একজন কবির উচ্চারণ জন্মদিনে by ফজল শাহাবুদ্দীন

একজন কবি তার জন্মদিনে কী এমন নতুন করে বলতে পারেন? লিখতে পারেন কিংবা নতুন করে অনুধাবন করতে পারেন। আমাদের দশদিক ঘিরে যে জগত এবং মহাজগত_
তার বিপুল বিশাল আর সর্বগ্রাসী লীলাকে প্রতিদিন কবি তার অসত্মিত্বে ধারণ করেন_এবং সেই অশানত্ম লীলা লাস্যকে প্রতি মুহূর্তে নতুন করে একানত্ম করে তার নিজের অভিজ্ঞতায় ঘনিষ্ঠ এক সঙ্গীতের মতো গ্রথিত করেন_সেই হাহাকারকে নতুন ভাষায় নতুন শব্দে অনাবিষ্কৃত ছন্দে তার কবিতার শরীরে লিপিবদ্ধ করেন_প্রতিদিন ক্রমাগত এক অদৃশ্য ছায়ার মতো আন্দোলিত করতে থাকেন কাল মহাকাল বিসত্মৃত যে চিরকালের চিরধাবমান বাতাস তার প্রসারিত উচ্চারণের মধ্যে_তাহলে একজন কবি তার নির্ধারিত একটি জন্মদিনের চৌহদ্দির মধ্যে নতুন কী বলবেন। কেমন করে কী উচ্চারণ করবেন।
আমি জানি আমার নিজের জন্মদিনকে আমি কখনোই পৃথক করে আলাদা করে দেখার বা শনাক্ত করার কোনো সুযোগ পাই না। তেমনি করে দেখার কোনো প্রচেষ্টাও আমার মধ্যে নেই। আমার সকল দৃষ্টির মধ্যে অননত্মকালের যে ক্রমাগত কুয়াশা বিধাতার অনত্মহীন ভালোবাসার মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে আমি তো তার বাহিরে তাকে অতিক্রম করে তার আচ্ছন্নতার সীমাহীন অচঞ্চল আলিঙ্গনকে অস্বীকার করে কোনো কিছু প্রত্যৰ করতে পারি না।
আমি জানি এই কুয়াশার চাদর জগতের সমগ্র ছিন্ন বিচ্ছিন্নতার মধ্যে আপাত অদৃশ্য অতীতের অসংখ্য ছবির মতো সারাৰণ বিদ্যমান।
সে কারণেই আমি জানি আমার নিজের নির্ধারিত একটি জন্মদিনেও আমি পৃথক করে কোনো কিছুকে দেতে পাই না। তেমনি দেখার কোনো প্রয়াশও আমার মধ্যে নেই। কেননা আমি জানি স্বাভাবিক এবং সঙ্গত কারণেই আমি জগত ও মহাজগতের সকল কিছুকেই দেখতে পাই। শুধু কখনো তাকে উপলব্ধি করি_কখনো তাকে উপলব্ধি করতে পারি না। এ যেন সেই সব চলচ্চিত্রের মতো_যখন তাদের সঙ্গে কোনো সঙ্গীত বা শব্দ থাকে না তখন আমি তাদের যথাযথ উপলব্ধি করতে পারি না_যখন থাকে তখন পারি। একটি দৃশ্যময় ঝড় যদি শব্দহীন সঙ্গীতহীন করে দেন বিধাতা তাহলে যেমনটি হবে এও যেন ঠিক তাই।
আমার কাছে জন্মদিনের পৃথক করে কোনো মূল্যই নেই তেমনটি যেন কেউ মনে না করেন। আমি জানি শুধু জন্মদিন নয় আমাদের মৃতু্যদিনও আমাদের কাছে সবিশেষ মূল্যবান দিন বলে বিবেচিত হতে পারে। হওয়া উচিত বলে আমিও মনে করি। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখকে নিয়ে লেখা কবিতাটি তো বিশ্ববিখ্যাত একটি রচনা। রবীন্দ্রনাথ তো বলেছেন একথা তার কবিতায়_তিনি বেঁচে থাকবেন শতাব্দী অতিক্রম করে। আজ আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই বেঁচে থাকবেন এই পৃথিবীর সমান, শতাব্দী অতিক্রম করে নয় শুধু।
