অমোঘ দাওয়াই by মো ইয়ান

সেদিন বিকেলে সশস্ত্র কর্মী বাহিনীর লোকেরা মা কুইশানের সাদা চুনকাম করা বাড়ির দেয়ালে একটা নোটিশ টানিয়ে দিল, বাড়িটার মুখ রাস্তার দিকে; নোটিশে লেখা আগামীকাল সকালের মৃত্যুদণ্ডগুলো ওই একই জায়গায় হবে: জিয়াও নদীর ব্রিজের দক্ষিণ মাথায়।


সমস্ত শক্তসামর্থ্য গ্রামবাসীকেই যেতে হবে ওখানে। সে বছর এত বেশি মৃত্যুদণ্ড হয়েছে যে মানুষের আর ওসব নিয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই, অতএব উপস্থিতি ‘বাধ্যতামূলক’ করে দেওয়া ছাড়া অন্য বিকল্পও নেই।
বাবা যখন মটরশুঁটির-তেলে জ্বলা বাতিটা জ্বালাতে উঠলেন, তখনো ঘরের ভেতরটা ঘন-কালো অন্ধকার। পুরু জ্যাকেটটা গায়ে চাপিয়ে তিনি আমাকে ডাকতে লাগলেন, কিন্তু এত বেশি ঠান্ডা যে গরম কম্বলের নিচে শুয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ইচ্ছা নেই। বাবা শেষমেশ আমার গরম কম্বল টান দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওঠ, সশস্ত্র কর্মী বাহিনী তাদের কাজ শেষ করতে সময় লাগায় না। আমরা দেরি করলে, আমাদের সুযোগ শেষ।’
বাবার পেছন পেছন আমি গেট থেকে বের হলাম। দূরের আকাশে আলো ফুটছে। রাস্তা বরফশীতল আর ফাঁকা; উত্তর-পূর্ব থেকে আসা হাওয়া রাতের বেলায় সব ধুলো সাফ করে নিয়ে গেছে; ধূসর বড় রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মা কুইশানের বাড়ির উঠোন পার হচ্ছি (সশস্ত্র কর্মী বাহিনীর লোকেরা ওই বাড়িতেই থাকে), জানালার একটা আলো দেখলাম, আর হাঁপরের আওয়াজ কানে এল আমাদের। বাবা নরম গলায় বললেন; ‘পা চালা। কর্মী বাহিনী নাশতা সারছে।’
বাবা আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন নদীতীরের শেষ মাথা পর্যন্ত; ওখান থেকে আবছা দেখা যাচ্ছে পাথুরে ব্রিজটার কাঠামো; নদীর পানিতে বরফের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম: ‘বাবা, আমরা লুকাব কোথায়?’
‘ব্রিজের নিচে।’
ব্রিজের নিচে কিছু নেই, ঘন অন্ধকার শুধু, বরফ জমে যাওয়ার মতো ঠান্ডার কথা না হয় নাই-ই বললাম। আমার মাথার খুলি টন টন করে উঠল, তাই বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার মাথা কেমন টন টন আর শির শির করছে কেন বাবা?’
