অভিনন্দন সমকাল by এম আবদুল হাফিজ

ঊনবিংশ শতাব্দীর স্কটিশ ইতিহাসবিদ টমাস কার্লাইলের বিখ্যাত একটি উক্তি অনুযায়ী সংবাদমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ এস্টেট। অন্যগুলো নৃপতি স্বয়ং এবং পার্লামেন্টের দুটি কক্ষ। এই ব্যাখ্যা পূর্বেও আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট জেফারসন কর্তৃক স্বীকৃত।
তিনি এক সময়ে বলেছিলেন : আমাদের যদি এ কথা স্থির করার এখতিয়ার থাকত যে, আমরা কি একটি সরকার চাই যেখানে সংবাদপত্র থাকবে না বা আমরা কি শুধুই সংবাদপত্র পছন্দ করব কোনো সরকারের অধিষ্ঠান ছাড়াই_ আমার তো মুহূর্তের জন্য কোনো ইতস্তত থাকবে না পরবর্তী অপশনটি গ্রহণ করতে। কিন্তু জেফারসন সে কথা বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে, যখন তিনি নিজেই কঠোর মিডিয়া সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন।
জেফারসনের উলি্লখিত উক্তির ২০০ বছর পর তার নিজের দেশে যা নাকি বিশ্বের অন্যতম প্রাণবন্ত গণতন্ত্র_ সংবাদমাধ্যম এখন স্রেফ অস্তিত্বের সংকটে ধুঁকছে। তা এতটাই যে, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির দাপটে ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরের মতো অত্যন্ত মর্যাদাবান মার্কিন সংবাদপত্র, যা কিছুদিন আগে তার শতবর্ষ বার্ষিকী উদযাপন করেছে, অল্পদিনের মধ্যে আর 'দৈনিক' থাকছে না এবং এখন থেকে তা শুধু ওয়েবভিত্তিক সংস্করণে রূপান্তরিত হবে।
লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস, সানফ্রান্সিসকো ক্রনিকল বা বোস্টন গ্গ্নোবের মতো বিখ্যাত এবং বহুল প্রচারিত মার্কিন সংবাদপত্রগুলোও একই ভাগ্য বরণ করতে চলেছে। কেননা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এগুলোর পাঠক সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। সংবাদপত্র শিল্পে এই ধস কোনো সরকার আরোপিত পদক্ষেপের দরুন ঘটেনি। বরং তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সংবাদ প্রবাহের নানা উপকরণ উদ্ভাবিত হওয়ার ফলে সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা আর আগের মতো অনুভূত হচ্ছে না। তাও সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা বহুলাংশে কমিয়ে এনেছে। টেলিভিশন চ্যানেল, যা এখন বিশ্বব্যাপী সংযুক্তির যোগ্যতা রাখে, মুহূর্তে সর্বশেষ সংবাদ বা তথ্য মানুষের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দিচ্ছে।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সংবাদপত্র পরিচালনার ৮০ শতাংশ অর্থের উৎস বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের জন্যও সংবাদপত্রের প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে। অটোমবিল ও রিয়াল এস্টেটসহ যে কোনো পণ্য এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমেই ক্রয়-বিক্রয় হয়। তবু যেসব সংবাদপত্র এখনও অস্তিত্বে আছে তারাও ব্যয় হ্রাসের নানা কৌশল অবলম্বন করেছে, যদিও সেসব সংবাদপত্রের গুণগত মান আর আগের মতো সংরক্ষিত হচ্ছে না। অনেক সংবাদপত্রই ইদানীং তাদের স্টাফের সংকোচন ঘটিয়েছে, বিশেষ করে যেসব দেশে জনবল আমাদের মতো সস্তায় সহজলভ্য নয়। এতে সংবাদপত্রে আগের জৌলুস এবং বৈচিত্র্য আর আগের মতো থাকছে না। ফলে আগের মতো গ্রাহক আকর্ষণ করতে পারছে না। সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে পশ্চিমা বিশ্বে অনেক সংবাদপত্রই পাঠক আকর্ষণ করতে এখন অপরাধ জগতের চাঞ্চল্যকর কাহিনী বা স্ক্যান্ডাল পরিবেশনের দিকে ঝুঁকেছে।
সংবাদপত্র শিল্পের চলমান বিপর্যয়ের ফলে কোনো দিন হয়তো তাদের মুদ্রিত সংস্করণগুলো আমাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে বা বর্তমান অবয়বের এই শিল্পটি বিলীনই হয়ে যেতে পারে। এই মুহূর্তে কল্পনা করাও কঠিন যে, তখন সংবাদপত্র পাঠের আনন্দবঞ্চিত পৃথিবীটাই-বা কেমন হবে! সংবাদপত্রই যদি তথ্যপ্রযুক্তির দাপটে টিকতে না পারে আদৌ, কেমন হবে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সময় উপভোগের বিষয়টি।
সংবাদপত্র শিল্পে নানামুখী সমস্যার মধ্যেও আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সংবাদপত্র বলে পরিচিত দৈনিক সমকাল যে তার প্রকাশনার নবম বর্ষে উপনীত হলো তা-ও এক প্রচণ্ড আনন্দ সংবাদ। আমাদের আশাবাদ যে, এ দেশে বিশুদ্ধতম সাংবাদিকতার অন্যতম প্রতীক সমকাল তার মান অক্ষুণ্ন রেখেই সত্যের সন্ধানে তার নির্ভীক অবস্থানে আপসহীন থাকবে। সমকাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নবম বর্ষে পদার্পণের আনন্দঘন মুহূর্তে সংবাদপত্রটিকে উষ্ণ অভিনন্দন।
এই নিবন্ধকারের সংবাদপত্রে লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছিল দেশের ইংরেজি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোতে। ফলে আর্ট পেশায় কোনো সাংবাদিক না হলেও সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে গেছি। যুগান্তরের মিজানুর রহমান খান (এখন প্রথম আলোয়) আমাকে কী যেন ভেবে বাংলা সংবাদপত্রে প্রবেশের সুযোগ করে দেন। তখন যুগান্তরের সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, যিনি নিঃসন্দেহে দেশের একজন তারকা সাংবাদিক। তার পৌরোহিত্যে সমকাল সাফল্যের উচ্চ থেকে উচ্চতর চূড়ায় আরোহণ করবে_ এমনই বিশ্বাস পোষণ করি। সমকালের একজন নগণ্য পাঠক ও লেখক হিসেবে পত্রিকাটির উত্তরোত্তর উৎকর্ষতা আমাকে যুগপৎ অনাবিল আনন্দ এবং ব্যক্তিগত অর্জনের অনুভূতি দেবে।

স ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.