আমার কবিতা রচনার প্রথম দিকে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম। কবিতাটির নাম, 'আমি ফজল শাহাবুদ্দীন কবি' অল্প সময়ের মধ্যে কবিতাটি এদেশের যাঁরা বোদ্ধা পাঠক তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনেকে প্রশংসা করে আবার অনেকেই তির্যক দৃষ্টিতে দেখেন_কবিতাটিতে অন্য কিছু আবিষ্কারের প্রয়াসে লিপ্ত হন। সে তো অনেক আগের কথা। এখন অনেক কিছুরই অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন সেই কবিতাটির শিরোনাম আমাকে নিয়ে নির্মিত একাধিক পোস্টারেও ব্যবহার করা হয়েছে এবং আমরা নিজেরও তা খারাপ লাগছে না।
বেশ আগের রচিত আমার এই কবিতাটি। আশির দশকের প্রারম্ভে। আমি তখন মগবাজারের একটি নতুন বাড়িতে দোতলার একটি ফ্যাটে থাকি। আমাদের নিজেদের মানে আমার আম্মার বাসাবোর বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলাম এই মগবাজারের ঘরে। আমাদের নিজেদের বাড়িতে স্থান সঙ্কুলান হচ্ছিলো না তখন। মনে আছে সেই প্রথম আমি আমার আম্মাকে ফেলে অন্য কোনো বাড়িতে থাকতে গেলাম। আমারও বেশ খারাপ লাগছিলো। সবই তো স্বাভাবিক। স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে সংসারের শুরম্ন নতুন কোনো ফ্যাটে যাওয়া যেনো অস্বাভাবিক কিছু নয়_অন্যায় কিছু নয়। তবু কোথায় যেন একটি শূন্যতার বাতাস।
আমার স্ত্রী মীরা বললো, তোমার আম্মার কথা খুব বেশি করে মনে পড়ছে তাই না?
ওর কথা শুনে হাসলাম, বললাম_তুমি তো জানো আমার আম্মা আমার কাছে কতোটা কতখানি।
মীরা বললো, তোমার আম্মা তো আমার মা নন_আমার শাশুড়ি। আমারই খুব খারাপ লাগছে।
জানতাম আমার স্ত্রী মীরাকে খুব ভালোবাসেন। বললাম, আম্মারও খারাপ লাগবে তোমাকে ছেড়ে থাকতে।
কিন্তু সবাইকে অতিক্রম করে গেলো আমার কন্যা দীনা_প্রায় দু'বছর তখন তার বয়েস। সন্ধ্যা হতেই আমার কাছে এসে ঘেঁষে বসলো, অদ্ভুত বিষণ্নতায় ভরা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো সেই ছোট মেয়ে_আমার হাত ধরলো, বললো, আব্বু বাসায় যাব_আমাদের বাসায় চলো।
দীনার কথা শুনে আমি আর মীরা দুজনেই কেঁপে উঠলাম সেদিন।
প্রথমে আমি কেমন যে এলোমেলো হয়ে গেলাম। আমি কী বলবো এই শিশুকে। কী করে সাজাব কথা। ওর মা বললো, দীনামা এখন থেকে এটাই আমাদের বাসা_আমাদের নতুন বাসা।
আমিও যেন কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম_কিন্তু দীনা শুনবে না। এই ছোট্ট মেয়ে। কেন জানি কেমন করে, জানি না যে উদ্ধত হয়ে উঠলো, না না না তিনবার বললো না_বললো না এটা বাড়িঅলার বাসা। আমরা এখানে থাকবো না। এখানে দাদু কোথা?