‘আমারও করছে,’ বাবা বললেন। ‘ওরা এ জায়গাটায় এত বেশি মানুষ মেরেছে যে যারা অন্যায়ভাবে মারা পড়েছে, তাদের ভূতে ভর্তি এখানটা।’
ব্রিজের নিচের অন্ধকারের মধ্যে আমি কিছু লোমওয়ালা জন্তু-জানোয়ারের নড়াচড়া খেয়াল করলাম। ‘ওই যে ওরা!’ চিৎকার করে বললাম।
‘আরে না, ওরা ভূত না,’ বাবা বললেন, ‘ওগুলো লাশ খাওয়া কুকুর।’
আমি পেছনে সরতে লাগলাম, একসময় আমার পিঠ ঠেকল হাড্ডি পর্যন্ত ঠান্ডা করে দেওয়া ব্রিজের একটা পাইলিংয়ের গায়ে। আমার খালি মনে পড়ছে দাদির কথা, তাঁর চোখ দুটো ছানি জমে এমন ঝাপসা দৃষ্টি হয়ে গেছে যে তাঁকে অন্ধ বললেও ভুল হবে না।
বাবা তাঁর পাইপ জ্বালালেন, তামাকের সুগন্ধি আমাদের ঘিরে ধরল খানিক পরেই। আমার ঠোঁট জমে পাথর হয়ে যাচ্ছিল। ‘বাবা, আমি একটু বের হয়ে দৌড়াদৌড়ি করে শরীরটা গরম করে আসি? আমি তো জমে গেলাম।’
বাবার উত্তর এটুকুই: ‘দাঁত ঠকঠক করে শরীর গরম করো। ভোরের আলো লাল থাকা পর্যন্ত সশস্ত্র কর্মী বাহিনী বন্দীদের গুলি করে, সাদা হয়ে এলে আর করে না।’
‘আজ সকালে ওরা কাদের মারবে, বাবা?’
‘আমি জানি না,’ বাবা বললেন। ‘তবে জানতে আর বেশি সময় লাগবে না। খুব চাচ্ছি কমবয়সী কাউকে মারুক আজ।’
‘কেন?’
‘যত বয়স কম, তত শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকে। ফল ভালো পাওয়া যাবে তা হলে।’
আমার আরও কিছু কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বাবা বুঝলাম প্রায় অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। ‘আর কোনো প্রশ্ন না। আমরা এখানে যাই বলি, সব ওখানে ওপরে শোনা যায়।’
আমরা যখন কথা বলছি, আকাশের রং হয়ে উঠেছে মাছের পেটের মতো সাদা। গ্রামের কুকুরগুলো দল বেঁধেছে, জোরে ঘেউ ঘেউ করছে, কিন্তু তার ভেতর থেকেও ছাপিয়ে আসছে মহিলাদের বিলাপের ধ্বনি। বাবা আমাদের লুকানোর জায়গা থেকে বের হয়েছেন, একটুক্ষণের জন্য নদীর পাশে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে রেখেছেন গাঁয়ের দিকে। এবার আমার সত্যি ভয় পাওয়া শুরু হলো। পচা-মাংসখেকো কুকুরগুলো ব্রিজের নিচে ঘুরঘুর করছে, ওরা ক্রুব্ধ চোখে তাকিয়ে আমাকে দেখছে, মনে হয় যেন আমার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলবে। আমি জানি না, কোনো শক্তিবলে ওখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বের হওয়ার বদলে আমি ওখানেই আটকে থাকলাম। বাবা হামা দিয়ে ফিরে এলেন। ভোরের হালকা আলোয় আমি দেখলাম বাবার ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু বুঝতে পারলাম না তা ভয়ে নাকি ঠান্ডায়। ‘কিছু শুনতে পেলে বাবা?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘চুপ থাক,’ ফিসফিস করে বললেন বাবা। ‘শিগগিরই ওরা এসে পড়বে। যাদের মারা হবে তাদের বাঁধাছাদা হচ্ছে শুনতে পেলাম।’
আমি বাবার খুব কাছে সরে গেলাম, আগাছার একটা ঝোপঝাড়ের ওপর বসলাম। কান খাড়া করে শুনলে গ্রামে রামশিঙা বাজার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, সেই শব্দের সঙ্গে মিশে আছে এক লোকের কর্কশ কণ্ঠস্বর: ‘গ্রামবাসী—মৃত্যুদণ্ড দেখার জন্য ব্রিজের দক্ষিণ মাথায় চলে যাও—অত্যাচারী জমিদার কুইশানকে গুলি করে মারা হবে—আরও গুলিতে মরবে তার বউ—গ্রামের পুতুল মোড়ল লুয়ান ফেঙশান—এ আদেশ সশস্ত্র কর্মী বাহিনীর প্রধান নেতা ঝাঙের—যারা যাবে না তাদের দালাল হিসেবে শাস্তি দেওয়া হবে।’
