তিন দলের তিন হোতা by তোফায়েল আহমদ

বৌদ্ধ জনপদে হামলার তদন্তে জড়িত হিসেবে শনাক্ত হওয়া দুই শতাধিক ব্যক্তির মধ্যে সবার ওপরে উঠে এসেছে ভয়ংকর আট খুনের মামলার আসামি জামায়াত নেতা তোফাইল আহমেদের নাম। অভিযোগ করা হয়েছে বিএনপি দলীয় এমপি লুৎফুর রহমান কাজল এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধেও।


তাঁদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য-
জামায়াত নেতা তোফাইল আহমেদ : বর্তমানে জামায়াত নেতা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান তোফাইল আহমেদ (৪৭) চট্টগ্রামের নৃশংস আট খুনের অন্যতম আসামি। রামুর বৌদ্ধ জনপদে সহিংস ঘটনার নেপথ্যে সাবেক এই দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডারের জোরালো ভূমিকা রাখার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত ভয়ংকর ওই হত্যাকাণ্ডের আসামি হয়েও তিনি খালাস পেয়ে যান। তিনি মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অরণ্যঘেরা নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে মৌলবাদী-জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা এবং রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংগঠন 'রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন'-এর (আরএসও) সঙ্গে দীর্ঘদিনের সখ্যের কারণে তিনি এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। শুধু নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়ই তিনি এখন দেড় হাজার একরেরও বেশি জমির মালিক।
কক্সবাজার জেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের বালুবাসা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন তোফাইল আহমেদ। তাঁর বাবা মরহুম আবুল হোসেন ছিলেন ইউনিয়নের মেম্বার। বালুবাসা গ্রামের পার্শ্ববর্তী হাজীর পাড়া পূর্ব পাহাড়ে ছিল জঙ্গি সংগঠন আরএসওর ঘাঁটি। ওই ঘাঁটিতে যাওয়া-আসা ছিল তোফাইলের। আরএসওর অত্যাধুনিক অস্ত্র বেচাকেনা এবং অস্ত্রের চালান শিবির ক্যাডারদের কাছে সরবরাহ থেকে শুরু করে সব কাজই করতেন তোফাইল আহমেদ- এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর।
পরবর্তী সময়ে কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন ছেড়ে পাশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন তোফাইল আহমেদ। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। টানা দুই বার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ও উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তিনি মিয়ানমারের আরাকান থেকে শত শত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তাদের ইউনিয়ন পরিষদের জন্মসনদ এবং জাতীয়তা সনদ দিয়েছেন। অনেকের পাসপোর্ট বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকার মালিক হয়েছেন।
এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, তোফাইল আহমেদ আফগানিস্তান, সিরিয়া, পাকিস্তান ও দুবাই সফর করেছেন। নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের বাসিন্দা মৌলভী কলিমুল্লাহ নামের একজন মাদ্রাসা মোহতামেমসহ তিনি এসব দেশ সফর করেন। নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তারেক রহমান গত রাতে কালের কণ্ঠকে জানান, তোফাইল আহমেদের টাকার উৎস হচ্ছে রোহিঙ্গা এবং আরএসও। এলাকার লোকজনকে জোর-জুলুম করে সহায়-সম্পদ কেড়ে নেওয়ায় কোনো জুড়ি নেই তাঁর। তারেক রহমান আরো বলেন, 'তিনি আমার পৈতৃক ভূমিও কেড়ে নিয়েছেন। চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে তাঁর সঙ্গে সেখানে কেউ পেরে ওঠে না। মিয়ানমার থেকে শত শত রোহিঙ্গা এপারে নিয়ে এসে তিনি বসতি গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ভোটার তালিকাভুক্ত করেন।'
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক শামীম ইকবাল কালের কণ্ঠকে জানান, ছাত্রশিবিরে কোনো পদে না থেকেও তোফাইল আহমেদ সব কাজ করতেন। বর্তমানে তিনি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা জামায়াতের সহসভাপতি হিসেবে রয়েছেন।
অভিযোগের ব্যাপারে তোফাইল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দেখছেননি ভাই, আমাকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বৌদ্ধপল্লীর ঘটনায়।' কী করে এ কথা জানলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি এখন ইন্টারনেট খুলে অনলাইনে রয়েছি। সেখানেই দেখছি আগামীকালের কাগজে আমার নাম প্রকাশিত হবে। আসলে আমি এ ঘটনায় কোনোভাবেই জড়িত নই।' তিনি আরো বলেন, 'মুক্তাদির আমার ভায়রার সন্তান ছাড়া তার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক আমার নেই।'
এমপি কাজল : কক্সবাজার সদর-রামু আসনের বিএনপিদলীয় এমপি লুৎফুর রহমান কাজলের নাম ঘটনার পর থেকেই সর্বত্র আলোচিত হয়ে আসছে। এমনকি তদন্ত কমিটিও তাঁর সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেবী চন্দের মোবাইল কল পেয়ে এমপি কাজল ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এ সময় তিনি রামু চৌমুহনী স্টেশনে গিয়ে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল সরওয়ার কাজলের সঙ্গে বক্তব্য দেন। তিনি (এমপি কাজল) এ সময় জঙ্গি-সম্পৃক্ততার অভিযোগে এর আগে গ্রেপ্তারকৃত হাফেজ আবদুল হককে মোবাইল ফোনে ঘটনাস্থলে আসার জন্য ডাকেন। এমপি কাজলের বক্তব্য দেওয়ার সময়ই বৌদ্ধপল্লীর লাল চিং ও সাদা চিং মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সহিংস ঘটনায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে এমপি কাজল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি উসকানি দেওয়ায় জড়িত নই। ক্ষুব্ধ জনগণকে শান্ত করার জন্য আমি যথাযথ চেষ্টা করি। কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণেই ঘটনাটি ঘটেছে।'
সাদ্দাম হোসেন : ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার ছবিটি নিয়ে দ্বিতীয় মিছিলটি বের করা হয়েছিল রামুর মণ্ডলপাড়া এলাকা থেকে। এর আগে ফারুকের মোবাইলের দোকান থেকেই প্রথম প্রতিবাদ মিছিলটি বের করা হয়েছিল। দ্বিতীয় প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাদ্দাম হোসেন। তিনি রামুর মণ্ডলপাড়ার বাসিন্দা। সাদ্দাম রামুর আওয়ামী ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে আওয়ামী লীগের কোনো সংগঠনের কোনো পদে তিনি নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম গত রাতে কালের কণ্ঠকে জানান, আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সাদ্দামের সম্পৃক্ততা রয়েছে এটা সত্য, তবে তিনি কোনো পদে নেই। ঘটনার পর থেকে সাদ্দাম ও মৎস্যজীবী লীগকর্মী ভুট্টোসহ আরো কয়েকজনের নাম আসায় তাঁরা বর্তমানে পলাতক। তাই তাঁদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.