'সংখ্যালঘুদের দেশছাড়া করে গণতন্ত্র রক্ষা হবে না'

(সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণী-পেশার মানুষ। এরই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করে) সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে অসহায়ত্বে রেখে বা বিপদে ঠেলে দিয়ে শান্তি ও স্বস্তিতে থাকার কথা যারা ভাবছেন, তাদের ভাবনা সফল হবে না। সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে, তাদের দেশছাড়া করে গণতন্ত্র, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নারকীয় তাণ্ডব রোধে ঐক্যবদ্ধভাবে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। হামলায় জড়িতদের দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালে বিচার করতে হবে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ রাজধানীর কয়েকটি স্থানে বিভিন্ন সংগঠনের মানববন্ধন, বিবৃতি, বিক্ষোভ সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলনে গভীর উদ্বেগ এবং নিন্দা প্রকাশ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতন দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলসহ মানবাধিকার, পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা এসব কর্মসূচিতে অংশ নেন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘুদের বাড়ি ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা, অগি্নসংযোগ ও নির্যাতন প্রতিরোধে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি গ্রহণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মানববন্ধন কর্মসূচিগুলোয় সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়। হামলার প্রতিবাদে ও হামলাকারীদের শাস্তির দাবিতে ১১ জানুয়ারি সারাদেশে কালো পতাকা মিছিল করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এক বিবৃতিতে বলেছে, সংখ্যালঘু নির্যাতন করে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে। সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। হামলাকারীদের দমনে সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আরও বিবৃতি দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ '৭১ ও এর নারী কমিটির সদস্যরা।
নির্বাচনোত্তর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় প্রকৃত ঘটনা চাপা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের। গত চার দিনে দেশে প্রায় আড়াই হাজার সংখ্যালঘু পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলেও জানান পরিষদের নেতারা। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে প্রকৃত ঘটনা আড়ালের চেষ্টা করছে। বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও সরকার এখন পর্যন্ত হামলাকারীদের বিচারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, যুগ্ম সম্পাদক নির্মল রোজারিও, পূজা উদযাপন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত কুমার দেব, কাজল দেবনাথ প্রমুখ। রানা দাশগুপ্ত বলেন, গত ২৫ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে ৩২ জেলায় ৪৮৫টি সংখ্যালঘু বাড়িঘর, ৫৭৮টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ১৫২টি মন্দিরে অগি্নসংযোগ, লুটপাট, ভাংচুর ও গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইন, দ্রুত বিচার আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় মামলা দায়ের এবং দ্রুত গ্রেফতার করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর জামায়াত-শিবিরের নির্যাতন ও লুটপাটের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদসহ কয়েকটি সংগঠন। সকাল ১১টায় মানববন্ধন করে পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ। সংগঠনের সভাপতি সাবেক বিচারপতি এএফএম মেসবাহউদ্দিনের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ড. নূর মোহাম্মদ তালুকদার, অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ, অধ্যাপক মিজানুর রহমান, সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব ড. কামরুল ইসলাম খান প্রমুখ।
সকাল সাড়ে ১০টায় উন্নয়ন কর্মীদের প্লাটফর্ম নামের একটি সংগঠন সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। এর কিছুক্ষণ পর একই দাবিতে ওই মানববন্ধনে যুক্ত হয় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। দুপুর আড়াইটার দিকে মানববন্ধন করে বাংলাদেশ ছাত্র যুব ঐক্য পরিষদ ও মহিলা পরিষদ। মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানমের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তারা সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। বক্তব্য রাখেন মালেকা বানু, সীমা মোসলেম, রাখী দাস, মাসুদা রোহানা বেগম, রেহানা ইউসুফ প্রমুখ। মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ। সকালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সংগঠনের সভাপতি এমএ মজিদের সভাপতিত্বে মানববন্ধন ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নারকীয় তাণ্ডব দমনে সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের সভাপতি একেএমএ হামিদ ও সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমান, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মৈত্রী পরিষদের চেয়ারম্যান অরুণ সরকার রানা, গণসংস্কৃতি ফ্রন্টের সভাপতি হায়দার আনোয়ার খান জুনো ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান লালটু, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক অধ্যাপক আবদুস সাত্তার।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় :নির্বাচনোত্তর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) মানবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অধ্যাপক ড. সেলিমের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে অধ্যাপক মো. সেলিম ভূঁইয়া, মো. ওহিদুজ্জামান, একেএম আক্তারুজ্জামান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এ সময় যশোরে নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহ করা হয়।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে-মন্দিরে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে 'সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ব্রিগেড'। গতকাল শাহবাগে আয়োজিত সমাবেশ ও লাঠি মিছিল কর্মসূচি থেকে এ আহ্বান জানানো হয়। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি এবং '৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক কামাল লোহানীর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক এএন রাশেদা, জামসেদ আনোয়ার তপন, দৈনিক সমকালের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, হাসান তারেক, জনার্দন দত্ত নান্টু, তানভীর রুসমত, শামসুল ইসলাম সুমন, ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, মানবেন্দ্র দেব, অভিনু কিবরিয়া ইসলাম প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইকবালুল হক খান।
বিএফইউজে-ডিইউজে :সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনাকে পূর্বপরিকল্পিত বলে দাবি করেছেন বিএনপি ও জামায়াতপন্থি সাংবাদিক নেতারা। তারা বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশের জনগণ ও বিদেশিদের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর এসব হামলা চালানো হচ্ছে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) আয়োজিত মানববন্ধনে নেতারা এসব কথা বলেন। রুহুল আমিন গাজীর সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন শওকত মাহমুদ, ইলিয়াস খান, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, কাদের গণি চৌধুরী প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.