আমি বাবার নরম ক্ষুব্ধ গলায় অসন্তুষ্ট বিড়বিড়ানি শুনলাম: ‘ওরা মা কুইশানের সঙ্গে এটা করছে কেন? তাঁকে কেন গুলি করা হবে? সবাইকে মারলেও, তাঁকে তো মারা উচিত নয়।’
আমার মনে হলো, বাবাকে জিজ্ঞেস করি কেন তাঁদের মা কুইশানকে গুলি করা ভুল কাজ; কিন্তু আমি মুখ খুলতেও পারিনি, শুনলাম রাইফেলের একটা ঠা-ঠা শব্দ, একটা বুলেট শাঁ শব্দ করে দূরে গিয়ে পড়ল, দূরে ওপরে আকাশে কোথাও। এরপর শোনা গেল, আমাদের দিকে আসা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ, একেবারে ব্রিজের মাথার দিকে যাচ্ছে ওটা; ব্রিজের ওপরে উঠতেই ঘোড়ার পায়ের এমন একটা শোরগোল হলো যেন কোনো ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে। আমি আর বাবা আরও গুটিসুটি মেরে বসলাম; পাথরের ফাঁক দিয়ে সূর্যের রুপালি আলো ঢুকে পড়েছে; আমরা দুজনেই ভয়ে-আতঙ্কে বুঝতে পারছি না যে কী ঘটতে যাচ্ছে।
কে যেন হেঁটে রেলিংয়ের পাশে এল, ছর ছর করে ব্রিজের ওপর থেকে প্রস্রাব করতে লাগল। প্রস্রাবের কী কড়া, মাথা-ধরানো গন্ধ!
‘আসো, ফিরে যাই, ‘হাঁসের মতো প্যাকপ্যাক করে কথা বলে উঠল কে যেন। ‘মৃত্যুদণ্ডের সময় হয়ে এসেছে, চলো সবাই।’
বাবা আমাকে ফিসফিস করে জানালেন, হাঁসের মতো গলার ওই লোকটা সশস্ত্র কর্মী বাহিনীর প্রধান, তাঁকে জেলা প্রশাসন থেকে বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পার্টি থেকে বিশ্বাসঘাতক ধরে ধরে খতম করার জন্য; সবাই তাঁকে ডাকে নেতা ঝাঙ নামে।
পুবের আকাশে অনেক নিচুতে তুলো তুলো মেঘ ধীরে ভিড় করা শুরু করেছে; কিছুক্ষণের মধ্যে ওই মেঘগুলোও লাল-গোলাপি হয়ে উঠল। এতক্ষণে আমাদের চোখে পড়ল, আমরা যেখানে লুকিয়ে আছি সেখানকার মাটিতে কুকুরের বিষ্ঠার দলা বরফ হয়ে জমাট বেধে আছে, সেই সঙ্গে আরও আছে ছেঁড়া কিছু কাপড়চোপড়, মাথার চুলের গোছা, আর কুকুরের চুষে খাওয়া মানুষের মাথার খুলি। দেখতে এমন বীভৎস যে আমি অন্যদিকে তাকালাম। বাবার দিকে ঘুরলাম; তাঁর নিঃশ্বাসের সাদা ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছি। সময় মনে হয় থেমে গেছে। তারপর বাবা একসময় বললেন, ‘এসে গেছে।’
ব্রিজের মাথায় মৃত্যুদণ্ডের দলটার আসাকে স্বাগত জানানো হলো ধাতবঘণ্টা বাজিয়ে, নীরব পা ফেলে দলটা পৌঁছাল। এরপরই গম্ভীর গলায় একজন চিৎকার করে উঠল: ‘নেতা ঝাঙ, নেতা ঝাঙ, আমি তো সারা জীবনে কোনো অন্যায় করিনি...।’
বাবা খুব আস্তে বললেন, ‘এটাই মা কুইশান।’
এবার আরেকটা গলা, এবারেরটা সাধারণ একটা কণ্ঠ আর আবেগে ফেটে পড়ছে: ‘নেতা ঝাঙ দয়া করো...। গ্রামের মোড়ল কে হবে তা লটারি করে ঠিক করা হয়েছিল; আমি মোড়ল হতে চাইনি...লটারি হয়েছিল; আমার কপাল খারাপ...। নেতা ঝাঙ, একটু দয়া দেখাও, আমার এই কুকুরের জীবনটার জন্য একটু রহম করো...। ঘরে আমার ৮০ বছরের বুড়ো মা, তাঁকে আমি ছাড়া কে দেখবে?
