শেষ নিদ্রায় 'কালো চিতা'

লিসবনের রাস্তায় তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল প্রায় দশ হাজার শোকাতুর প্রাণ। বেনফিকার লাল-সাদা পতাকায় মোড়ানো কালো কফিনবাহী গাড়িটি গোচরে আসতেই ভিড়ের মধ্যে উঠল চিৎকার_ 'ও রেই ও রেই'। অর্থাৎ 'রাজা'। পর্তুগাল ফুটবলের মুকুটহীন সম্রাটকে সোমবার হৃদয়ের সব ভালোবাসা নিবেদন করেই চিরবিদায় জানালেন সমর্থকরা। এডসন অরান্তেস দো নাসিমেন্তো উঠে এসেছিলেন চরম দারিদ্র্য থেকে। পরে গোটা দুনিয়া তাকে চিনে নেয় 'পেলে' নামে। ইউসেবিও দ্য ফেরেইরার গল্পটাও একইরকম। আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশ মোজাম্বিক থেকে উঠে এসে তিনি দখল করেছেন ফুটবলের 'সর্বকালের সেরা'দের আসন। ছেষট্টি বিশ্বকাপের সেই অবিসংবাদিত নায়ক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোববার চলে যান না ফেরার দেশে। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে পর্তুগাল। ফুটবলপ্রীতির জন্য এমনিতেই পর্তুগালের আরেক নাম 'ইউরোপের ব্রাজিল'। সেই মুলুকের 'রাজা'কে চিরবিদায় দেওয়ার আগে যথার্থ সম্মানটাই ঢেলে দিল পর্তুগিজরা। সমর্থকদের কথা মাথায় রেখে ইউসেবিওর মরদেহ বহন করে নিয়ে যাওয়া হয় বেনফিকার মাঠ 'স্টেডিয়াম অফ লাইট'-এ। আগে থেকেই গ্যালারিতে অপেক্ষায় ছিলেন সমর্থকরা। মাঠের মাঝখানে সোনালি বেদির ওপর রাখা হয় ইউসেবিওর মরদেহবাহী কফিন। কয়েক মিনিট পর কফিনটি নিয়ে গোটা স্টেডিয়াম একবার চক্কর দেওয়া হয়। লাউড স্পিকারে বেজে ওঠে ইতালিয়ান শোকগীতি 'কত তে পারতিও' (এখন বিদায় জানানোর সময়)। সমর্থকরা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখান ইউসেবিওর নিথর দেহকে। একসময় ওই দেহটার চকিত গতিতে রক্ত ছলকে উঠত পর্তুগিজদের। কিন্তু চিরবিদায় জানাতে গিয়ে চোখ মুছেছেন অনেকেই। যদিও বৃষ্টিতে তা বোঝার উপায় ছিল না। সমর্থকদের চোখের অশ্রু ধুয়েমুছে দিয়েছে প্রকৃতির কান্না।
ইউসেবিওর শেষকৃত্যানুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে টিভিতে। পর্তুগালের হিসাব অনুযায়ী প্রায় দশ লাখ মানুষ টিভিতে দেখেছে ইউসেবিওর শেষকৃত্যানুষ্ঠান। স্টেডিয়াম থেকে লিসবনের রাস্তা দিয়ে কফিনটি নিয়ে যাওয়া হয় পাশেই অবস্থিত গির্জা সেমিনারি চার্চে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো পাসোস কোহেলা এবং প্রেসিডেন্ট কাভাকো সিলভা। সব আচার-অনুষ্ঠান শেষে লুমিয়ের সমাধিক্ষেত্রে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দেওয়া হয় ফুটবলের অসাধারণ এক গল্পের বাহককে।
ছেষট্টির বিশ্বকাপে পর্তুগালকে একাই সেমিফাইনাল পর্যন্ত তুলেছিলেন ইউসেবিও। তার চেয়েও বড় কীর্তি কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে খেলার ২৫ মিনিটের মধ্যে ০-৩ গোলে পিছিয়ে পড়ে পর্তুগাল, সেই ম্যাচ জেতে ৫-৩ ব্যবধানে! অসম্ভবটা সম্ভব হয়েছিল শুধু ইউসেবিও হ্যাটট্রিক করায়। ক্লাব ফুটবলে বেনফিকাকে তিনি উপহার দিয়েছেন একটি যুগ। পর্তুগিজ ক্লাবটি সর্বশেষ ইউরোপসেরার মুকুট জিতেছিল ইউসেবিওর হাত ধরে (১৯৬২)। গোটা ফুটবল ক্যারিয়ারে ৭৪৫ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ৭৩৩ গোল। পেলে, বেকেনবাওয়ার, পুসকাস, ত্রুক্রয়েফদের সমতুল্য খেলোয়াড়টির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বেনফিকার বর্তমান কোচ হোর্হে জেসাস_ 'এখন যেমন মেসি-রোনালদো, তখন ছিলেন ইউসেবিও। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন অন্য গ্রহের ফুটবলার। বেনফিকার চিরকালীন রূপকথা।'

No comments

Powered by Blogger.