মানবিক প্রেমবোধ ও সহমর্মিতা

মানুষের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় জ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেক ও চেতনা দেওয়া হয়েছে, যাতে মহান স্রষ্টাকে চিনতে পারে, ন্যায়ের পথে চলতে পারে এবং জগতে দুষ্কর্মের পরিণতি ও ফলাফল উপলব্ধি করতে পারে। সব ধরনের অনিষ্ট, অকল্যাণ, মন্দ কাজ ও মিথ্যাচার থেকে দূরে থাকে, আর সত্য-সুন্দর ও জনকল্যাণকর কাজকে গ্রহণ করতে পারে। এ জন্যই মানুষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মানসিকতা ও মানবিক প্রেমবোধ দেওয়া হয়েছে। যাতে মানুষ সবার সঙ্গে মিলেমিশে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পারে। মানুষ যদি তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও মানবতাবাদী দর্শন সহমর্মিতাকে কাজে না লাগায়, তবে সে চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও অধম, মানুষ নামের কলঙ্ক! পক্ষান্তরে, মানুষ বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র এবং বিশ্বাসে যতই বিভক্ত থাকুক না কেন, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি,
স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদের উত্তম রিজিক দিয়েছি এবং আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের অনেকের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৭০) মানবজাতিকে সম্মানিত করে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। যে বা যারা বিপথগামী রয়েছে, তাদের ভ্রান্তনীতি, আদর্শ, শিক্ষা অনুসরণ বা অনুকরণ নয়, বরং তাদের শান্তির ধর্ম ইসলামের পথে চলার আহ্বান জানিয়ে কাউকে ঘৃণা, অবহেলা ও অবজ্ঞা করা চলবে না। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে, সে যে পথের বা দলমতের হোক না কেন? এ জন্য যে, দুনিয়ার সব মানুষই পরস্পর ভাই ভাই। তাদের কাজ করতে হবে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নয়। ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই মানুষে মানুষে হূদ্যতা ও সৌহার্দ্য স্থাপনের মাধ্যমে একটি শান্তি ও সমৃদ্ধির পৃথিবী গড়ার তাগিদ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৭৭) প্রেমহীন সমাজে শান্তি অশান্তিতে, ন্যায় অন্যায়ে, নীতি দুর্নীতিতে রূপ নেয়। বিভিন্ন সংগঠন ও দলমতের পারস্পরিক স্বার্থপরতা-শত্রুতা, সন্দেহ-অবিশ্বাস, হিংসা-বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, সন্ত্রাস-সহিংসতা, অস্থিরতা-হানাহানি, ঘুষ-দুর্নীতি—এসব মানবপ্রেমের উল্টো ধারার ফল। মানুষ নিজের কায়েমি স্বার্থসিদ্ধির জন্য কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করেছে নানা বৈষম্যের।
এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে, এক জাতি অন্য জাতিকে, এক ধর্মাবলম্বী ভিন্ন ধর্মের অনুসারীকে পরাভূত করতে এবং দাবিয়ে রাখতে চালু করেছে বর্ণ, গোত্র ও শ্রেণীবৈষম্যের। যে যখনই সুযোগ পেয়েছে, তখনই অন্য দলমতকে দমানোর জন্য অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। কীভাবে তাকে নিচু করা যায়, তার বিভিন্ন কৌশল বের করেছে। এভাবেই সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানুষের মধ্যে চলে আসছে বৈষম্যমূলক আচরণ। বিশেষ করে বর্ণবৈষম্য যুগ যুগ ধরে মানুষে মানুষে সৃষ্টি করেছে সুস্পষ্ট বিভেদ, ফলে জন্ম নিয়েছে অনেক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের। অথচ পবিত্র কোরআনে মানুষকে সাবধান করা হয়েছে, ‘নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, তাহলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’ (সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৬) বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কালে কালে যুগে যুগে বিরোধ, সংঘাত-সংঘর্ষ, এমনকি যুদ্ধবিগ্রহে নিরপরাধ মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এভাবে ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের মহাসংকটে ভুগছে পৃথিবী। দয়া-মায়া নেই জনমনে, মানবপ্রেম নেই মনুষ্যসমাজে! জনগণের প্রতি নির্দয় হওয়া, কষ্ট দেওয়া, অবহেলা করা, নিরীহ মানুষকে জুলুম-নির্যাতন ও হত্যা করার নাম সেবা নয়। মানবকুলের সঙ্গে মনুষ্যরূপী পশুরা জ্বালাও-পোড়াও, যাত্রীবাহী যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, পেট্রলবোমা হামলা এবং নাশকতা চালানোর মাধ্যমে অমানবিক ও পাশবিক আচরণ করেই চলেছে। অথচ আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সৎ কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য; ব্যক্তিস্বার্থে মজে পশুর মতো স্বার্থপর জীবনযাপনের জন্য নয়। যেমনিভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটেছে।’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত: ১১০)
মানুষের ধন-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, ক্ষমতা, বংশ, রূপলাবণ্য আল্লাহ দেখেন না, দেখেন কোন মানবপ্রেমী বান্দা তার সাধ্যানুযায়ী জনসেবা ও মানবের কল্যাণে কাজ করছে। তাই হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান—প্রত্যেক মানুষেরই পারস্পরিক মানবতাবোধ ও উদার নৈতিক মানসিকতা থাকা অপরিহার্য। মানুষের মধ্যে যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর প্রতি প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মহব্বত না থাকে, তাহলে কেয়ামতের কঠিন দিবসে আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার সুশীতল ছায়া থেকে তারা বঞ্চিত হবে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যারা মানুষের ওপর দয়া করে না, আল্লাহ তাদের ওপর দয়া করেন না।’ (বুখারি ও মুসলিম) সুতরাং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সারা বিশ্বের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, প্রেম-প্রীতি সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা উচিত। তাই আসুন, আমরা সচেষ্ট হই, যেন আল্লাহর বান্দা হিসেবে দলমতের ঊর্ধ্বে সব মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে পারি, শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে পারি! বিপদে-আপদে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিই এবং পৃথিবীর কোনো মানুষকে অবহেলা বা অবজ্ঞা না করি! কোনো ধর্ম, জাত, কুল, বংশ নয়; মানুষ নামের ব্যক্তিটিকে যেন হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা, জনসেবা ও সহানুভূতিতে এগিয়ে আসতে সমর্থ হই!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.