছেলে ঘুমালো/পাড়া জুড়ালো/বর্গী এলো দেশে/বুলবুলিতে ধান খেয়েছে/খাজনা দেবো কিসে? ভাবতাম বর্গীরা নিশ্চয় ডাকাত, তারা গ্রামে ঢুকে লুটপাট করে- আলীবাবা চল্লিশ চোরের মতো। এসব চিন্তার সঙ্গে আরেকটা চিন্তার ঐক্য তৈরি হতো সেই কৈশোরে। তারো পরে জসীমউদ্দীনের যে পদ্যটি আমাকে ভীষণ নাড়া দিত সেটি হচ্ছে- আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা/ ফুল তুলিতে যাই/ ফুলের মালা গলায় দিয়ে/ মামার বাড়ি যাই/ মামার বাড়ি পদ্মপুকুর/ গলায় গলায় জল/ এপার হতে ওপার গিয়ে/ নাচে টেউয়ের দল। মামার বাড়িতে যাওয়ার আগে-পরে এই ছড়া মনে কত আনন্দ বিস্ময়ের কত চিন্তারই না জন্ম দিত। বন্দে আলী মিয়ার- আম গাছ জাম গাছ/ বাঁশ ঝাড় যেন/মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন/ পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই/ এক সাথে খেলি আর পাঠশালা যাই। অপূর্ব দ্যোতনা তৈরি করত কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীনের আরও একটা ছড়া- ও বগা তুই খাস কি/ পান্তাভাত চাস কি/ একটু যদি পাই হাপুস হুপুস খাই। কিংবা রোকনুজ্জামান খানের- বাকবাকুম পায়রা/ মাথায় দিয়ে টায়রা/ বৌ আসবে কালকি/ চড়বে সোনার পালকি। এই সব অসম্ভব কৌতূহলকর ছড়া পড়ে কৈশোর পার করেছি। এসএসসি পড়ার সময় হাতে এলো আবু সালেহ-এর পল্টনের ছড়া- ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না/ বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার/ এমন স্বাধীনতা। ছড়ার যে আরও একটা রূপ আছে সমাজের অন্যায় অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ছড়া একটা অস্ত্র তা আমাকে দারুণভাবে স্পর্শ করে। যশোরে বসেই শিশুতোষ লেখা লিখতাম- পত্রপত্রিকায় ছাপা হলে খুব আনন্দ পেতাম- হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বন্ধুদের দেখতাম। ওই সময় কিশোরদের পত্রিকা বেরুল- কিশোর বাংলা। ওখানে আমার লেখা ছাপা হতো- আর যাদের লেখা পড়তাম- লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম আরও অনেক। খুব রঙিন ছবি এঁকে ইলাস্ট্রেশন করে ছাপা হতো কিশোর বাংলায়। আমীরুল রিটনের লেখার সঙ্গে দেখা হতো সেখানে। তখন দেখা হতো পত্রিকার পাতায়। ঢাকায় এসে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে দেখা হল সরাসরি- আমীরুল ও রিটনের সঙ্গে। ভাব হলো দুজনের সঙ্গেই। আমীরুলের মনমাতানো হাসি। দারুণ আড্ডাবাজ বন্ধুবৎসল সে। কথা দিয়ে মানুষ ভজানোর কারিগর আমীরুল। গদ্যে পদ্যে সব্যসাচী। সম্পাদনা ও সংগঠকের ভূমিকাতেও দীপ্র। আমীরুলের