বাবা আবার ফিসফিস করে বললেন, ‘এটা লুয়ান ফেঙশান।’
এর পরে একটা তীক্ষ গলা শোনা গেল: ‘নেতা ঝাঙ, তুমি যখন আমাদের বাসায় এসে উঠলে, তোমাকে যত্ন করে খাইয়েছি আমি, সবচেয়ে ভালো ওয়াইনটা তোমাকে দিয়েছি। এমনকি আমার আঠারো বছরের মেয়েকে তোমার দরকারের জন্য তুলে দিয়েছি। নেতা ঝাঙ, তোমার দিলটা তো লোহা দিয়ে বানানো নয়, না কি?’
বাবা বললেন, ‘এটা মা কুইশানের বউ।’
সবশেষে আমি শুনলাম এক মহিলা ষাঁড়ের মতো গোঙাচ্ছেন: ‘উউ—লা-আহ—ইয়া—।’
বাবা ফিসফিসে স্বরেই জানালেন, ‘এটা লুয়ান ফেঙশানের বোবা বউ।’
একটা শান্ত, গা-ছাড়া ভঙ্গিতে নেতা ঝাঙ বলল, ‘তোমরা অযথা এ রকম অস্থির হচ্ছ কেন? তোমাদের গুলি করা হবেই। তাই বলছি চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ করো। একদিন না একদিন তো মরতে হবেই। তোমরা আগে মরলে বরঞ্চ আগে আগে পৃথিবীতে ফিরতে পারবে অন্য কেউ হয়ে।’
ঠিক তখনই মা কুইশান জোরে ভিড়ের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠলেন, ‘হে গ্রামবাসী, বাচ্চা, বয়স্করা সবাই—আমি মা কুইশান কোনোদিন তোমাদের কোনো ক্ষতি করিনি। আমি চাইছি, তোমরা এখন আমাকে বাঁচানোর জন্য মুখ খোলো।’
অনেক লোকজন সশব্দে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল, তারা মরিয়া হয়ে মিনতি জানাল, ‘দয়া করো নেতা ঝাঙ। ওদের মেরো না। ওরা ভালো লোক, ওরা সবাই ভালো...।’
কমবয়সী একটা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এল সব হই হট্টগোল ছাপিয়ে: ‘নেতা ঝাঙ, আমি বলি কী, এই চার কুত্তার বাচ্চাকে ব্রিজের ওপর কুকুরের ভঙ্গিতে বসতে বলি, তারপর একশবার ওরা আমাদের মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করুক, কেবল তার পরই আমরা ওদের কুত্তার জীবন ফিরিয়ে দিই। তুমি কী বলো নেতা?’