দীনা কান্নায় ভরে উঠলো। হাত নাড়তে লাগলো ক্রমাগত।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নার মতোন করে বললাম, মা দাদু আসবে।
আসলে আমাকেও একটা অবিরল কান্না এসে আক্রানত্ম করলো। জানলাম, আমার জীবনে এটাই প্রথম ভাড়া বাড়িতে আসা।
সেই আমার কন্যার কান্না শেষ হলো যখন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো।
সন্ধ্যা রাতে মীরা আর আমি দুজনেই খেতে পারলাম না_আসলে খেলাম না।
ঘুমিয়ে পড়তে চেষ্টা করলাম আমরা সেই অচেনা বাড়িতে। সব কিছু অচেনা এ বাড়ির। চার দিকের শব্দ অন্য রকম জানালার ওপারে আকাশ নেই, গাছপালা নেই, মাঠ নেই, মাদারটেক এর প্রানত্মে। এমনকি আমাদের নিজের বাড়ির আমগাছ আর নারকেল গাছগুলোও নেই।
ঘুম আসছিলো না_না আমার না মীরার। এক অদ্ভুত 'অচেনা' আমাদের ভয়ঙ্করভাবে বিরক্ত ঠেকছিলো। সময়টা ১৯৮০ সালের এপ্রিল মে মাস এমনি কিছু একটা হবে। শেষ পর্যনত্ম আমি ঘুমুতে পারিনি_আসেনি ঘুম। সংৰিপ্ত করে বলতে পারি। ঘুম হলো না আমার। একটি কবিতা লিখেছিলাম সেই রাতে। কবিতাটির নাম আমি ফজল শাহাবুদ্দীন, কবি।
মধ্যরাতে জানলাম আমি কবিতাটি লেখা সমাপ্ত করেছি। দেখলাম_মীরার ঘুম ভাঙালাম আমি সেই মধ্যরাতে। বললাম, আমি একটি কবিতা লিখেছি_তোমাকে শোনাতে চাই, শুনবে। মীরা বললো এতো রাতে বললো শুনবো। কবিতাটির প্রায় সব খানে একটি মৃতু্যর কথা ছিলো, শুনে মীরা বললো আমার ভয় করছে। কবিতাটির অন্যত্র ছিলো, জীবন বেঁচে থাকে চিরকাল, জেনেছিলাম, আর্তি জীবনের অন্য নাম_বলেছিলাম পূর্ণতার শ্যামলিমাঘন অঙ্গীকার।
কবিতাটির কথা এখন থাক। জন্মদিনের কথা বলি আমি বলেছি আমি ফজল শাহাবুদ্দীন কবি, আজ আমার জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথ তার জন্মদিন কবিতাটির শুরম্নতেই বলেছেন, না আমি রবীন্দ্রনাথ বলেননি_সেটার প্রয়োজন তবু অবশ্যই ছিলো না তখনো ছিলো না, বলেছেন আজ মম জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন কবিতাটি জনপ্রিয় কবিতা নয়_কিন্তু অসাধারণ কবিতা_জন্মদিনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মৃতু্যর কথাও বলেছেন। "আজ আসিয়াছে কাছে জন্মদিন মৃতু্যদিন।"
এ রচনার শুরম্নতে বলেছি পৃথক করে জন্মদিনকে আমি দেখতে পারি না_তেমন কোনো প্রচেষ্টাও আমার মধ্যে নেই। বিধাতার কথা বলেছি ভালোবাসার মতো কুয়াশার কথা বলেছি যে ভালোবাসার সকল আচ্ছন্নতার মধ্যে সীমাহীন এক অচঞ্চল আলিঙ্গনে আমরা ডুবে আছি ডুবে থাকি।
শুধু ভালোবাসাই বেঁচে থাকা_জন্মদিনে আমি সেই ভালোবাসার কথাই বার বার উচ্চারণ করেছি। রবীন্দ্রনাথ জন্মদিনকে বলেছেন, "প্রাণের প্রানত্মপথে ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে মরণের ছাড়পত্র নিয়ে।"
আমার জন্মদিনকে আমি কোনো বিশেষ দিন বলে মনে করতে পারি না। আমার বিশ্বাস একজন সত্যিকার কবি জীবন আর মৃতু্যকে একটি অবিনশ্বর শিখার মতো জ্বালিয়ে রাখতে পারেন। একজন কবি আসলে এই জীবন এবং মৃতু্য মধ্যবর্তী এক বিন্দুতে মহাজাগতিক এক স্বপ্নের ভেতরে মরিতে পারেন।
আমার অন্য একটি কবিতায় একজন কবির কাহিনী এরকম_
একজন কবি এই জীবন এবং মৃতু্যর মধ্যবর্তী বিন্দুতে
আশ্চর্য এক স্বপ্নের ভিতরে বসবাস করিতে লাগিল
কবি দেখিল
জীবন আছে, থাকিবে চিরকাল মৃতু্য আছে বাঁচিবে অননত্মকাল
কবিতা একটি চোখের স্বপ্নে জীবনের আনন্দকে মাখিয়া নিলো,
আর অন্য চোখের পানিতে মৃতু্যকে মিশাইয়া রাখিল
এবং প্রার্থনা করিল
জীবন ও মৃতু্য একটি চিরকালের বিন্দুতে আসিয়া
একটি অচিনত্মনীয় অবয়বে গ্রথিত হউক তার অসত্মিত্বে তার চোখের জলে
এবং একজন কবি
সেই অবিশ্বাস্য বিন্দুতে বসবাস করিতে চাহিল চিরকাল

(জীবন মৃতু্য একজন কবি থেকে)

No comments

Powered by Blogger.