পরোপকারিতা এখন সর্বজনবিদিত। ওর কাছ থেকে কোনো কোনো কাজ এক কথায় পাওয়া যায় আর কোনো কাজ এক বছরেও নয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ছেড়ে আমীরুল এখন চ্যানেল আইতে। ওকে একটা কবিতার বই উৎসর্গ করেছিলাম। উৎসর্গ পত্রে লিখেছিলাম যে জীবনের দুই পিঠ দেখে। আমীরুল অনেক কোলাহলের মধ্য থেকেও নির্জন। পুরনো ঢাকার অধিবাসী হিসেবে একটা পুরনো ঢাকাইয়া মিশ্রিত বচন তৈরি করে নিয়েছে। ছেলেবেলার বন্ধুদেরও ভোলেনি সে। ওর লেখার মধ্যে এসব অনুসঙ্গ নানাভাবে এসেছে। এত কিছুর মধ্যেও সম্পাদনা-প্রযোজনা উপন্যাস ছোটগল্প ও ছড়া রচনা। রাতে ওর ছড়াগুলো পরছিলাম। নানা বিষয় অনুষঙ্গ আর নিরীক্ষা দিয়ে আমীরুলের মনোজগৎ ভরা। আশির দশকে গণমুখী ছড়ার যে নিরীক্ষা সেখানেও আমীরুলের স্পর্শ উজ্জ্বল- নূর হোসেনকে নিয়েও আমীরুলের ছড়া আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে। অন্তঃমিল ছড়াকে প্রাণদায়ী করে কিন্তু মিল ছাড়াও যে ছড়া অভিনব হতে পারে আমীরুল তা প্রমাণ করেছেন। আমীরুলের গদ্যের যে এলিগরি ছড়ায় তা সম্পূর্ণ উল্টো ইমেজ। একটা সুতার মধ্যে আমীরুল তার শব্দগুলো ঝুলিয়ে দেননি। বরং অসংখ্য সুতার মধ্যে আমীরুলের ঝোলানো শব্দগুলো বেছে নিয়ে পাঠককেই তৈরি করতে হয় একটা বক্তব্য। এটা পাঠকের সামনে ছুড়ে দেয়া গেম। পাঠকের মনে হতে পারে সাদামাঠা এ লেখাটা না হলেও চলতো কিন্তু আমীরুলের ছড়ার শেষে কোথাও একটা চিন্তার গিঁঠ থাকে, যা খোলাটা পাঠকের জন্য জরুরি। এক নিরুত্তর ধাঁধার জগৎ প্রয়োজনীয় এবং অনিবার্য। আমীরুল তার ঐতিহ্য কিংবা উত্তরাধিকার ত্যাগ করেননি। তিনি ঐতিহ্যের মধ্য থেকেই ভেঙেছেন কিন্তু সে ভাঙন একরৈখিক নয় , সে ভাঙন ঈশানে অগ্নিতে। দুএকটা উদাহরণ দিলে পাঠক বুঝবেন। আমীরুল জানেন তার পূর্বসূরি সুকান্ত ভট্টাচার্য অন্তঃমিল ছাড়া কিশোর কবিতা লিখেছিলেন- হে সূর্য শীতের সূর্য তুমি উত্তাপ আর আলো দিয়ো ঐ রাস্তার ধারের উলঙ্গ ছেলেটাকে। আমীরুল অনেক তুচ্ছ আটপৌঢ়ে কিন্তু জীবনযাপনের দরকারি বিষয়ে আলো ফেলেছেন। বাংলা ছড়ার বিড়াল পাখি বাঘ সিংহ কত প্রাণীরই না ছোটাছুটি ওর ছড়ার দ্বীপে। কখনও বিড়াল বাঘ হয়ে যাচ্ছে ইঁদুর অজগর, সিংহই হয়তো ইঁদুরে রূপ নিচ্ছে- কিংবা কখনও অবুঝ শিশু হয়ে উঠছে মল্লবীর ছুটে যাচ্ছে পৃথিবীর নানা দেশে। এই যে রূপান্তরের আশ্চর্য অভিবাষণ- তা পরাস্বপ্নের মতো কিন্তু পরাস্বপ্ন নয়- তবে কি তা বাঙালি জাতির মননের অভিব্যক্তির রহস্যময়তা। আমীরুল শেকড় থেকে টেনে তুলেছেন উবজীব্য যেমন একটা ছড়া শিরোনাম- প্রকৃতি
