বৌদ্ধপল্লিতে হামলার ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন- রাজনৈতিক কর্মীসহ ২০৫ জন শনাক্ত by একরামুল হক

কক্সবাজারের রামু উপজেলার বৌদ্ধপল্লি ও মন্দিরে হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীসহ ২০৫ জনকে শনাক্ত করেছে সরকারি তদন্ত কমিটি। শনাক্ত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বেশির ভাগই জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।


তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রগুলো জানায়, কমিটি সরেজমিন তদন্ত করে এবং ১২২ ব্যক্তির বক্তব্য গ্রহণ করে। তবে উত্তম বড়ুয়া নামে যাঁর ফেসবুকে বিতর্কিত ছবি সংযুক্ত করা নিয়ে সহিংসতা হয় বলে অভিযোগ, সেই উত্তম এখনো আত্মগোপনে। তদন্তকারীরা মনে করেন, উত্তমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে ঘটনা সম্পর্কে আরও নিখুঁতভাবে জানা সম্ভব হতো।
তদন্ত কমিটি গত শনিবার রাতে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. সিরাজুল হক খানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিশনার গতকাল বৃহস্পতিবার তা স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে পাঠান। এই তথ্য নিশ্চিত করলেও বিভাগীয় কমিশনার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ঢাকায় স্বরাষ্ট্রসচিব সি কিউ কে মুশতাক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বিদেশ সফরে গেছেন। দেশে ফিরলে তাঁর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার আগের দিন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার জামায়াত-সমর্থিত চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদের বাড়িতে একটি বৈঠক হয়। তাতে গ্রেপ্তার থাকা যুবক আবদুল মুক্তাদিরও উপস্থিত ছিলেন। মুক্তাদির ঘটনার দিন উত্তমের ফেসবুকের ওই ছবির কথা প্রথম রটান। ওই চেয়ারম্যানের সঙ্গে মিয়ানমারের আরাকানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) যোগাযোগ আছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুকে বিতর্কিত ছবি ট্যাগের (যুক্ত) ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর বিভিন্ন বৌদ্ধবিহার ও বসতিতে ব্যাপক হামলা, অগ্নিসংযোগ হয়। হামলাকারীরা প্রাচীন বৌদ্ধবিহারগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এর জের ধরে চট্টগ্রামের পটিয়া এবং পরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধ ও হিন্দুমন্দির, বসতিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর সরকার চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ নূরুল ইসলামকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য তিন সদস্য হলেন: কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা হাকিম (এডিএম), বান্দরবানের জেলা পুলিশ সুপার ও কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপার।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ৬৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ঘটনার সূত্রপাত, হামলাকারীদের তাণ্ডব এবং এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে অবহেলাসহ কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। তদন্ত কমিটি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানোর জন্য ২২টি সুপারিশও করেছে।
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য ও কক্সবাজারের এডিএম মো. আবদুর রউফ বলেন, ‘আমরা স্বল্প সময়ের তদন্তে সাক্ষ্য-প্রমাণ যা পেয়েছি, তা প্রতিবেদনে তুলে ধরেছি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। কারও প্রতি কোনো অন্যায় করা হয়নি।’
সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনার সঙ্গে জড়িত হিসেবে শনাক্ত করা যে ২০৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই জামায়াত-শিবিরের লোকজন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কিছু উচ্ছৃঙ্খল সমর্থক হুজুগে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। দুই দলের এমন কিছু নেতা-কর্মীর নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ফেসবুকে বিতর্কিত ছবি সংযুক্ত করার বিষয়টি জানাজানি হলে রামুতে ওই রাতে মিছিল বের হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরাও মিছিল করে। সেই মুহূর্তে জামায়াত-শিবির ঘটনার সুযোগ নেয় এবং ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। তাঁদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদেরও অনেকে যোগ দেয়।
সূত্রমতে, রামুর সহিংসতার সঙ্গে স্থানীয় বিএনপিদলীয় সাংসদ লুৎফুর রহমানের ভূমিকার বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার রাতে তিনি রামুতে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু হামলা প্রতিরোধে তিনি কোনো ভূমিকা রাখেননি।
জানতে চাইলে সাংসদ লুৎফুর রহমান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই রাতে প্রশাসনের লোকজন আমাকে রামু বাজারে ডেকে নিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে রাত দুইটা পর্যন্ত আমি সেখানে ছিলাম। নানাভাবে মানুষকে শান্ত করার চেষ্টা করি। কিন্তু যে জনবিস্ফোরণ ঘটেছিল, তা আমাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। এটা প্রশাসনের দায়িত্ব। প্রশাসন ব্যর্থ হওয়ায় পরদিন উখিয়া ও টেকনাফেও হামলা হয়েছে। এ কথা আমি তদন্ত কমিটিকেও বলেছি।’
সূত্রগুলো জানায়, তদন্তে বেরিয়ে আসে, উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুকে বিতর্কিত ছবিটি ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ আগেই সংযুক্ত (ট্যাগ) করা হয়েছিল। তবে আবদুল মুক্তাদির এ ঘটনা প্রথম এলাকায় রটিয়েছেন বলে পুলিশের কাছে রিমান্ডে স্বীকার করেছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর বৌদ্ধপল্লিতে হামলা হয়। তার আগের দিন অর্থাৎ ২৮ সেপ্টেম্বর মুক্তাদির রামুর অদূরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলা চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তোফায়েল ছাত্রজীবনে শিবিরের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। তিনি গত জুলাই মাসে দুবাইতে আরএসও-র ১৪ সদস্যের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। এ কারণে রামুর ঘটনার সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান তোফায়েলের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি তদন্ত কমিটির কাছে জোরালো মনে হয়েছে।
জানতে চাইলে চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ গত জুলাইয়ে দুবাইতে গিয়ে ১৫ দিন অবস্থান করার কথা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন। তবে তিনি আরএসওর সঙ্গে বৈঠক বা রোহিঙ্গা কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কথা অস্বীকার করেন।
রামুতে হামলার আগের দিন তাঁর নাইক্ষ্যংছড়ির বাড়িতে আবদুল মুক্তাদির গিয়েছেন কি না—জানতে চাইলে তোফায়েল বলেন, ‘ও (মুক্তাদির) আমার আত্মীয়। আত্মীয়রা তো বেড়াতে আসতে পারেন। তবে কে কখন আসেন, সেই খবর আমি রাখি না।’
পুলিশ সূত্র জানায়, আবদুল মুক্তাদির চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র। তিনি ছাত্রশিবিরের ওই পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখার ক্রীড়া সম্পাদক। মুক্তাদিরকে ১০ অক্টোবর চট্টগ্রাম শহরের মুরাদপুর থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁকে প্রথম দফা চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি কারাগারে। তাঁকে আরও সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছে পুলিশ। এ ব্যাপারে ৩০ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত।

No comments

Powered by Blogger.