মো ইয়ান- টুকরো স্মৃতি

মো ইয়ানের দুটো টুকরো স্মৃতিতে তাঁর লেখক হয়ে ওঠার বিষয়টিই উঠে এসেছে মো ইয়ান—ডোন্ট স্পিক—কথা বোলো না যাঁরা লেখক হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই লেখক হওয়ার একটা কারণ রয়েছে, আমিও এর ব্যতিক্রম নই। কিন্তু আমি যে ধরনের লেখা লিখি, তা হেমিংওয়ে কিংবা ফকনারের মতো নয়।


আমার বিশ্বাস, আমার শৈশব অভিজ্ঞতার সঙ্গে এর একটা যোগসূত্র রয়েছে। এই অভিজ্ঞতা আমার লেখকজীবনে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। ৪০ বছর আগে ১৯৬০ দশকের গোড়ার দিকে তাকালে আমি আজকের এই আধুনিক চীনের অদ্ভুত বীভৎস একটি সময় দেখতে পাই—উন্মাদনার অভূতপূর্ব এক যুগ। একদিকে, দেশ চরম অর্থনৈতিক স্থবিরতার কবলে, মানুষ মৃত্যুকে কোনো রকমে দরজার বাইরে ঠেকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করছে, পেটে সামান্য খাবার আর পরনে তাদের জীর্ণ কাপড়। অন্যদিকে, ওই সময়টাই আবার তীব্র রাজনৈতিক আবেগের—ক্ষুধার্ত নাগরিক ক্ষুধা ভুলতে কষে বেল্ট বেঁধেছে, আবার একই সঙ্গে সাম্যবাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পার্টিকে অনুসরণের চেষ্টা করছে। আমরা তখন ক্ষুধায় মৃতপ্রায়। কিন্তু তার পরও আমরা নিজেদের মনে করছি পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ। আমরা বিশ্বাস করতাম—পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ চরম বিপন্নদশায় জীবন যাপন করছে আর যন্ত্রণার যে সাগরে তারা ডুবে যাচ্ছে, আমাদের পবিত্র দায়িত্ব সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করা। ১৯৮০ দশকে চীন বাইরের দুনিয়ায় নিজের দুয়ার খোলার পরই কেবল আমরা বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম—যেন আমরা একটি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলাম।
খুব শিগগির আমি নিজের সঙ্গে কথা বলতে শিখলাম। আমার মধ্যে বর্ণনা দেওয়ার অসনাতন মেধার বিকাশ ঘটতে থাকল; আমি কেবল সাবলীলভাবে কথা বলে যেতে থাকলাম তা-ই নয়, এমনকি ছন্দোবদ্ধভাবেও। আমার মা একবার দূর থেকে শুনল, আমি গাছের সঙ্গে কথা বলছি। আতঙ্কিত হয়ে আমার মা বাবাকে বলল, ‘তুমি কি মনে করো যে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’
পরে আমার যখন যথেষ্ট বয়স হলো, শ্রমিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে আমি বড়দের সমাজে প্রবেশ করলাম, আমার সেই গরু-ছাগল পালনের দিনগুলোয় নিজের সঙ্গে সেই যে কথা বলা শুরু করেছিলাম তা কেবল পরিবারে সমস্যারই সৃষ্টি করল।
মা কাতর হয়ে এক দিন আমাকে বলল, ‘বাবা, তোর কথা বলা কি কখনো থামবে না?’ তার চেহারার দিকে তাকিয়ে, অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি থামব। কথা বলা বন্ধ করব।
কিন্তু যখনই আমার চারপাশে মানুষ থাকে, আমার ভেতরের সঞ্চিত সব কথা বেরিয়ে আসতে শুরু করে, যেন ইঁদুরেরা সব বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এবং এরপর আসে বিষণ্নতা, আপ্লুত করা এক অনুভূতি যে আমি আমার মায়ের নির্দেশ পালন করতে পারলাম না। আর সে জন্যই বেছে নিলাম ছদ্মনাম মো ইয়ান—এর অর্থ ‘কথা বোলো না’।
কিন্তু আমার অসহিষ্ণু মা যেমন বলতেন, ‘কুকুর কখনো মলমূত্র না চেটে থাকতে পারে না, নেকড়ে কখনো মাংস ছাড়া বাঁচতে পারে না।’ আমিও কথা বলা বন্ধ করতে পারলাম না। এটা আমার এমন এক অভ্যাস, যা আমার সহলেখকদের অনেককেই আঘাত করেছে। কারণ, অবিসংবাদিতভাবে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে বার্নিশে না মোড়ানো অকাট্য সত্য।
এখন আমি আমার মধ্যবয়সে, আমার শব্দস্রোত কমে আসছে, আমার মায়ের আত্মা আমাকে দেখে, নিশ্চয়ই স্বস্তি পায়।
[২০০১ সালে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ শিফু, ইউল ডু অ্যানিথিং ফর অ্যা লাফ-এর মুখবন্ধ থেকে অনূদিত]

