অভিমতঃ কথার পিঠে কথা থেকে যায়, সমস্যার পিঠে সমস্যা by নাহিদ আনজুম সিদ্দিকী

বদলে যাওয়ার অঙ্গীকারবদ্ধ একটি পত্রিকায় সম্প্রতি একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, লেখক, বিজ্ঞানীর একটি ফিচার পড়লাম। ডিজিটাল সময়ের ঘোর বিরোধিতা করে তিনি তার লেখাটি শুরু এবং শেষ করেছেন। আমার মতো অনেকেই তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল, পিছিয়ে পড়া দেশে ডে-লাইট সেভিংস আসলেই কতটা প্রয়োজন তা না ভেবেই এ দেশের নীতি প্রণয়নকারীরা এক-একটি নীতি আমাদের মতো আম-জনতার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমাদের তাদের হাতের গিনিপিগ বানিয়ে রেখেছে। অথচ আমাদের বলার কেউ নেই।
কথাসাহিত্যিক সাহেব দেশের একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব। তিনি যা বলবেন তা অবশ্যই সরকারের দৃষ্টিগোচর হবে, তা সরকারের নীতিনির্ধারক দল মানুন অথবা না মানুন। আরও অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে আমাদের মতো লোকদের মনে, যারা তার সায়েন্স ফিকশন ও লেখার ভক্ত এবং বইমেলায় গিয়ে প্রথম যারা তার একটি বই কিনতে দেরি করে না।
আমাদের দেশে ডে লাইট সেভিংস নিয়ে সমস্যা আছে । তবে এর চেয়েও গুরুতর সমস্যা আমাদের দেশে কম নয়। আমার প্রিয় এই কথাসাহিত্যিকের কাছ থেকে আশা করেছিলাম সেসব গুরুতর সমস্যা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা। কথাসাহিত্যিক এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়েছেন, আমিও চেয়ে নিচ্ছি। তাদের অসুবিধার জন্য আমরা কিছু করতে পারছি না। তবে এটাও ঠিক, যে শ্রমিক ভোর বেলায় উঠে তার দৈনন্দিন কাজগুলো করছে তার কাছে ডে লাইট সেভিংস যা, অ্যাকচুয়াল সময়ও তাই। বিশিষ্ট এই কথাসাহিত্যিকের আলোচনার মতো আরও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আমাদের দেশে আছে।
বেশ কিছুদিন আগে একজন মন্ত্রী বলেছিলেন, ভারত থেকে বিদ্যুত্ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। ভারতে গ্যাসের মতো মূল্যবান এই সম্পদ রফতানি করার পেছনে যে যুক্তি দেয়া হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে কোনো যুক্তির মধ্যে পড়ে না। আবার বিদ্যুত্ আমদানির পেছনেও দেখানো হচ্ছে শক্তিশালী খোঁড়া যুক্তি। বাংলাদেশে প্রতিভাবান লোক একেবারে কম নয়। তার মধ্যে ওই লেখকও একজন। অথচ বিশিষ্ট এই কথাসাহিত্যিক আলোকপাত করছেন ডে লাইট সেভিংসের ওপর। তার এই আলোচনা প্রকারান্তরে আমাদের মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা মাত্র। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার প্রিয় এই কথাসাহিত্যিকের কাছ থেকে। তার লেখার সমালোচনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। আমি আমাদের মতো অনেকের আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। কারণ তিনি যখন কোনো বিষয়ের ওপর কথা বলবেন, তখন ধরেই নিতে হবে তা অত্যন্ত গুরুতর।
বাংলাদেশে বিদ্যুত্ আমদানি না করে নতুন প্ল্যান্ট তৈরির ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। আবার সোলার সেল ভোক্তা শ্রেণীর কাছে আরও সহজলভ্য করে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে অধিক মাত্রায় বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যেতে পারে। বিদ্যুত্ আমদানিতে যে টাকা আমরা ভারতকে দিতে যাচ্ছি, তা কেন আমরা আমাদের দেশের প্রতিভা-প্রযুক্তির পেছনে ব্যবহার করছি না। এটা আমাদের বেকার সমস্যা দূর করতেও সাহায্য করবে। এসব বিষয়ে তাদের বোঝানো বা জানানোর বিষয় নয়। এগুলো তারা জানেন।
