বিশ্বজিৎ হত্যাঃ গ্রেপ্তার নিয়ে বিভ্রান্তির জাল বড় হচ্ছে!

দুটি ঘটনা।
এক. ক্যামেরার সামনে একটি নিরীহ ছেলেকে কুপিয়ে-পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। বেচারার নাম বিশ্বজিৎ দাস।
দুই. বিভ্রান্তির জাল বোনা। চলছে তিন দিন ধরে। নমুনা—আটজন গ্রেপ্তার: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কেউ গ্রেপ্তার নেই: পুলিশ। ১১ জন গ্রেপ্তার: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সাতজন গ্রেপ্তার: পুলিশ। হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী: গণমাধ্যম। হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কেউ নয়: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী নয়: প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব।
কোন ঘটনাটি বেশি নৃশংস? প্রথম ঘটনা, না দ্বিতীয়টি? এমন প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে, গণমানুষের মধ্যে।
গরিব বিশ্বজিতের দাহ হয়েছে শরীয়তপুরের নিভৃত গ্রামে। তাঁর পরিবারের এ শোক সইবার নয়। কিন্তু তাঁর হত্যাকাণ্ড নিয়ে যা চলছে, এই দুঃখ পরিবারটি রাখবে কোথায়?

হত্যাকাণ্ডের চতুর্থ দিন: গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর দাবি করলেন, এ ঘটনায় মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে বেলা ১১টার দিকে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি ফরিদ আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চকে জানান, মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিকেলে ঢাকা মহানগর আদালতে পুলিশ ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার চারজনকে এ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেছে। আর সন্ধ্যায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পুলিশ দাবি করেছে, আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাত নয়টা পর্যন্ত পুলিশ ও আদালতের হিসাব ধরলে সাতজনের গ্রেপ্তারের হিসাব পাওয়া যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গতকালের হিসাবের চেয়ে তা চারজন কম।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ নিয়ে জটিলতার কিছুই নেই। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’
আদালতের মাধ্যমে গ্রেপ্তার দেখানো ব্যক্তিরা হলেন: হারুন অর রশিদ, ফারুক হোসেন, কাজী নাহিদুজ্জামান ওরফে তুহিন ও মোসলেউদ্দিন। আর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন: মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এইচ এম কিবরিয়া ও কাইয়ুম মিয়া। মাহফুজুর রহমান নাহিদকে সকালেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে হাইকোর্টে জানানো হয়েছে।
উচ্চ আদালত গত বুধবার বলেছিলেন, হামলাকারী হিসেবে যাঁদের নাম-ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করতে হবে। গ্রেপ্তার সাতজনের মধ্যে মাহফুজুর ও কিবরিয়া ছাড়া কারও নাম-ছবি গণমাধ্যমে আসেনি।
৯ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা। ১১ ডিসেম্বর মূল হামলাকারী পাঁচজনের পরিচয় নিশ্চিত করে গণমাধ্যম। তাঁরা হলেন: মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল, মীর মো. নূরে আলম ওরফে লিমন, মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, মো. ইমদাদুল হক ও মো. ওবাইদুল কাদের। এর মধ্যে বিশ্বজিৎকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছেন শাকিল। অন্যরা রড আর লাঠি দিয়ে পিটিয়েছেন। এঁদের বিরুদ্ধে নিজস্ব নিয়মে ব্যবস্থাও নেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
ঘটনার দিন রাতেই পুলিশ বাদী হয়ে সূত্রাপুর থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করে, কিন্তু কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। অভিযোগ ওঠে, পুলিশ ছাত্রলীগকে বাঁচাতে চাইছে।
এই অবস্থায় গতকাল বিকেলে ১০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং পুলিশ-চিকিৎসকসহ দুই শতাধিক লোককে আসামি করে নালিশি মামলা করেন আইনজীবী মাহবুবুল আলম। ঢাকা মহানগর হাকিম এটি আগের মামলার সঙ্গে সংযুক্ত করে তদন্তের নির্দেশ দেন পুলিশকে।
গত মঙ্গলবার সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, এ ঘটনায় আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়। একই দিন বিকেলে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিশ্বজিৎ হত্যায় জড়িত গণমাধ্যমে নাম-ছবি আসা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পরেও গত বুধবার এ মামলায় কাউকে আদালতে হাজির না করায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। গতকাল সেই বিভ্রান্তির জাল আরও যেন বড় হয়েছে।
গ্রেপ্তার ১১: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ১১ জন বা তার বেশি গ্রেপ্তার হয়ে থাকতে পারে। তাঁর দাবি, এ ঘটনায় গ্রেপ্তারের বিষয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের আরও বলেন, জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে সরকার বদ্ধপরিকর।
গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডে ওই দিন সকাল পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশ দাবি করেছিল, কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, তবে ছয়জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে এই বিভ্রান্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাজধানীতে ৪০০ পুলিশ কর্মকর্তা কাজ করছেন। কোনো পুলিশ কর্মকর্তাই সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবেন না, কোন ঘটনায় কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বেশির ভাগ সময়ে খবর আমাদের কাছে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে) আসে। সর্বাঙ্গীণ খবর আমরা দিতে সক্ষম হই। সেই ভিত্তিতে আটজনের গ্রেপ্তারের কথা বলা হয়েছে এবং অন্যদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চলছে। পরবর্তী পর্যায়ে আরও তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে।’
১০ জনকে আসামি করে মামলা: বিশ্বজিৎ দাস হত্যার ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত মূল পাঁচ হামলাকারীসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলা হয়েছে। আইনজীবী মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। হত্যাকাণ্ডে অজ্ঞাতনামা আরও শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার ১০ আসামি হলেন: মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল, মীর মো. নূরে আলম ওরফে লিমন, মো. ইমদাদুল হক, মো. ওবাইদুল কাদের, ইউনুস, তাহসিন, জনি, শিপুল ও কিবরিয়া। মামলার আবেদনে বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবি দেখে এই ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ, চিকিৎসকসহ অজ্ঞাতনামা দুই শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
বাদীর এজাহার গ্রহণ করে ঢাকা মহানগর হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান সূত্রাপুর থানার পুলিশকে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন। আদালতের আদেশে বলা হয়, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে এরই মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। ওই মামলার সঙ্গে সংযুক্ত করে আইনজীবী মাহবুবুল আলমের করা নালিশি আবেদনটি এজাহার হিসেবে নিয়ে তদন্ত করতে হবে।
পুলিশের করা মামলাটিতে কোনো আসামির নাম ছিল না। নালিশি আবেদনটি মামলার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় এখন এই ১০ জনই মামলার আসামি হলেন।
চারজন গ্রেপ্তার: বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এঁরা হলেন: হারুন অর রশিদ, ফারুক হোসেন, কাজী নাহিদুজ্জামান ওরফে তুহিন ও মোসলেউদ্দিন। এঁদেরকে কোতোয়ালি থানার পুলিশ ১১ ডিসেম্বর আদালত এলাকা থেকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করেছিল।
সূত্রাপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাহবুবুল আলম আকন্দ গতকাল বিকেলে মহানগর হাকিম এস এম আশিকুর রহমানের আদালতে গ্রেপ্তারকৃতদের বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেন। আদালত চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ দেন।

No comments

Powered by Blogger.