প্রকৃতির সন্তান আমি/ ধরিত্রীর পুত্র, মানব-বন্ধনে আজ/ ছিন্ন ধরি সূত্র।/ প্রকৃতি ও মানুষের/ চলেছে সংগ্রাম।/ বৃক্ষশূন্য প্রকৃতির/ জানি না পরিণাম।
নিজেকে প্রকৃতির পুত্র বলার মধ্যে যে শক্তি ও মরুত প্রয়োজন তা আমীরুলের আছে। বৃক্ষশূন্যতা যে স্বদেশকে শ্মশানতুল্য করে তুলবে তার ভবিষ্যৎদ্বাণী শুনতে পায় এই লেখাটিতে। পাঠক সাম্প্রতিককালের বৃক্ষনিধন ও নানা ঘটনা এই লেখাটির প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করে। শব্দের জ্যামিতি আমীরুল বোঝেন। ছড়া লিখছে শিরোনামের আরেকটি লেখা- চাঁদ উঠছে-উঠুক না/ ফুল ফুটছে-ফুটুক না/ পাখি ডাকছে ডাকুক না-ছড়া লিখছে-লিখুক না। একটা সাবলিলতা। মনে হয় ছোটবেলায় মনের আনন্দে কাঠকয়লা দিতে দেয়ালে লিখছি মনের যত আনন্দময় কথা। তার কি অর্থ? সত্যের আনন্দের যা অর্থ তাইতো। সেই খাঁটি সত্যযা বলতে মানা কিন্তু আমীরুল বলবেনই এমন এক পণ তার- মাছ শিরোনামের ছড়া-
আয়রে আয় ছেলের দল মাছ ধরতে যাই,/ যে পুকুরে ছিপ ফেলেছি মাছ কোথাও নাই।/ মাছ মারতে সবাই মিলে দোলায় চেপে যাবো,/ শূন্য বিল মরা পুকুর মাছ কোথায় পাবো?
এক মরুতুল্য শূন্যতায় আমাদের প্রতিবেশ ধ্বংসোন্মুখ জলশূন্য জলাধার, পুকুর। কোথাও মৎস্য কিংবা মানব প্রয়োজনের উপপাদ্য নেই। আছে সীমাহীন হাহাকার। ধরিত্রী নিজেই বলছে কোথায় পাব তোমাদের পোষণের পণ্য? অসচেতনতাবোধ জাতিকে গ্রাস করছে- তার সাবধান বাণী করেছেন আমীরুল। এই দায়বোধ একজন প্রকৃত লেখকের আত্মা থেকে উৎসারিত- কেউ তাকে শিখিয়ে দেয়নি। এবং আরেক প্রশ্ন নতুন ধাঁধার তৈরি করে- পাকা আপেল না পড়ে তাই/ কাঁঠাল যদি পড়তো জ্ঞানী নিউটন হয়তো তখন/অন্য চিন্তা করতো। কাঁঠাল আপেল সবই মাধ্যকর্ষণ শক্তির টানে পড়ে। নিউটন কাঁঠাল পড়লে এ কথা ভাবতেন কিনা এই বঙ্গে। এই বঙ্গের একজন লেখকের এই ভাবনা কি অমূলোক কোনো কিছুই অমূলোক নয়। ছড়া শুধুই সৌখিন মজদুরী নয়, তার রয়েছে এক বিশাল দায়বোধ। হাজার বছরের ছড়ার আঙ্গিক বদলেছে কিন্তু ইতিহাস তার ধারাক্রম রক্ষা করে চলেছে। নদীর মতো তার গতি পথ- নদী নদী নদীরে/ বইছে নিরবধিরে/ কোথা থেকে নদীর জন্ম/ কোথায় নদীর শেষ/ নদীর সাঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে হলাম নিরুদ্দেশ। প্রকৃত বাঙালি মননের এক দীপ্র উদাহরণ। তরতাজা আর টাটকা বলতে যা বোঝায় সেরকমই। পাঠক ভাববেন এত সহজ ছড়া কিন্তু তাকে এও ভাবতে হবে সহজ কথা বলা সত্যিই তো কঠিন, আমীরুল কি তবে রবীন্দ্রনাথের সেই অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করছেন?
রেজাউদ্দিন স্টালিন

No comments

Powered by Blogger.