বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ by মাসুদ করিম

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে হতাশ বিশ্ব সম্প্রদায়। সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিলম্বে সংলাপ চান তারা। সরকারের ওপর এ জন্য চাপ বাড়ছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, সমঝোতার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে দ্রুত নতুন নির্বাচন করতে না পারলে বিনিয়োগ বন্ধসহ বিদেশি চাপ আরও বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দিনক্ষণ উল্লেখ না করে 'যত তাড়াতাড়ি সম্ভব' বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে। নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকায় ভোটের আগেই পশ্চিমা বিশ্ব নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। একমাত্র ভারতই ছিল ব্যতিক্রম।
দশম সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও জাপান প্রতিক্রিয়া জানালেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইইউ কী প্রতিক্রিয়া দেয় তাই হবে বিশেষ লক্ষণীয়। কেননা ইইউ বাংলাদেশকে যে ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকে তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পালনীয় শর্ত রয়েছে। ইইউ ওই সব শর্ত বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার ইইউ। সেখানে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ী সমাজও উদ্বিগ্ন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার সমকালকে বলেছেন, '৫০ ভাগের বেশি আসনে ভোট ছাড়াই নির্বাচন হয়ে গেছে। এটা সংবিধান পরিপন্থী। ১৪৭ আসনে ভোট হলেও মানুষ আসেনি। এটা বিদেশিদের না জানার কারণ নেই। ফলে এ নির্বাচনকে তারা গ্রহণযোগ্যতা দিচ্ছে না, বৈধতা দিচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকেই এ নির্বাচনকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছে। ভারতও অভিনন্দন জানায়নি। ভারতের সঙ্গে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিশেষ সম্পর্ক থাকার কারণে তারা সরাসরি কিছু বলেনি। তবে অভিনন্দন না জানিয়ে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। ফলে যত তাড়াতাড়ি সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে সবার অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচন দেওয়া যায় ততই মঙ্গল।' অধ্যাপক ইমতিয়াজের আশঙ্কা, সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন না দিলে বিনিয়োগ বন্ধ করাসহ কঠিন চাপ দিতে পারে বিশ্ব সম্প্রদায়। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে 'নিষ্ফল নির্বাচন' হিসেবে অভিহিত করেন। গতকাল তিনি সমকালকে বলেছেন, আন্তর্জাতিক মহলের কাছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেল। নির্বাচন নিয়ে তাদের হতাশা প্রকাশের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়েছে। তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চান। তিনি এও বলেন, ভারত নির্বাচনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও এখন সে অবস্থানেরও পরিবর্তন হচ্ছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপ-মুখপাত্র মেরি হার্ফ বলেছেন, 'বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনে যাতে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে তার উপায় খুঁজে বের করতে দ্রুত সংলাপে বসায় উৎসাহিত করি।' প্রায় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায় কানাডা। তবে এসব প্রতিক্রিয়ায় একাদশ জাতীয় সংসদের লক্ষ্যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের যে কথা বলা হচ্ছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমার উল্লেখ নেই।
নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে প্রতিবেশী ভারতের অবস্থানের কিছুটা ভিন্নতা লক্ষণীয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভারত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সোমবার দিলি্লতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিন যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে এ নির্বাচনকে একটি 'সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার লিয়াকত আলী চৌধুরী সমকালকে বলেছেন, 'পশ্চিমা বিশ্ব শুধু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতিই অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। এদেশে ভারতের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। এই বিবেচনায় প্রতিবেশী এ দেশটি সব সময়েই অংশগ্রহণের চেয়েও সাংবিধানিক ধারার প্রতি যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে আসছে, নির্বাচনের পরও প্রায় একই অবস্থানে ধারাবাহিকতা বহাল রেখেছে।' সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি :রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, যুক্তরাজ্য, কানাডা, কমনওয়েলথসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যে সব প্রতিক্রিয়া এসেছে তারা প্রায় সবাই সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিবৃতিতে বলেছে, চলমান রাজনৈতিক সংকটে যে সহিংসতার সৃষ্টি হচ্ছে তাকে কঠোরতম ভাষায় নিন্দা জানাই। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়। সকলকে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানাই। জাপানের বিবৃতি :জাপানের রাষ্ট্রদূত শিরো সাদোশিমা গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সব ধরনের সহিংসতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনগণকে তাদের পছন্দ বেছে নিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
নতুন নির্বাচন চায় অস্ট্রেলিয়া :অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপ বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সহিংসতা ও রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নতুন নির্বাচন করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ে দায়ী। নির্বাচন সাংবিধানিকভাবে বৈধ হলেও অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। অস্ট্রেলীয় সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নিন্দা এবং সকল পক্ষকে সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানায়। অস্ট্রেলীয় সরকার নতুন করে সহিংসতার আশঙ্কায় তার দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে ভ্রমণের পরিকল্পনা পুনরায় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.