নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা চলছেই, আহত শতাধিক

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় নোয়াখালীর হাতিয়া, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, ঝিনাইদহ এবং খাগড়াছড়ির পানছড়ি ও মানিকছড়িতে শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। এসব এলাকায় বহু বাড়িঘরে ভাংচুর ও লুটপাট চালায় প্রতিপক্ষের লোকজন। এর মধ্যে হাতিয়ার পরিস্থিতি ভয়াবহ। এখানে বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থী আয়েশা ফেরদৌসের সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আমিরুল ইসলাম আমিরের সমর্থকদের ওপর হামলা চালিয়েছে। বিজয়ী প্রার্থীর নেতাকর্মীদের মারধরের ভয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর দু'শতাধিক নেতাকর্মী বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বাগেরহাট-৪ আসন মোরেলগঞ্জে আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী ডা. মোজাম্মেল হোসেন সমর্থকরা হামলা চালিয়েছে। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর দু'শতাধিক নেতাকর্মী বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ ছাড়াও তারা হামলা চালিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. আবদুর রহিম ও মেয়র মনিরুল ইসলামের লোকজনের ওপর। এখানে আহত হয়েছেন ২০ জন। স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীও আওয়ামী লীগ নেতা। ঝিনাইদহ সদরে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকী ও পরাজিত প্রার্থী শফিকুল ইসলাম অপুর সমর্থকদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ২৫ জন। পাবনায় স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যাপক আবু সাইয়িদের ৭ সমর্থকের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
হাতিয়া (নোয়াখালী) :নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আয়েশা ফেরদৌস জয়ী হওয়ায় তার সমর্থকরা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাত্রলীগের সাবেক
ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আমিরের সমর্থকদের ওপর হামলা চালিয়েছে এবং তাদের ঘরবাড়ি ভাংচুর করেছে। এ সময় বিভিন্ন স্থানে হামলা-সংঘর্ষে আহত হয় ৫০ জন। হামলাকারীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিও। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী অফিস, বাড়িসহ সমর্থকদের ২০টি বাড়িঘর ভাংচুর করেছে। এছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরেও হামলা চালানো হয়েছে।
রোববার রাতে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে উপজেলার চরঈশ্বর ইউনিয়নের বাংলাবাজার, নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন, জাহাজমারা ইউনিয়ন, বুড়িরচর ইউনিয়ন, চরঈশ্বর ইউনিয়ন, তমরদ্দি ইউনিয়ন, নলচিরা ইউনিয়নসহ উপজেলার বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে তাণ্ডব অব্যাহত রয়েছে বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে। সন্ত্রাসীদের আক্রমণের ভয়ে এসব এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিরুল ইসলাম আমিরের প্রায় ২শ' নেতাকর্মী-সমর্থক বাড়ি ছাড়া রয়েছেন। তারা মনপুরা, ভোলা ও সন্দ্বীপে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে তাদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়।
জানা গেছে, নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরপরই উপজেলার আফাজিয়া বাজারের ছাত্রলীগের আঞ্চলিক কার্যালয়ে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী আয়েশা ফেরদৌস ও তার স্বামী মোহাম্মদ আলীর নেতাকর্মীরা। এ সময় কার্যালয়ে টানানো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ভাংচুর করা হয়।
সোমবার রাতে উপজেলার চরকিং ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা ও ইউপি সদস্য মনির উদ্দিনের ভৈরব বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো। এ সময় তার দোকান থেকে তিন লক্ষাধিক টাকার মালপত্র লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় নারী, শিশুসহ কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়।
একই দিন উপজেলার সোনাদিয়া ইউনিয়নের চরচেঙ্গা বাজারে বীমাকর্মী ও যুবদল নেতা রফিকুল ইসলামের অফিস, বাড়িসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একাধিক বাড়িঘরে আক্রমণ ও হামলা চালায় ফেরদৌসের ক্যাডাররা।
নড়াইল : নড়াইল-২ আসনে পরাজিত প্রার্থীর তিন সমর্থককে মারধর ও জখম করেছে বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থকরা। সদরের বাঁশগ্রাম ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ভোটের ফল প্রকাশিত হওয়ার পরদিন সোমবার সকাল ১০টার দিকে বাঁশগ্রাম বাজার থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী কলস প্রতীকের সমর্থক মনি মণ্ডল (৩০) এবং সন্ধ্যার আগে নান্নু মোল্যা (৪৫) ও বারেক মোল্যাকে (৩৫) নৌকার সমর্থকরা বেধড়ক পেটায় ও লোহার রড দিয়ে জখম করে। তিনি জানান, এলাকায় নৌকার সমর্থকরা প্রতিপক্ষকে মারার জন্য লাঠি, দা নিয়ে সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছে।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ভোট দেওয়ার অপরাধে মা ও ছেলেকে পিটিয়ে আহত করেছে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা। গতকাল সকাল ১১টার দিকে সীতাকুণ্ড পৌর সদরের পূর্ব আমিরাবাদ নিয়াজীবাড়ির সামনে এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত নেতা তৌহিদুল আলম, জালাল, রুবেল, মিনহাজের নেতৃত্বে ৩০-৪০ জন কর্মী নিয়াজীবাড়ির সামনে আওয়ামী লীগ কর্মী জিকুর ওপর হামলা চালায়। এ সময় মা তাকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলে তার ওপরও হামলা চালায় তারা।