পাহাড়ের গর্ত থেকে হামাগুড়ি দিয়ে
ইংরেজিতে অনূদিত আমার প্রথম উপন্যাস রেড সরগাম। ইংরেজিতে অনূদিত হাওয়ার আগেই এই উপন্যাস নিয়ে চীনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঝাং ইমো ছবি বানিয়েছেন এবং তা বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বড় পুরস্কার পেয়েছে। চলচ্চিত্রয়াণের কারণেই উপন্যাসটি বিখ্যাত হয়েছে। চীনে যখন কেউ আমার নাম বলে, লোকজন বলে, ‘ওহ্ রেড সরগাম!’ আমার অবিনীত উচ্চারণ ক্ষমা করবেন: সত্যি কথাটি হচ্ছে, চলচ্চিত্রায়ণের আগেই আমার এই উপন্যাস চীনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। ঝাং ইমোই প্রথম আমার উপন্যাস থেকে লাভবান হয়েছেন, পরে আমার উপন্যাস লাভবান হয়েছে তাঁর তৈরি চলচ্চিত্র থেকে।
আমি পিএলএ (পিপলস লিবারেশন আর্মি) আর্ট কলেজে থাকা অবস্থায় রেড সরগাম উপন্যাসটি লিখি। উৎসাহী পাঠকেরা লেখককে সাহিত্য নিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেন। ঐতিহ্যগত শৈলী অনুসরণ করে গল্প লিখতে কিংবা সে ধরনের গল্প পড়তে মানুষ আর উৎসাহী নয়। পাঠকের দাবি, লেখক আরও সৃষ্টিশীল হয়ে উঠুন; আরও আবিষ্কারক্ষম হয়ে ওঠা ছাড়া আমরা আর কিছু ভাবতে পারি না।
সে সময় আমি কেবল পাহাড়ের গর্ত থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসেছি। সাহিত্যতত্ত্বের জ্ঞান দূরে থাকুক, আমি তখন টেলিফোন ব্যবহার করতেও জানতাম না। আমি ঘরের ভেতরে লুকিয়ে যা খুশি তা-ই লিখে গেছি। এখন যেহেতু তত্ত্বকথার কিছু প্রাথমিক জ্ঞান আমার হয়েছে, আমি অনুধাবন করছি, দাসানুদাসের মতো প্রতিষ্ঠিত ধারাকে অনুসরণ করে সত্যিকারের নতুন আবিষ্কার হতে পারে না। যার সঙ্গে আপনি সত্যিই পরিচিত, সততার সঙ্গে তা তুলে ধরাই সত্যিকারের সৃষ্টিশীলতা। আপনার যদি অনুপম অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, আপনি যা লিখবেন, তা অনুপমই হয়ে উঠবে। অনুপম হওয়াই নতুন হয়ে প্রকাশিত হওয়া। আপনি যদি ভিন্ন কিছু লিখে থাকেন, তা হলে আপনার হাতে অনুপম শৈলীর সৃষ্টি হবে। ব্যাপারটা গান পাওয়ার মতো; প্রশিক্ষণ আপনার টেকনিকে পরিবর্তন আনতে পারে। কিন্তু স্বরে নয়, যত অধ্যবসায়ের সঙ্গে একটি কাককে প্রশিক্ষণ দিন না কেন, কাক কখনো কোকিলের মতো গাইতে পারবে না। অন্যত্র আমি যখন কথা বলেছি, আমি আমার শৈশবকে তুলে এনেছি। শহরের শিশুরা মায়ের সোহাগে যখন দুধ খেয়েছে, রুটি খেয়েছে, আমি ও আমার বন্ধুরা ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। পৃথিবীর কোনো ধরনের সুস্বাদু খাবার আমাদের জোটেনি, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। আমরা গাছের মূল ও ছাল-বাকল খেয়ে বেঁচে ছিলাম। মাঠ থেকে খাবার কুড়িয়ে এনে এক বেলার সাধারণ খাবার তৈরি করতে পেরে আমরা ভাগ্যবান বোধ করেছি। আমাদের লোলুপ দাঁতের ক্রমাগত কামড়ে আমাদের গ্রামের গাছগুলো খালবাকলহীন হয়ে পড়ত।
যখন শহরের শিশুরা স্কুলে গান গাইত, নাচত, আমি তখন গ্রামের মাঠে গরু-ভেড়া চরাতাম। তখন থেকে নিজের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলি। আমার লেখায় বারবার আমি ক্ষুধা আর নৈঃসঙ্গের কথা বলে গিয়েছি।
[মো ইয়ানের শর্ট স্টোরিজ-এর ভূমিকা থেকে]

No comments

Powered by Blogger.