আম আদমি পার্টি: ইন্দ্রপ্রস্থে নতুন হাওয়া

অরবিন্দ কেজরিওয়াল
২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস। প্রতিবেশী ভারতের পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। খুব কাছাকাছি আছে লোকসভা নির্বাচনও। তাই সে বিধানসভার নির্বাচনগুলোকে লোকসভা নির্বাচনের একটি মহড়া হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে। ঔৎসুক্য ছিল দেশ-বিদেশে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল কংগ্রেস ও বিজেপি। কিন্তু দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে একটি তৃতীয় শক্তির আকস্মিক অভ্যুদয় সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। মাত্র এক বছর আগে দলটি গঠিত হয়েছে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও কংগ্রেস সদস্যদের সমর্থনে তারা সরকার গঠন করেছে দিল্লিতে। দলটির নাম আম আদমি পার্টি। নামের অর্থ বিশ্লেষণের আবশ্যকতা নেই। সবাই সহজে বুঝতে পারেন এ ধরনের নাম। দলের নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি পরাজিত করেছেন পর পর তিন দফায় নির্বাচিত দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী, সৎ রাজনীতিক বলে পরিচিত শীলা দীক্ষিতকে। কংগ্রেস কার্যত নগণ্যসংখ্যক আসন পেয়েছে। বিজেপি আম আদমির চেয়ে তিনটি আসন বেশি পেলেও সরকার গঠনের সুযোগ পায়নি; বিরোধী দলে অবস্থান নিয়েছে। এ ধরনের নির্বাচন তো হামেশাই হয়। জয়-পরাজয়ও ঘটে অনেক রথী-মহারথীর। তবে এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচন শুধু গতানুগতিক জয়-পরাজয়ের নির্বাচন ছিল না।
এর মাধ্যমে দিল্লিবাসী একটি কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছে বৃহৎ দলগুলোকে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলকে। সেটা দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বার্তা। আরও জানান দিয়েছে, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগণকে উপেক্ষা করে পাটিগণিতের হিসাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিচার করলেই শুধু হবে না, সে প্রবৃদ্ধির অংশীদার আমজনতাকে করতে হবে। এদের চাওয়া-পাওয়া শাসনব্যবস্থায় প্রতিফলিত হতে হবে সুস্পষ্টভাবে। ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার দীর্ঘদিন ধরে। সরকারও নির্বিকার ছিল, এমনটি বলা যাবে না। তবে তা প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। তাই দাবি ওঠে শক্তিশালী কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে লোকপাল নিয়োগের। এ নিয়ে গান্ধীবাদী নেতা আন্না হাজারে ২০১১ সালে একাধিকবার গণ-অনশন করেছিলেন। কেজরিওয়ালও শরিক ছিলেন এতে। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছিল। তাদের দুর্দশা লাঘবে দিল্লির রাজ্য সরকার তেমন নজর দেয়নি। সেসব চাহিদা পর্যালোচনা করেই সমাধানের একটি প্যাকেজ নিয়ে এগিয়ে এলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। গঠন করলেন আম আদমি পার্টি। রাজনীতির জগতে অজ্ঞাত কেজরিওয়াল শুরুতে ছিলেন ভারতীয় রাজস্ব বিভাগের একজন কর্মকর্তা। এখন তাঁর বয়স ৪৫। ২০০৬ সালে যুগ্ম কর কমিশনার হিসেবে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। এর আগে লিয়েনে গিয়ে ‘পাবলিক কজ রিসোর্স ফাউন্ডেশন’ নামে একটি এনজিও গড়ে তোলেন। সুশাসনের জন্যই ছিল এর প্রচেষ্টা।
জন লোকপাল বিলের একটি খসড়া তৈরি করে তা পাস করার জন্য দাবি জানাতে থাকে। তথ্য অধিকার আইন তৃণমূল পর্যায়ে প্রয়োগের জন্যও প্রবল চালিয়ে ব্যাপক সাফল্য পায়। বিষয়টি নজরে আসে দেশ-বিদেশের অনেকের। কেজরিওয়াল লাভ করেন এশিয়ান নোবেল খ্যাত র‌্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার। সে পুরস্কারের টাকাটিও তিনি দান করে দেন ওই এনজিওকে। দিল্লিবাসীর জন্য আম আদমি পার্টির প্রতিশ্রুতি ছিল, রাজ্যের দুর্নীতি প্রতিরোধে জন লোকপাল নিয়োগ দেবে। তাদের জন্য কিছু আর্থিক সহায়তার ঘোষণাও দেয় দলটি। যেমন, কোনো পরিবারের মাসে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল ৫০ শতাংশ কমানো, দৈনিক ৭০০ লিটার পানি বিনা মূল্যে সরবরাহ। সে পানি থেকে বস্তিবাসী ও অবৈধ স্থাপনায় বসবাসকারীরাও বঞ্চিত হবে না বলে ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া সরকারি স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালের সংখ্যা ও মান বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও তাদের রয়েছে। জনপরিবহন, পরিবেশসহ সামাজিক খাতেও ব্যাপক গণমুখী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা রয়েছে তাদের। তারা মূলত তরুণ। লড়াই করেছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে। কিন্তু দিল্লিবাসী আস্থা রেখেছে তাদের ওপরেই। তারাও ক্ষমতা গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যে পানি আর বিদ্যুৎ খাতে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন শুরু করেছে। কেউ কেউ এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে দিল্লি রাজ্য সরকারের সক্ষমতা সম্পর্কে সন্দিহান। এভাবে গণভর্তুকি চালু করলে উন্নয়নমূলক কাজ থমকে যেতে পারে বলেও কারও কারও আশঙ্কা।
