বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্ধকার জগৎ দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবে না বিসিবি by তারেক মাহমুদ ।

তদন্তাধীন বিষয়ে কথা বলতে হলে সাধারণত ‘এখনই কোনো মন্তব্য করা যাবে না’ জাতীয় মন্তব্য করার নিয়ম। কাল সন্ধ্যায় দেওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসানের লিখিত বিবৃতির সারমর্মও তা-ই।
ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদের ব্যাপারে এখনই সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন তিনি।
বিবৃতিতে নাজমুল হাসান বলেছেন, ‘এ বিষয়ে যেহেতু একটা তদন্ত চলছে, এ নিয়ে এখনই আমরা বিস্তারিত বলতে পারব না। তাতে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে। দুর্নীতি দমনবিধি এবং এর নীতিমালা অনুযায়ী আমরা তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব।’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিসিবির কঠোর অবস্থানের কথা মনে করিয়ে দোষী ব্যক্তিদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না বলেও মন্তব্য করেছেন সভাপতি।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের চলমান ফিক্সিং বিতর্কের শুরুটা বিপিএলকেন্দ্রিক। বিপিএলের ভবিষ্যৎকে কিছুটা ধোঁয়াচ্ছন্ন লাগছে। তবে বিবৃতিতে বোর্ড সভাপতি বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, এটা বলার সময় এখনো হয়নি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিপিএল সম্ভাবনাময় এক সম্পদ। এতে কোনো দুর্বলতা থেকে থাকলে আমরা সেটা দূর করব এবং টুর্নামেন্টটাকে আরও শক্তিশালী করব।’
ম্যাচ ফিক্সিং-স্পট ফিক্সিং বিতর্কে মোহাম্মদ আশরাফুলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে জাতীয় দলের সাবেক দুই অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ ও খালেদ মাসুদ এবং সাবেক বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিকের নামও। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ ব্যাপারেও কোনো মন্তব্য করতে নারাজ বিসিবির সভাপতি। তবে প্রশংসা করেছেন সত্য উদ্ঘাটনে সংবাদমাধ্যমের প্রচেষ্টার, ‘সত্য প্রকাশে সংবাদমাধ্যমের চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। বিষয়টা নিয়ে যে সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, এটা তারই প্রমাণ। এর প্রয়োজনও আছে।’
এর আগে কাল দুপুরে গুলশানে নিজ বাসভবনেও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান। বিপিএলকে কলঙ্কমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেখানেও, ‘খেলাধুলায় যদি টাকাপয়সাটাই বড় হয়ে যায়, তাহলে খেলা আর খেলা থাকে না। পৃথিবীজুড়েই এটা কেউ পছন্দ করে না। আমরা যদি ঠিকমতো এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারি, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে পারি এবং ভবিষ্যতে যাতে এ রকম ঘটনা না ঘটে, সেই ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে বিপিএলে আর এমন ঘটনা ঘটবে না।’
গতকাল প্রকাশিত প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রশংসা ঝরেছে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক নির্বাচক রকিবুল হাসানের কণ্ঠেও, ‘বিপিএল যখন শুরু হলো, জানতাম ফিক্সিংয়ের বাতাস এখানেও লাগবে। দেরিতে হলেও সেসব জানা যাচ্ছে বলে আমি আনন্দিত। দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’ জাতীয় দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন বর্তমানে বিসিবির অস্থায়ী কমিটির সদস্য। সাবেক-বর্তমান ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিনি, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। এ রকম কিছু ঘটবে, কল্পনাও করতে পারিনি।’ তবে এখনো আস্থা রাখছেন অভিযুক্ত সাবেক তিন ক্রিকেটারের ওপর, ‘যতক্ষণ না অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ কাউকে দোষী বলা যাবে না। তারা তিনজন নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছে। আমরা সেটাকেও গুরুত্ব দিতে চাই।’
আরেক সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে প্রধান নির্বাচক আকরাম খানের জন্য অনেক বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জড়িত থাকার খবর, ‘আমরা কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। তার পরও এই খবর বড় এক ধাক্কা।’ তবে জাতীয় দলের আরেক সাবেক ক্রিকেটার মাহমুদ, মাসুদ আর রফিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় খুব একটা বিস্মিত নন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘এদের দু-একজনের বিরুদ্ধে যে এ রকম অভিযোগ উঠতে পারে, সে অনুমান আগেও ছিল। পত্রিকায় খবরটা পড়ে খারাপ লাগলেও খুব বেশি অবাক হইনি।’
জাতীয় দলের বর্তমান অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও প্রায় সব ক্রিকেটারের কাছেই খবরটা বিস্ময় হয়ে এসেছে। জাতীয় দলের ক্রিকেটার জহুরুল হক মনে করেন, এটা শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্যই নয়, গোটা দেশের ক্রিকেটের জন্যই খারাপ খবর, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট এমনিতেই ঠেলেঠুলে চলছিল। এখন তো সবই নষ্ট হয়ে গেল! আমরা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হলেও মানুষ বলবে, বাজে টাকায় কেনা গাড়িতে চড়ছে। ক্রিকেটারদের মানুষ ভালোবাসে। এখন হয়তো সবার দৃষ্টিটাই বদলে যাবে।’
জহুরুলের আশঙ্কা অমূলক নয়। সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যেও হতাশা ছড়াতে শুরু করেছে দেশের ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ার খবর। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে ‘শুধু আশরাফুল একা নন’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি পড়ে সেই হতাশাই প্রকাশ করেছেন তাঁরা। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে দোষী ব্যক্তিদের বিচার চেয়েছেন। কেউ বলেছেন, এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের কালো অধ্যায়। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সবখানেই যখন নেতিবাচক হাওয়া, তখন একমাত্র ক্রিকেট নিয়েই আশায় বুক বাঁধত বাংলাদেশের মানুষ। সেখানেও প্রতারিত হয়ে ক্ষুব্ধ এক পাঠক লিখেছেন, ‘শুধু এই ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে আমরা পুরো জাতি ধর্মীয় ভেদাভেদ, সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসা ভুলে গিয়ে সবাই একসঙ্গে কাঁদি, একসঙ্গে হাসি, একসঙ্গে দোয়া চাই—প্রার্থনা করি বাংলাদেশের জন্য। তাই এই প্রতারণা মেনে নেওয়া যায় না।’
তদন্ত চান খালেদ মাহমুদ: ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ আগের দিন প্রথম আলোর কাছেই অস্বীকার করেছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সহকারী কোচ খালেদ মাহমুদ। কাল বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেছেন, ‘যেহেতু পেপারে, মিডিয়াতে এসেছে, সবাই জানে...সবার তাহলে সংশয়টা থাকবেই আসলে সত্য বা মিথ্যাটা কী। আমি যদি এখন জোর গলায়ও বলি আমি ঠিক, অন্যরা ভুল, সেটা ঠিক হবে না। তদন্ত হোক। আমি জানি, আমার দিক থেকে আমি কতটা ক্লিয়ার, সুতরাং আমি তদন্ত চাই।’ তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে যেকোনো শাস্তি মেনে নেবেন বলেও মন্তব্য করেছেন মাহমুদ, ‘তদন্ত হওয়ার পর যদি আমি দোষী সাব্যস্ত হই, তাহলে আমি সব রকমের শাস্তি মেনে নেব। আর যদি না হই, সে ক্ষেত্রে আমি পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’

No comments

Powered by Blogger.