উভয় সঙ্কটে বাবুনগরী by সালমান ফরিদ

দুই দফা রিমান্ডে নিয়ে মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরীকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। প্রথম দফায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা সম্ভব হয়নি। রিমান্ডে নেয়া হয় দ্বিতীয় দফায়। এ সময় তাকে দেয়া হয় ইলেক্ট্রিক শক। মানসিকভাবে করা হয় বিপর্যস্ত।
নিয়মিত খেতে দেয়া হয়নি। গরমে পিপাসা লাগলে পানি পান করতেও দেয়া হতো না। রিমান্ডে তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল, ডায়াবেটিস রোগী জানার পর তাকে চিকিৎসা ও নিয়মিত ওষুধ সেবন  করতে না দেয়া। ইনসুলিন দেয়া হয় অনিয়মিত। ঠিক মতো ঘুমাতে দেয়া হয়নি। আলো-বাতাসের বাইরে দীর্ঘ সময় বসিয়ে ও দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তীব্র ভ্যাপসা গরমের মধ্যে অন্ধকার ও বৈদ্যুতিক ফ্যানের বাতাস ছাড়া তাকে রাত দিন-পার করতে হয়েছে। এতে তিনি অত্যধিক দুর্বল হয়ে পড়েন। নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

তবে রিমান্ড সম্পর্কে কোন কথা বলছেন না মাওলানা বাবুনগরী। এমনকি তার পরিবারের সদস্যরাও এ সম্পর্কে মুখ খুলতে নারাজ। একদিকে অমানুষিক নির্যাতন, অপরদিকে শারীরিক বৈকল্য। উভয় সঙ্কটে বাবুনগরী। বাবুনগরীকে এ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি নিশ্চুপ থাকছেন। এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে কোন কিছু বলতে পরিবারের সদস্যেরও মানা করেছেন তিনি। এমনকি মিডিয়াকে কোন তথ্য দিতে গোয়েন্দা পুলিশের তরফ থেকে তার পরিবারকে বারণ করা হয়েছে এমন কথা চাউর আছে। যদিও এরকম বাধা-নিষেধ তাদের দেয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন এক নিকটাত্মীয়। অবশ্য তাদের দাবি, রিমান্ডের সময় নির্যাতনের কারণেই তার পায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। ‘রিমান্ডে তাকে মানসিকভাবে টর্চারিং করা হয়েছে’ বলে বাবুনগরী পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছেন- মানবজমিনকে এটুকুই বলেছেন পরিবারের কাছের কয়েকজন। আর হেফাজতে ইসলাম জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানোর অভিযোগ তুলেছে। সংগঠনের প্রধান আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেছেন, নির্যাতন করে বাবুনগরীর কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করতে অনেক সময় অতিবাহিত হয়। প্রথমে স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকার করায় মানসিক টর্চারিং করা হয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় দুই পায়ের তলায় ও হাঁটুর নিচে শক দেয়া হয়। এ কারণে পায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। ডায়াবেটিসের কারণে সেই ক্ষত এক পর্যায়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। স্বাস্থ্যের অবস্থা যখন একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে তখনই তাকে বারডেমে ভর্তি করা হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রথমে লাইফ সাপোর্টও দেয়া হয়। তার ডান পায়ে ক্ষত বেশি। সেখানে পচন ধরেছে। ইনফেকশন হওয়ায় পায়ের ক্ষতস্থান থেকে পুজ বেরুচ্ছে। মঙ্গলবার ওই পায়ের ক্ষত সারাতে অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে এতে খুব বেশি কাজ হয়নি। মাত্রাতিরিক্ত ডায়াবেটিস থাকায় এখন ক্ষত শুকানো সম্ভব হচ্ছে না। হাঁটু পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছে। বাম পাও ফুলে আছে। উভয় পায়ের ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হওয়ায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে আইসিইউতে রেখে।
