একদিনে তিন জোড়া খুনও হচ্ছেঃ সোনার বাংলায় এ কিসের রাজত্ব!

দেশে যেন খুনোখুনির হিড়িক পড়ে গেছে! একদিনে এখন তিন-তিনটি জোড়া খুনের ঘটনাও ঘটছে। গত বুধবারের কথাই ধরা যাক। সেদিন গুলশানে নিজের বাসায় খুন হয়েছেন এক স্কুলছাত্রীর পিতামাতা। সূত্রাপুরে হত্যা করা হয়েছে একটি সাইবার ক্যাফের দু’জন কর্মচারীকে।

তৃতীয় জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে। সেখানে প্রথমে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা আবদুস সালামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর জের ধরে গ্রামবাসী পরে পিটিয়ে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ কর্মী লাল মিয়াকে। হঠাত্ শুনলে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হতে পারে। অন্যদিকে সত্য হলো, খুন আসলে প্রতিদিনই হচ্ছে। দেশের কোথাও না কোথাও ঘাতকের অস্ত্রের আঘাতে মারা যাচ্ছে মানুষ। শুধু তা-ই নয়, খুনোখুনি বেড়েও চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। খুনের কারণগুলোও লক্ষ্য করা দরকার। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা রেষারেষির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে বিচিত্র ধরনের নানান ব্যক্তিগত কারণ। যেমন গুলশানের ঘাতক রুবেল ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমানের ১৪ বছর বয়সী স্কুলছাত্রী মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু অভিভাবকরা তো বটেই, মেয়ে নিজেও রাজি হয়নি। এই রাজি না হওয়াটাই বিরাট ‘অপরাধ’ হয়ে গেছে! খুনি রুবেল নাকি মেয়েটির কাছে জানতে চেয়েছিল, সবাই তাকে ভয় পেলেও তারা কেন ভয় পায় না? অর্থাত্ খুনিকে ভয় না পাওয়াও আজকাল ‘অপরাধ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে! এজন্যই নিজের ক্ষমতা দেখিয়েছে খুনি। মেয়ের মা-বাবাকে হত্যা করেও সে থেমে যায়নি, হত্যার পর বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েকে বলে গেছে, ‘তোর বাপ-মাকে মাইরা ফেললাম। এবার একলা থাক।’
এই ঘটনায় বিকৃত প্রেম এসেছে হত্যার প্রধান কারণ হিসেবে। বিষয়টিকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে একই বিকৃত প্রেমের শিকার হয়েছে স্কুল শিক্ষক পিতামাতার সন্তান সৌমেন বিশ্বাস অনীক। সেখানে স্কুলছাত্রটিকে দল বেঁধে হত্যা করেছে তার বন্ধুরা। একই মেয়েকে নিয়ে তাদের মধ্যে নাকি তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল! ওদিকে চট্টগ্রামে অনীক খুন হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জামালপুরে খুন হয়েছে ১৪ বছর বয়সী আরেক স্কুলছাত্র স্বাধীন। একটি মোবাইল ফোন নিয়ে বিবাদে মারা গেছে স্বাধীন। প্রথমে ছিনিয়ে নেয়ার পর ফেরত্ দিলেও খুনিরা স্বাধীনকে নাকি ‘দেখে নেয়ার’ হুমকি দিয়েছিল। সত্যিই ‘দেখে’ নিয়েছে তারা! আর দেখেও নিয়েছে এমনভাবে যাতে কেউ আর কখনও স্বাধীনকেই দেখতে না পায়! এত তুচ্ছ কারণে এত নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের কথা সভ্য কোনো দেশে কল্পনা করা যায় না। স্কুলছাত্রী মেয়ের জন্য মা-বাবাকেই বা প্রাণ হারাতে হবে কেন? কিন্তু এমন প্রশ্ন করার সুযোগই নেই বাংলাদেশে। কারণ, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন ভয়ঙ্কর হয়ে পড়েছে যখন কারও জানা নেই, কে কোথায় কখন কার হাতে কেন মারা যাবে। ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও স্তম্ভিত মানুষের আপত্তি ও প্রতিবাদ জানানোরও কোনো জায়গা নেই এখন। কারণ, গোটা দেশই খুনের রাজ্যে পরিণত হয়েছে।
এমন অবস্থার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এর সঙ্গে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় যেমন জড়িত রয়েছে তেমনি রয়েছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলা। রয়েছে ঘুষ-বাণিজ্যের বিষয়টিও। উদাহরণ হিসেবে চট্টগ্রামে নিহত অনীকের পিতামাতার কথা বলা যায়। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও অনীকের পিতামাতা থানায় মামলা করেননি, করতেও চাননি। পরে পুলিশের অব্যাহত চাপের মুখে অনীকের মা মামলা করলেও অভিযোগপত্রে ঘাতকদের কারও নাম উল্লেখ করেননি। কারণ, পুলিশের ওপর আস্থা নেই অনীকের পরিবারের। শুধু অনীকের পরিবারের কথাই বা বলা কেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে এমন মাত্র দু’চারজন লোকও পাওয়া যাবে না, যারা পুলিশকে মোটেও বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস না করার কারণও পুলিশই তৈরি করেছে। দেখা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পর পর লোক দেখানো নানা তত্পরতা দেখালেও আসামিকে গ্রেফতার করার পরিবর্তে ঘুষ-বাণিজ্যেই পুলিশের আগ্রহ অনেক বেশি। এজন্যই কখনও কখনও গ্রেফতারের নাটক সাজানো হলেও খুব কম আসামিই শাস্তি পায়। বাস্তবে তাদের হুমকি ও দাপটে উল্টো ক্ষতিগ্রস্তদেরকেই চরম আতঙ্কের মধ্যে কাটাতে হয়—যেমনটি এই মুহূর্তে কাটাচ্ছেন অনীকের পিতামাতা ও পরিবারের অন্যরা। কারও নাম না বলা সত্ত্বেও তাদের হুমকি দেয়া হচ্ছে।
এমন অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া এবং অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তত্পর করে তোলা। কয়েকটি মাত্র ঘটনার ক্ষেত্রেও খুনি ও অপরাধীদের যদি গ্রেফতার করা এবং দ্রুত বিচার আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয় তাহলেও খুনোখুনি অনেকাংশে কমে আসবে। এভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে খুনোখুনি একেবারে বন্ধও করা সম্ভব। সরকারকে সে লক্ষ্যেই ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে সোনার বাংলা খুনের বাংলা হয়ে উঠবে।

No comments

Powered by Blogger.