ঝিনাইদহ : শহরের কালিকাপুরে নৌকার সমর্থকদের মধ্যে হায়দার আলী, কওসার এবং দুলালের দোকান, বাড়িসহ ৫-৬টি বাড়ি ভেঙে দিয়েছে প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজন। এর আগে সংঘর্ষে কালিকাপুরে নাজিরুল ইসলাম, শরিফুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম, আবু বকরসহ ১০ জন আহত হন। জেলায় বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন আরও ১৫ জন। এর মধ্যে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ১০ জন ভর্তি হয়েছেন।
নওয়াপাড়া :যশোরের অভয়নগর উপজেলার জামায়াতের আমির মাওলানা আবদুল আজিজের বাড়িসহ সাতটি বাড়িতে ভাংচুর ও লুটপাট করেছে দুর্বৃত্তরা। মঙ্গলবার ভোররাতে উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ও চাপাতলা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
সুনামগঞ্জ/ধর্মপাশা : জেলার ধর্মপাশায় নির্বাচনী সহিংসতায় উপজেলা বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী ভুট্টো আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার বিকেলে ধর্মপাশার বাদশাগঞ্জ বাজারে যুবলীগ কর্মী সবুজ ও দোলা মিয়ার নেতৃত্বে ১০/১২ জন তাকে মারধর করে। তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর) :মঠবাড়িয়ায় সোমবার গভীর রাতে সূর্যমণি গ্রামে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শাখাওয়াতের দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
মাগুরা/শ্রীপুর :শ্রীপুর উপজেলার বরিশাট গ্রামে পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী কুতুবউল্লাহ হোসেন মিয়ার সমর্থকরা মঙ্গলবার সকালে প্রতিপক্ষ বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রফেসর ডা. সিরাজুল আকবর এমপির সমর্থকদের আটটি বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুট করেছে।
নেত্রকোনা :জেলার কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারিছ আহমদ তালুকদারের বাড়ির একটি ঘরে সোমবার মধ্যরাতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
পাবনা :বেড়া উপজেলার বৃশালিখা গ্রামে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদের সাত সমর্থকের বাড়িঘর ভাংচুর ও এক মুক্তিযোদ্ধাকে মারধর করেছে। সোমবার সকালে ১০/১২ জনের একদল সন্ত্রাসী তাদের ওপর হামলা চালায়।
মোরেলগঞ্জ (বাগেরহাট) :বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনে সোমবার নির্বাচনোত্তর সহিংস হামলায় খাউলিয়া ইউনিয়নে ১০ জন গুরুতর জখম হয়েছেন। এর আগে রোববার রাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. আবদুর রহিম খান ও মেয়র মনিরুল হক তালুকদারের নির্বাচনী অফিস, গাড়ি ও বাসভবনে হামলার ঘটনায় আরও ১০ জন আহত হন। নৌকার বিজয়ের খবর আসা শুরু করলে ছাত্রলীগের একটি অংশ মিছিলসহকারে হামলা ও ভাংচুর শুরু করে। সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা তাদের প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী ও সমর্থকদের ওপর একের পর এক হামলা চালায়।
খাগড়াছড়ি :নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলায় ১১ জন আহত হন।
জানা গেছে, ভোট দেওয়ার অপরাধে সোমবার সন্ধ্যায় পানছড়িতে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বেশক'টি ঘরবাড়িতে হামলা চালায় বিএনপি-ছাত্রদল কর্মীরা। হামলাকারীরা পাইলট ফার্ম এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থক খায়রুল আলমের বাসায় ব্যাপক লুটপাট চালিয়ে ৭ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা, টেলিভিশন এবং আসবাবপত্র নিয়ে যায়। হামলাকারীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাননি তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মাছুমা বেগম এবং মা নুরনাহার বেগম।
এ সময় বিএনপি ক্যাডারদের হামলায় আওয়ামী লীগের ৯ নেতাকর্মী আহত হন। পাল্টা হামলায় বিএনপি ও ছাত্রদলের ২ নেতা আহত হন।
সিরাজগঞ্জ :ভোট দানে বাধা দেওয়ার জের ধরে সিরাজগঞ্জের বেলকুচির চন্দগাতীতে আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা মঙ্গলবার দুপুরে বিএনপির ৩ কর্মীকে পিটিয়ে আহত করেছে। তারা হলেন_ বেলকুচি উপজেলা সদরের চন্দনগাতী ৫নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, পৌর যুবদল কর্মী মাসুদ রানা ও হোসেন আলী।
বেলকুচির তামাই গ্রামে যুবলীগ নেতা আলমের বাড়িতে সোমবার রাতে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারায় আসবাবপত্র ও তাঁতসামগ্রী পুড়ে গেছে।
মানিকছড়ি (খাগড়াছড়ি) :মানিকছড়ির বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ-বিএনপিকর্মীদের মধ্যে পৃথক সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন। উপজেলার তিনটহরী বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

No comments

Powered by Blogger.