মধ্যবর্তী নির্বাচন দুই বছর পর? by শাহেদ চৌধুরী

'মধ্যবর্তী' নির্বাচন কবে হবে? নাকি নতুন সরকারই যে কোনো প্রতিকূলতার মুখেও পাঁচ বছরই দেশ পরিচালনা করবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে কিছুটা ধোঁয়াশা বজায় রেখেও একটি বার্তা দেশবাসীকে দিয়েছেন_ তা হলো 'ধৈর্য ধরুন'। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী সব হিসাব-নিকাশের পর নিশ্চিত হয়েছেন যে, জামায়াতের সহিংসতা পুঁজি করেও বিএনপি সরকারকে দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাধ্য করার শক্তি সঞ্চয়ের সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী গতকালও বিএনপির উদ্দেশে বলেছেন, সহিংসতা বন্ধ করুন, নইলে কঠিন শাস্তি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর এই ধমকে যে বিএনপি ভয় পাবে, তা কেউই মনে করে না। বিএনপি গতকালই হরতালের মেয়াদ আরও ১২ ঘণ্টা বাড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণ এহেন বাস্তবতায় নতুন করে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে বিশ্ব সম্প্রদায়। দেশের অধিকাংশ মানুষের মতো তারাও মনে করে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন একতরফা হয়েছে, ভোটারবিহীন হয়েছে। এতে জনমতের সত্যিকার প্রতিফলন ঘটেনি। তাই তারা সকলকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের প্রতি চাপ দিচ্ছে। তারা চায়, দ্রুত উভয় পক্ষই আলোচনায় বসে নতুন নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করুন। জাতিসংঘের মহাসচিব সোমবার একই বার্তা দিয়েছেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ শীর্ষ নেতা খুব দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে নন। সহিংসতা বন্ধ ও জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে আলোচনায় বসার প্রধানমন্ত্রী যে আহ্বান জানিয়েছেন, তার সঙ্গে সহমত পোষণ করছেন দলীয় নেতারা। তাদের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর এই ডাকে দ্রুত সাড়া পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা কম। নতুন সরকারের মেয়াদ দু'বছর পর্যন্ত হতে পারে বলেও তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৪ জানুয়ারির আগেই নতুন সরকার গঠন করতে চান। গতকাল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয়ই অবহিত করেছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির একাধিক নেতা সমকালকে বলেছেন, তাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ৬ জানুয়ারিই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যতই নির্যাতন নেমে আসুক, তিন শর্ত পূরণ না হলে তারা আলোচনায় যাবেন না। গতকালই দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জেল-জুলুম অগ্রাহ্য করেই তারা বড় আন্দোলন করে নতুন সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে থাকার দিবাস্বপ্ন চূর্ণ করে দেবেন বলে দলীয় নেতারা সমকালকে জানিয়েছেন।
এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি সমঝোতায় না এলে মেয়াদ পূর্ণ করেই ক্ষমতা ছাড়বে নতুন সরকার।
আওয়ামী লীগ ও সমমনা রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা সমকালকে জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ার আগ পর্যন্ত হার্ডলাইনে থাকবে সরকার। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় কার্যকর করা হবে। জনগণের সহানুভূতি পেতে প্রতিষ্ঠা করা হবে সুশাসন। এ জন্য সময় নেওয়া হবে দুই বছর। এই সময়ের মধ্যে সংলাপে সমঝোতা হলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে এগোবে সরকার। সমঝোতার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। এ জন্য নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর কথাও ভাবা হচ্ছে।
মধ্যবর্তী নির্বাচন প্রসঙ্গে এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাননি ডাকমন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেছেন, সবেমাত্র নির্বাচন হলো। এখনই মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রশ্ন আসছে কেন? তিনি আরও বলেছেন, 'ধৈর্য ধরুন। সংলাপ হবে।'
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, বিএনপি সহিংসতা ও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লে সংলাপ হবে। সেই সংলাপে সমঝোতা হলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, পরবর্তী নির্বাচনের জন্য সংলাপে বসতে সরকার প্রস্তুত। কিন্তু এর আগে সহিংসতার রাজনীতি পরিত্যাগ করতে হবে। সেটা না হলে পরবর্তী নির্বাচনকে ঘিরেও যে সহিংস ঘটনা ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী।
প্রধানমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচন প্রসঙ্গে 'ধৈর্য' ধরার অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। তিনি বলেছেন, ঠিক কবে নাগাদ সংলাপ হবে, তা নির্ভর করছে বিএনপির ওপর। তারা সহিংসতা ছেড়ে জামায়াতের খোলস থেকে বেরিয়ে এলেই সংলাপ শুরু হবে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, হানাহানি করে রাজনীতিতে কোনো লাভ হয় না। নিশ্চয়ই এ উপলব্ধি হয়েছে বিএনপির। তাই এসব বন্ধ করে বিএনপিকে গঠনমূলক আলোচনা করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি সংলাপে আসবে না বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ ও সমমনা রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো শীর্ষ নেতা। তাদের দৃষ্টিতে, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়াটা বিএনপির জন্য প্রায় অসম্ভব। আবার জামায়াত না ছাড়লে সরকারের সঙ্গে বিএনপির সংলাপও অনিশ্চিত। এ কারণে আগামী দিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানে বহির্বিশ্বের চাপ সামলানো খুব সহজ নাও হতে পারে। ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশি বন্ধুদের কমবেশি সবাই নেতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছেন। নির্বাচনে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। তিনি অর্থবহ সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন। একইভাবে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের নতুন পথ খুঁজতে একই তাগিদ দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা বলেছে, নির্বাচনে মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন ঘটেনি। যুক্তরাজ্যও নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম থাকায় হতাশা ব্যক্ত করেছে। বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছে কানাডাও। একই মনোভাব পোষণ করেছে কমনওয়েলথ। সবাই সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। বিশ্ব জনমতকে অগ্রাহ্য করা হলে বাংলাদেশ 'অবরোধের' মুখোমুখি হতে পারে বলেই অনেকের আশঙ্কা। অবরোধের ক্ষতি পোষানো বাংলাদেশের জন্য সম্ভব নয়। কারণ, বাংলাদেশ ভারত নয়।
এ অবস্থায় বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ শুরু করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী এ ব্যাপারে সক্রিয়।
বিদেশি বন্ধুদের মনোভাব প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, আমেরিকাসহ বিদেশি বন্ধুরা সংলাপের জন্য সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন। সংলাপের জন্য তো সরকার এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। জঙ্গি বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিএনপিকেও পরামর্শ দিতে হবে বিদেশি বন্ধুদের।
বান কি মুনসহ আমেরিকা ও লন্ডনের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, সংবিধান মেনেই নির্বাচন হয়েছে। এখন বিদেশিরা অনেক কথাই বলছেন। তাহলে কি সংবিধান লঙ্ঘন করতে হবে? সন্ত্রাসের কাছে হারতে হবে? সরকার কিছুতেই সেটা করবে না। তবে বিদেশিদের ভূমিকায় সরকারের ভেতর দুশ্চিন্তাও কম নেই।

No comments

Powered by Blogger.