‘গাও রেনশান, বুদ্ধি বটে তোমার!’ নেতা ঝাঙ বিপজ্জনকভাবে খেঁকিয়ে উঠলেন। ‘তুমি বলতে চাইছো, আমি ঝাঙ কোনো প্রতিহিংসাপরায়ণ দানব? আমার মনে হয়, তুমি একটু বেশি দিন মিলিশিয়ার প্রধান ছিলে! যতসব! এই গ্রামবাসী, সব এখন উঠে দাঁড়াও। এই ঠান্ডার মধ্যে হাঁটু গেঁড়ে বসার দরকার নেই। আমাদের কথা পরিষ্কার। কেউ ওদের বাঁচাতে পারবে না, অতএব সবাই দাঁড়াও বলছি।’
‘পথ ছাড়ো, জায়গা করো!’ ব্রিজের মাথায় অনেক অল্পবয়স্ক ছেলেপেলে, মোটামুটি নিশ্চিত যে ওরা সবাই সশস্ত্র কর্মী বাহিনীর সদস্য, ব্রিজ থেকে হাঁটু গেঁড়ে বসা লোকজন সরাতে লাগল।
এবার মা কুইশান তাঁর আরজি জানাতে লাগলেন আকাশের দিকে: ‘ওই আকাশের বুড়ো, তুমি কি অন্ধ হয়ে গেছো? এই আমি, মা কুইশান, আমার সারা জীবনের ভালো কাজের ফল এই মাথায় বুলেট খেয়ে মরা? ঝাঙ কুদে, তুই শুয়োরের বাচ্চা, তোর মরণ বিছানায় হবে না রে, মনে রাখিস কথাটা। শুয়োরের বাচ্চা তুই—।’
‘গুলি চালাও!’ নেতা ঝাঙ ষাঁড়ের মতো গর্জে উঠল। ‘না কি তোমরা চাচ্ছো, ওর ওই সব বিষঝাড়া কথাবার্তা শুনতে থাকব আমরা?’
মাথার ওপর ব্রিজে আমরা দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ শুনলাম। ‘হাঁটুর ওপর বসো!’ ব্রিজের দক্ষিণ মাথায় কে যেন বলল, ‘সবাই রাস্তা ছাড়ো, সবাই।’ ব্রিজের উত্তর মাথা থেকে একটা চিৎকার শুনলাম।
ঠা-ঠা-ঠা—তিনটা গুলির শব্দ।
গুলির বিস্ফোরণ আমার কান ফুটো করে ঢুকে গেল যেন, কানের ভেতরে এমন ধপ ধপ করতে লাগল যে মনে হলো আমি কালা হয়ে গেছি। একটা বড়, বিশাল মানুষের শরীর ধীরে ধীরে ব্রিজের ওপর থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ল। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ রক্তের সুতো বেরোচ্ছে ওটার মাথা থেকে।
আরও একবার ব্রিজের ওপর পায়ের শব্দ ছুটে গেল উত্তর থেকে দক্ষিণে, আরও একবার চিৎকার: ‘হাঁটুর ওপর বসো,’ দক্ষিণ মাথায় এই চিৎকার আর উত্তর মাথায় আরও একবার ‘সবাই রাস্তা ছাড়ো!’ তারপর আরও তিনটা গুলির আওয়াজ—লুয়ান ফেনশাঙের শরীরটা, মাথা টুপিছাড়া আর গায়ে পুরু একটা কোট, গড়িয়ে, নদীর তীরে পড়ল মাথা নিচমুখো হয়ে; প্রথমে ধাক্কা খেল মা কুইশানের শরীরে, তারপর গিয়ে পড়ল এক পাশে।
এটার পর সবকিছু অনেক সহজ হয়ে এল। আরও শোনা গেল, একগাদা গুলির আওয়াজ তার পর দুটো আলুথালু নারীদেহ নিচে গড়িয়ে পড়ার শব্দ ও দৃশ্য, তাদের হাত পা আকাশে উড়ছে, শেষে ভেঙেচুরে পড়ছে তাদের পুরুষদের গায়ের ওপরে।
আমি শক্ত করে বাবার হাত আঁকড়ে ধরলাম, আমার ফোমভরা পুরু প্যান্টে অনুভব করলাম গরম, ভেজা একটা জলের ধারা।
কমপক্ষে আধা ডজন মানুষ আমাদের ঠিক মাথার ওপর ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বজ্রের মতো চিৎকারে কান বন্ধ হওয়ার জোগাড়: ‘লাশগুলো পরীক্ষা করে দেখব, নেতা?’