জুনাইদ বাবুনগরীকে দুই দফায় মোট ৩১ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। প্রথম দফায় ৯ দিন ও দ্বিতীয় দফায় ২২ দিন। প্রথম দফায় রিমান্ডে নেয়া হয় ৭ই মে মঙ্গলবার এবং দ্বিতীয় দফায় নেয়া হয় ১৬ই মে বৃহস্পতিবার। প্রথম দফার রিমান্ডের পর যখন তাকে আদালতে হাজির করা হয়, তখন তিনি হাঁটতে পারতেন। কিন্তু পরে তিনি নিজে নিজে হাঁটতে পারেননি। দুজনের কাধে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়েছে। তার স্বাস্থ্যের অবস্থা যখন অবনতির দিকে, তখন রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তড়িগড়ি করে গত ২৯শে মে জামিন দেয়া হয়। যে কোন দুর্ঘটনার দায় এড়াতে সরকার অনেকটা যেচেই জামিন দিয়েছে বলে শোনা যায়। তার এক নিকটাত্মীয় দাবি করেন, গত ৫ই মে ভোর রাত পর্যন্ত তিনি শাপলা চত্বরে অবস্থান করছিলেন। এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজতের কর্মীদের ওপর হামলে পড়ে। তখন মঞ্চে ছিলেন তিনি। সেখানে অন্যদের মতো তার ওপরও চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। বন্দুক দিয়ে পায়ে আঘাত করা হয়। লাটি দিয়ে পেটানো হয়। তাদের সেখান থেকে বের করে দেয়ার সময় তিনিও আহত হয়েছিলেন। পায়ের ব্যথা ছিল তখন প্রচণ্ড। গত ৬ই মে রাতে তাকে চট্টগ্রামে পাঠানোর কথা বলে লালবাগ মাদরাসা থেকে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
বারডেম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, বাবুনগরীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যতটুকু জেনেছি বা তার শরীরের যে অবস্থা তাতে তিনি সুস্থ হলেও আগের মতো স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারবেন না- এটি পায়ের পচন রোধ করা সম্ভব হলে পরে। কিন্তু পচন টেকানো না গেলে পা কেটে ফেলার মতোও কোন সিদ্ধান্ত হয়তো নিতে হবে চিকিৎসকদের। তাকে রিমান্ডে নির্যাতন না করলে এই ক্ষত হওয়ার কথা নয় বলে তারা মন্তব্য করেন। বলেন, যে ক্ষত তৈরি হয়েছে সেটি ইলেক্ট্রিক শকের কারণেই। সংশ্লিষ্ট এক চিকিৎসক জানান, আগামী কাল (আজ শনিবার) তার পরবর্তী চিকিৎসার বিষয়ে বোর্ড বসে সিদ্ধান্ত নেবে।
গত কয়েক দিনে বারডেম হাসপাতালে আসা তার নিকটাত্মীয়দের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখা গেছে। তারা কারও সঙ্গে খুব বেশি কথা বলছেন না। যা বলছেন মেপে মেপে। সব সময় জড়োসড়ো হয়ে থাকছেন। সাংবাদিকদের কাছ থেকে থাকছেন নিরাপদ দূরত্বে। সূত্র জানায়, রিমান্ডের সময় তাকে জবানবন্দির বিষয়ে মুখ খুলতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি কোন কথা নিকটাত্মীয়দের বলতেও বারণ করা হয়। বেশি কথা বললে, ‘জঙ্গি’ ‘তালেবান’ বানানোর হুমকি দেয়া হয়েছে। এ কারণে তারা কেউই ভয়ে কোন কথা বলছেন না। চুপ আছেন বাবুনগরী নিজেও। এছাড়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর বাইরে ও ভেতরে সবদিক থেকে আতঙ্কে আছেন। একদিকে বিএনপি ও জামায়াতে-শিবিরকে জড়িয়ে স্বীকারোক্তি দেয়ায় নিজেদের ভেতরে চলছে অস্থিরতা। অপরদিকে মুখ খুলতে বারণ করে দেয়ায় কিছু বলতেও পারছেন না। এ নিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়েছেন তিনি। যে কারণে ভয় ও আতঙ্ক তার ও তার পরিবারের পেছন ছাড়ছে না।

No comments

Powered by Blogger.