জুনায়েদ খানের বাড়িতে বিপাশার পরিবর্তে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প

বিপাশাকে পাওয়া যাবে না। তার পরিবর্তে এলাকার সর্দার-মাতব্বররা ৩শ’ টাকার স্ট্যাম্প পাঠিয়েছেন তার বাড়িতে। বলা হয়েছে এতে স্বাক্ষর করে দিতে। মামলা-মোকাদ্দমা মিটিয়ে ফেলতে।
আশুগঞ্জের বগইর গ্রামের মো. জুনায়েদ খান ও তার পরিবার এখন দিশেহারা। সর্দার-মাতব্বরদের অব্যাহত চাপ তাদের ওপর। বিপাশার অপেক্ষায় কেটে গেছে সাত মাস। থানায় যথারীতি অপহরণের মামলাও করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাকে উদ্ধারের কোন চেষ্টাই করেনি বরং গ্রেপ্তার করা দুই আসামিকে ছেড়ে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র গায়েব করারও অভিযোগ আছে পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশের নয়-ছয়ে অসহায় এ পিতা ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। তারপরও মেয়েকে পাননি। এখন যোগ হয়েছে এলাকার ইউপি চেয়ারম্যানসহ সর্দার-মাতব্বরদের চাপ। তাদের আবদার ঘটনাটি মিটিয়ে ফেলতে হবে।
আশুগঞ্জের বগুইর গ্রামের জুনায়েদ খানের মেয়ে পানিশ্বর শোলাবাড়ী শামসুল আলম উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী বিপাশা খানমকে অপহরণ করে পার্শ্ববর্তী মহল্লার ফয়সল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। অপহরণের এই ঘটনা ঘটে গত বছরের ১৩ই মে। এ ঘটনায় জুনায়েদ খান আশুগঞ্জ থানায় ১৫ই মে একটি অভিযোগ দেন। এরপরই পুলিশ আইয়ুব খান ও শাহজাহান নামে দুুজনকে ধরে আনে। ধৃত আসামিদের আত্মীয় সীতাকুণ্ডু থানায় কর্মরত এসআই খাদেমুল বাহার বিজয় অপহরণ মামলাটির প্রাথমিক তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া এবং গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্বদানকারী আশুগঞ্জ থানার এসআই হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। ওই সময় দুর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউল হক মাস্টার ৮-১০ জন সর্দার-মাতব্বর নিয়ে থানায় হাজির হয়ে ৩ দিনের মধ্যে অপহৃত বিপাশাকে ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করে দুই আসামিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। জুনায়েদ খান অভিযোগ করেন, এরপর আর তার কন্যাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি বরং আসামিদের এলাকা ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন এসআই হাবিবুর রহমান। পরে বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার না করে অভিযোগ তুলে নেয়ার পরামর্শ দিতে থাকেন এই দারোগা। শুধু তাই নয়, এসআই বিজয়ের দুই আত্মীয় শাহজাহান ও সেলিমের নাম বাদ দিয়ে নতুন করে অভিযোগ লিখিয়ে জুনায়েদের স্বাক্ষর নিয়ে ২১শে মে ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলার এফআইআর করা হয়। এরা হচ্ছে- বগুইর গ্রামের আইয়ুব খানের ছেলে মো. ফয়সল মিয়া (২৫), কবির মিয়ার ছেলে রাসেল মিয়া (২২), মৃত মহিজ আলী ঠাকুরের ছেলে জাকারিয়া ঠাকুর (২৫) ও মৃত জজ মিয়ার ছেলে আইয়ুব খান (৪৮)।  দারোগার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, মামলার তদন্ত এবং আসামি ধরা কোনটারই ধারেকাছে যাননি দারোগা। এসআই হাবিব বদলি হলে তদন্তের দায়িত্ব পান এসআই মুজিবুর রহমান। তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মামলার ফাইল থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কাগজপত্রও গায়েব হয়ে যায়। যার মধ্যে দুই আসামিকে ছাড়িয়ে নেয়ার অঙ্গীকারনামা, বাদীর দেয়া লিখিত প্রাথমিক অভিযোগটি রয়েছে। মুজিবুর রহমানের পর মামলাটির তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন এসআই মহসিন ভূঁইয়া। তার বিরুদ্ধেও আছে বাদীর অভিযোগ। মামলা আপসের জন্য চাপ দিচ্ছেন এ দারোগা। দারোগার পর দারোগা বদল হয়েছে। কিন্তু সাত মাসেও জুনায়েদ খান ফিরে পাননি তার কন্যাকে। বরং মামলা আপসের নানামুখী চাপ এবং জামিনে থাকা আসামিরা হুমকি-ধামকিতে তটস্থ করে তোলে বাদী ও তার পরিবারের সদস্যদের। এ ব্যাপারে বাদীর ছোট ভাই শাহজাহান খান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেন। এ নিয়ে জুনায়েদ খান স্থানীয় থানা পুলিশের নানা ছলছাতুরির অভিযোগ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ সুপারের কাছে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। সর্দার-মাতব্বররা এখন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে জানান জুনায়েদ খান ও তার ভাই শাহজাহান খান। তারা জানান, ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক মাস্টার, হুমায়ুন সর্দার, নূরুল ইসলাম মেম্বার, মোহন ভূঁইয়া, আলকাস খন্দকার, নূরুল আমিন প্রমুখ সর্দার-মাতব্বররাই তাদের চাপ দিচ্ছেন বিষয়টি আপস করতে। ৩শ’ টাকার স্ট্যাম্পে আপসনামা লিখেও পাঠিয়েছেন তাদের বাড়িতে। বলেছেন, মেয়েকে ফেরত দেয়া হবে না। মামলা-মোকদ্দমা উঠিয়ে নিতে হবে। আপসনামায় স্বাক্ষর করে দিলে তারা এটি কোর্টে জমা দিয়ে মামলা শেষ করে ফেলবেন। জুনায়েদ খান বলেন, আমি স্ট্যাম্পে এখনও স্বাক্ষর করিনি। কিন্তু তারা আমাকে চাপ দিচ্ছে। আমি বলেছি, আমার মেয়ে দাও। আমি মামলা উঠিয়ে নেবো। কিন্তু এতে তারা রাজি নন। কি করবো বুঝতে পারছি না। তবে দুর্গাপুর ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক মাস্টার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘চাপ দেয়ার কথা মিথ্যা। আমি শুনছি তারা মিইল্ল্যা গেছে। মেয়ের পরিবার খুবই দুষ্ট। আমরা ২-৪ গ্রামের সর্দাররা একবার একত্রে তাদের বাড়িতে গিয়ে বলেছিলাম, তাদের মধ্যে মিলমিশ করে দিতে। কিন্তু তারা আমাদের কথা শুনেনি। তিনি থানায় মেয়েকে ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করে ২ আসামিকে ছাড়িয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমি ৪-৫ জনকে নিয়ে ওই দিন থানায় গিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলাম, মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু ছেলেমেয়ে কোথায় গেছে তা খুঁজে বের করতে পারেনি।  জুনায়েদ খান ও শাহজাহানের অভিযোগ, পুলিশ অপহৃত বিপাশাকে উদ্ধার তো করেনি বরং আসামি পক্ষকে বাঁচাতে সবকিছু করছে। গত ৪ঠা নভেম্বর তারা গোপনে বিপাশাকে কোর্টে হাজির করে। পুলিশ আদালতের অনুমতি ছাড়াই তার মেডিকেল পরীক্ষা করায়। সেখানেও তার বয়স ধরা পড়েছে ১৫ বছর। জন্ম নিবন্ধন সনদ ও রেজিস্ট্রেশন কার্ড অনুযায়ী বিপাশার বয়স ১৩ বছর ৫ মাস বলে তারা জানান। তারা বলেন, আমরা এ বিষয়ে ১৫ই নভেম্বর জজ কোর্টে একটি আপিল আবেদন করেছি। আমরা চাই, আমাদের মেয়েকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। আমরা ন্যায়বিচার চাই। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামলায় জড়িয়ে পড়ার পর অপহরণ মামলার আসামি আইয়ুব খান তার বগুইর এলাকার এক বিঘা জমি বিক্রি করেছেন ১২ লাখ টাকায়। আরও দুই বিঘা জমি বন্ধক রেখেছেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করছেন তিনি পুলিশের পেছনে। এ ব্যাপারে আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম ফারুক বলেন, মেয়ে স্বেচ্ছায় এসেছে বলে জবানবন্দি দিয়েছে। আমরা ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়ার জন্যে পুলিশ অফিসে এমই (মেরিট অব এভিডেন্স)পাঠিয়েছি।

No comments

Powered by Blogger.