‘তার কী দরকার? ওদের ঘিলু তো সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। সবুজ পাথরের সম্রাট স্বয়ং নিচে নেমে এলেও এখন আর ওদের বাঁচাতে পারবে না।’
‘চলো সবাই যাই! বুড়ো গুওর বউ আমাদের জন্য মটরশুঁটি গাঁড়িয়ে দই বানিয়েছে। সেই দই আর তেলের পিঠা খাওয়া যাবে, চলো।’
তারা ব্রিজ পার হলো, উত্তর দিকে যাচ্ছে, তাদের পায়ের শব্দ শুনতে হিমবাহ গড়িয়ে যাওয়ার শব্দের মতো লাগছে। তারপর আবার সব শান্ত।
বাবা আমাকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিলেন। ‘অপদার্থের মতো ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকিস না। চল, কাজ সারি।’
আমি চারপাশে তাকালাম, কিন্তু বাবা কী বললেন কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার নিজের বাবাকে অচেনা লাগছে বলব না, কিন্তু তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই ধরতে পারছি না।
‘হাহ্?’ আমি শুধু একটুকুই বলতে পারলাম।
‘ভুলে গেছিস তুই?’ বাবা বললেন। ‘আমরা এখানে এসেছি তোর দাদির জন্য একটা ওষুধের খোঁজে। তাড়াতাড়ি করতে হবে, লাশ কাটতে আসা লোকেরা আসার আগেই কাজ শেষ করতে হবে।’
কথাগুলো কানের মধ্যে তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে, আমি দেখলাম সাত-আটটা বুনো কুকুর, একেকটা যেন একেক রঙের, নদীর ওখান থেকে লম্বা ছায়া ফেলে পা টেনে টেনে আসছে এদিকে; আমাদের উদ্দেশেই ঘেউ ঘেউ করছে। বাবা কয়েকটা ইটের টুকরো তুলে কুকুরগুলোর দিকে ছুড়ে মারলেন। কুকুরগুলো তড়িঘড়ি ছুট লাগাল নানা দিকে। তারপর বাবা তাঁর কোটের পকেট থেকে বের করলেন একটা মাংস কাটার ছুরি, কুকুরগুলোকে ভয় দেখালেন ওটা নাড়িয়ে। তারপর কোমরের ফিতা শক্ত করে বাঁধলেন, হাতা গুটালেন জামার। ‘চারদিকে চোখ রাখিস,’ বললেন বাবা।
যেভাবে ইগল পাখি ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের ওপর, সে রকম চটপট বাবা নারী শরীর দুটো টেনে সরালেন, তারপর মা কুইশানকে চিত করলেন। মা কুইশানের মুখোমুখি এখন বাবা। হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লেন, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে মা কুইশানের শরীরকে প্রণাম জানালেন। ‘দ্বিতীয় প্রভু মা কুইশান,’ প্রার্থনার সুরে বাবা বললেন, ‘ভক্তি আর সন্তানসুলভ কাজেরও সীমা থাকে। আমি যা করছি তা নিজের অপছন্দেই করছি।’
দেখলাম মা কুইশানের শরীরটা যেন একটু নড়ে উঠল। একটা হাত তুলে রক্তমাখা মুখ মুছলেন। ‘ঝাঙ কুদে,’ অস্ফুট উচ্চারণ। মনে হলো হালকা এক হাসির রেখা দেখলাম তাঁর চেহারায়, ‘নিজের বিছানায় তোর মরণ হবে না।’