এসব সন্দেহ-আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে শুধু প্রবৃদ্ধির হার দেখিয়েই জনগণের আস্থা দীর্ঘকাল ধরে রাখা যায় না। তাদের কর্মসংস্থান আর ন্যূনতম চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে আয়ের ব্যবস্থাও করতে হবে। আর ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ভর্তুকিও একেবারে অগ্রহণযোগ্য বলা যাবে না। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোও পরোক্ষভাবে তা দিয়ে থাকে। সুতরাং কেজরিওয়াল বিনা মূল্যে কিছু পানি আর স্বল্পমূল্যে সীমিত বিদ্যুৎ দিলে দিল্লির রাজ্য সরকার দেউলিয়া হয়ে যাবে, এমনটা আশঙ্কা যথোচিত নয়। দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য তো তেমন টাকাপয়সার দরকার হয় না। প্রয়োজন সদিচ্ছা, দৃঢ়তা, কার্যকরী আইন ও প্রতিষ্ঠান। দিল্লি রাজ্য সরকার পরিচালনার জন্য আম আদমি পার্টি যেসব কর্মসূচি দিয়েছে, তার কিছু কিছু সাফল্যের মুখ না-ও দেখতে পারে। কিছু থেকে যেতে পারে অসম্পূর্ণও। দিল্লির শাসনভার কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের যৌথ দায়িত্ব। তদুপরি অধীনস্থ স্থানীয় সরকারগুলোর সদিচ্ছাও এখানে প্রয়োজনীয়। আম আদমি পার্টি নিজেদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা থেকেও ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কিছুটা সরে আসতে হতে পারে। ইতিমধ্যে দু-একটি ক্ষেত্রে তা হয়েছেও। মুখ্যমন্ত্রী সরকারি বাসভবন নিতে সম্মতি দিয়েছেন। কাজের সুবিধা ও নিরাপত্তার জন্য সরকারি গাড়ি ও বাড়ি আবশ্যক। এর অপব্যবহার না হলেই জনগণ সন্তুষ্ট থাকবে। মূলত তরুণদের সমন্বয়ে আর তরুণ নেতৃত্বে দলটি গঠিত, তাদের বক্তব্য কিছুটা আবেগাশ্রয়ী হতে পারে।
বাস্তবতার চাপে সময়ান্তরে আবেগ দূরীভূত হবে। প্রকৃত কার্যক্রম পরিচালনায় সুশাসনের অঙ্গীকারটিকে সর্বোচ্চে স্থান দিয়ে জনকল্যাণকর কার্যক্রম অব্যাহত রাখলে কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতাও জনগণ মেনে নেবে। আর তা করতে সক্ষম না হলে বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়। দিল্লির জনসংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ। আয়তন প্রায় দেড় হাজার বর্গকিলোমিটার। এতে বেশ কয়েকটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত দিল্লিকে বলা হয় ‘সিটি অব সিটিজ’। নগরটির অনেক সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। মহাভারতের যুগে ইন্দ্রপ্রস্থ নামে পাণ্ডবদের রাজধানী এখানেই ছিল বলে মনে করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে আবার ইতিহাসের শিরোনামে আসে নগরটি। সম্রাট অশোকের সময়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের সঙ্গে গাঙ্গেয় সমভূমির সংযোগ হতো এ নগরের মাধ্যমে। এর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক দিকও বিকাশ লাভ করতে থাকে তখন থেকে। শাসক পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। ১১৯২ সালে পৃত্থিরাজ চৌহানকে হটিয়ে আফগান শাসক মোহাম্মদ ঘুরী দখল করেন দিল্লি। তার আগ পর্যন্ত দিল্লি বিভিন্ন হিন্দু রাজবংশের শাসনাধীন ছিল। তুর্কিস্তানের জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ১৫২৬ সালে দিল্লি দখল করে প্রতিষ্ঠা করেন মোগল সাম্রাজ্য। ১৮৫৭ সালে এটা যায় ইংরেজদের দখলে। ১৯১১ সালে তারা ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করে।
এ নগরটি যুগে যুগে দখল, ধ্বংস ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এখনকার যুগে তা হওয়ার কথা নয়। তবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উত্থান আর দিল্লি রাজ্য সরকার দখল কিন্তু আধুনিক সংজ্ঞায় রাজধানী দখল। এটা ঘটেছে গণতান্ত্রিক পন্থায় আর ভোট নামক অস্ত্রে। এটা সবারই জানা, রাজধানী জয় করেই কোনো বিজয়ী শাসক থেমে থাকেন না। তিনি তাঁর সীমা ছড়িয়ে দিতে চান। অতীতে দিল্লি জয় করে অবশিষ্ট ভারতের দিকে নজর দিয়েছেন বিভিন্ন নৃপতি। সাফল্য আর ব্যর্থতা দুটোই জুটেছে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে। ঠিক তেমনি আম আদমি পার্টি আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা করেছে। দিল্লি রাজ্য সরকার পরিচালনায় তারা সাফল্যের ছাপ রাখতে পারলে, এবারে না হলেও ভবিষ্যতে তারা লোকসভায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াতে পারবে। এমনকি অসম্ভব হবে না ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দখলও। ইন্দপ্র্রস্থে আজ যে নতুন হাওয়া বইছে, তা অদূর ভবিষ্যতে বর্তমান সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা ভারতে। এমনকি পার্শ্ববর্তী কোনো কোনো দেশের রাজনীতিতেও এর ইতিবাচক গুণগত দিক প্রভাব ফেলতে পারে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.