প্রতিদিন গ্যাস-বিদ্যুত্-পানির অভাবে সাধারণের প্রাণ ওষ্ঠাগত। শিক্ষার্থীরা তাদের শেষ সময়ের পড়া শেষ করতে কম বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে না। গৃহিণীরা করতে পারছেন না তাদের প্রতিদিনের রান্না। বিদ্যুতের প্রয়োজন আছে। তবে দেশের অর্থ বাইরে প্রেরণের মাধ্যমে নয়, দেশের অর্থ দেশের জনগণের মধ্যে রেখে এবং উত্পাদনশীলতার মাধ্যমে। দেশ পরিচালনায় অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। তবে গ্যাস এবং বন্দর-পথ প্রদানের মাধ্যমে নয়। কৃষিপণ্য, দেশীয় ও কুটির শিল্প, গার্মেন্ট পণ্য, ক্রোকারিজ এবং দেশে প্রস্তুতকৃত রফতানিযোগ্য সামগ্রীর রফতানির মাধ্যমে।
সরকার একটি দেশের শোষক নয়, সেবক। তাকে জনপ্রশাসনে বসানো হয়েছে জনগণের সেবার জন্য। ৩০০ আসন পেয়েও যদি একটি দল সরকার গঠন করে তাহলেও ধরে নেয়া যায় না যে, তার অযৌক্তিক যে কোনো কর্মকাণ্ড জনগণ মেনে নেবে। ফলে দেশীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা সুযোগ-সুবিধা অন্য কোনো দেশকে ব্যবহার করতে দেয়ার আগে জনমত জরিপ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বন্দর ও পথ ব্যবহারে সুযোগ দেয়া এক বিষয়। আর তাতে অন্য দেশের সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতি অন্য কথা। দেশের অভ্যন্তরে অন্য কোনো দেশের সেনাবাহিনী ট্রানজিটের নামে প্রবেশ করার সুযোগ পাবে, এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের বন্দর ও পথ ব্যবহারের প্রশ্ন যদি আসে, তাহলে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায়ও বিশ্বাস রাখতে হবে সুবিধা গ্রহণকারী দেশকে। আমাদের সেনাবাহিনী যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় সফল হতে পারে, তাহলে সে নিজের বন্দর ও পথেরও নিরাপত্তা সঠিকভাবে দিতে সক্ষম।
দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজন। কারণ প্রাকৃতিক যে সম্পদ আমাদের দেশে আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। বাংলাদেশে বিদ্যুতের জন্য আর্তনাদ আছে। আর আছে সূর্যের আশীর্বাদ। তাহলে সরকার বা দেশের বড় মানুষগুলোর মধ্যে কেন সৌর শক্তির ব্যবহার, প্রসার, প্রচার, গ্রহণযোগ্যতা এবং মানুষকে এ বিষয়ে জানানোর চেষ্টা বা ইচ্ছা নেই।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশে যোগ্য ও প্রতিভাবান লোকের অভাব নেই। শুধু অভাব রয়েছে যোগ্যতা ও প্রতিভা মূল্যায়নের সদিচ্ছার। প্রতিভা অন্বেষণ শুধু গানে নয়, জ্ঞানেও প্রয়োজন। এতে উঠে আসবে অনেক প্রতিভাবান মুখ। আর সচেতনতা আনতে হবে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের এবং শক্তির অপচয় রোধে। সরকারের মধ্যে দৃঢ়তা থাকতে হবে প্রাকৃতিক সম্পদ ও দেশীয় স্থাপনা রক্ষায়। সরকার কোনো ভুল করলে তা সাধারণ মানুষের কণ্ঠ হিসেবে বলবেন সংসদ সদস্য, লেখক, কথাসাহিত্যিক এবং বিশিষ্টজন। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের দেশকে ভালোবাসি। হতে পারেন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। হতে পারেন তিনি কথাসাহিত্যিক অথবা শ্রমিক। দেশের জন্য ক্ষতিকর প্রশ্নে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর একই ধারায় ধ্বনিত হতে হবে সর্বস্তর থেকে।

No comments

Powered by Blogger.