বাবা চেষ্টা করলেন এক হাত দিয়েই মা কুইশানের চামড়ার কোটটার বোতামগুলো খুলতে, কিন্তু অতিরিক্ত কাঁপুনিতে ব্যাপারটা সামলাতে পারলেন না। ‘এই ছেলে,’ আমি তাকে বলতে শুনলাম ‘ছুরিটা ধর আমার জন্য।’
আমার মনে আছে, আমি ছুরি ধরার জন্য এগিয়ে গেছি, কিন্তু তার আগেই ছুরিটা বাবা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে মা কুইশানের বুকের ওপরের হলুদ বোতামগুলো খোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন। গোল, সোনালি হলুদ, শিম বিচির মতো বড় বড় বোতাম, ওগুলোকে ঘিরে থাকা ফিতাগুলো থেকে টেনে খোলা সোজা ব্যাপার নয়। আরও অধৈর্য হয়ে বাবা এবার ওগুলো পোঁচ দিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন, ঝাঁকি দিয়ে কোটটা খুললেন; কিন্তু সেটার নিচে আরেকটা সাদা লাইনিং। গেঞ্জির মতো দেখতে সাটিনের একটা কাপড়, সেটার একই ধরনের বোতাম, বাবা ওগুলোও পোঁচ দিয়ে কেটে ফেললেন। গেঞ্জির পরে এবার পেট বেড় দেওয়া আরেকটা পোশাক। বাবাকে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে শুনলাম। ছুরির পোঁচে কাপড়টা কেটে খুলে এক পাশে ছুড়ে দিলেন বাবা। এবার শেষমেশ মা কুইশানের গোল পেট আর সমান বুক বেরিয়ে এল আকাশের নিচে। বাবা হাত বাড়ালেন, কিন্তু তার পরই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তার চেহারা তখন সোনালি রঙের। আমাকে বললেন, ‘দ্যাখ তো ওর হূৎস্পন্দন এখনো আছে কি না।’
আমার মনে আছে, আমি নুয়ে গেলাম, মা-এর বুকের ওপর আমার হাতটা রাখলাম। কোনো খরগোশের হূৎস্পন্দন থেকে জোরে হবে না, তবে তাঁর হূৎপিণ্ড তখনো সচল।
‘দ্বিতীয় প্রভু মা কুইশান,’ আমার বাবা বললেন, ‘তোমার ঘিলু বেরিয়ে মাটিতে পড়েছে, এমনকি সবুজ পাথরের সম্রাট নিজে এসেও তোমাকে বাঁচাতে পারেননি, তাই বলছি আমাকে পুত্রস্নেহ দেখাতে দাও, দেবে না?’
বাবা তাঁর দাঁত থেকে ছোরাটা আবার হাতে নিলেন, বুকের ওখানটায় ছোরাটা ওপর নিচ করলেন, বোঝার চেষ্টা করছেন ঠিক কোথায় কাটতে হবে। আমি দেখলাম, জোরে ছুরি বসিয়েছেন বাবা, কিন্তু তার চামড়া রাবারের টায়ারের মতো, ছুরি ঢোকাতে পারলেন না। আবার ছুরির চাপ দিলেন বাবা, আবার ফলাফল একই। বাবা দুই হাঁটুতে বসে পড়লেন, ‘দ্বিতীয় প্রভু মা, আমি জানি, এভাবে মৃত্যু তোমার প্রাপ্য ছিল না, কিন্তু তোমার যদি কোনো ঝগড়া-বিবাদ থেকে থাকে, তা তো নেতা ঝাঙ-এর সঙ্গে, আমার সঙ্গে তো নয়। আমি স্রেফ তোমার একটা ভালো ছেলে হওয়ার চেষ্টা করছি।’
বাবা শুধু দুবার ছুরি বসিয়েছেন, তাতেই তাঁর কপালে ঘাম, তাঁর থুতনির অল্প একটু দাড়ি সাদা হয়ে গেছে ঘাম-বরফ জমে। ওই অভিশপ্ত বুনো কুকুরগুলো ইঞ্চি ইঞ্চি করে আমাদের দিকে আসছে। আমি বাবার দিকে ঘুরলাম। ‘তাড়াতাড়ি, কুকুরগুলো এসে পড়ছে।’
বাবা দাঁড়ালেন, মাথার ওপর ছুরি তুলে নাড়ালেন, পাগলের মতো তাড়া দিলেন কুকুরগুলোকে, তারপর দৌড়ে ফিরে এলেন, হাঁপাতে লাগলেন, আর জোরে বললেন, ‘দ্বিতীয় প্রভু মা, আমি যদি তোমার শরীর না খুলি তো কুকুরেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে খুলবে। আমার মনে হয়, তুমি চাও যে ওরা নয় বরং আমিই কাজটা করি।’
বাবার চোয়াল শক্ত, চোখ বড় বড়। একটা দৃঢ়সংকল্প নিয়ে তিনি তাঁর হাত নামালেন; ছুরি মা কুইশানের বুকের ভেতরে ঢুকে গেল ছলাৎ শব্দ করে, একদম ছুরির হাতল পর্যন্ত। বাবা ছুরিটা পাশের দিকে টান দিলেন, কালো রক্ত ছলকে বেরোলো, পাঁজরের কাছে গিয়ে ছুরি আর যেতে পারল না। ‘আমার মাথার ঠিক নেই,’ ছুরি বের করতে করতে বাবা বললেন। ছুরিটা মুছলেন মা কুইশানের চামড়ার কোটে, হাতলটা ধরলেন শক্ত করে, আর মা কুইশানের বুকটা পুরো খুলে ফেললেন এবার।
গলগল শব্দ শুনলাম আমি, দেখলাম চামড়ার নিচের চর্বি কেটে ঢুকে যাচ্ছে ছুরিটা; আর তার নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে পড়ল পাক খেয়ে, হলুদ রঙের, সাপের মতো, একদল বাইন মাছের মতো; একটা গরম, বাজে গন্ধ নাকে এল।
নড়িভুঁড়ির ভেতরে হাতিয়ে হাতিয়ে বাবা ক্লান্ত, উত্তেজিত: টানছে, হামলে পড়ছে, গাল দিচ্ছে, অভিশাপ দিচ্ছে; তারপর সবশেষে, আর নাড়িভুঁড়ি নেই, মা কুইশানের পুরো উদরটা এখন ফাঁকা।
‘কী খুঁজছ বাবা?’ আমার মনে পড়ে আমি তাঁকে বিরাট উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘পিত্তথলি। শালার পিত্তথলিটা কোথায়?’
বাবা বুক আর উদরের মাঝখানটা কাটলেন, হাতাতে লাগলেন চারপাশ, একসময় তাঁর হাত হূৎপিণ্ডের ওখানে—ওটা তখনো সুন্দর, লাল। এবার বাবা ফুসফুসে হাত চালালেন। অবশেষে, কলজের পাশে, ডিমের মতো আকারের পিত্তথলিটা খুঁজে পেলেন বাবা। খুব সাবধানে ছুরির আগা দিয়ে কলজে থেকে ওটাকে আলাদা করলেন, তারপর হাতের তালুতে ওটা রেখে একটু পরিষ্কার করে দেখলেন যেন। জিনিসটা ভেজা, পিছল, সূর্যের আলোয় দেখলাম ওটার মধ্যে চকচকে একটা ব্যাপারও আছে। অনেকটা লাল-সবুজ পাথরের সুন্দর একটা টুকরো যেন।
বাবা পিত্তথলিটা আমাকে দিলেন। ‘ভালো করে ধরে থাক, আমি এবার লুয়ান ফেনশাঙের পিত্তথলি নেব।’
এই দফায় বাবা অভিজ্ঞ শল্যচিকিৎসকের মতো কাজটা সারলেন: সুপটুর মতো, চটজলদি, নিখুঁত।
‘চল এখান থেকে,’ বাবা বললেন।
আমরা নদীতীর ধরে দৌড় লাগালাম, কুকুরগুলো নাড়িভুঁড়ির কুণ্ডলীর ভাগ নিয়ে লড়াইয়ে নেমে গেছে।
দাদির চোখের ছানির অবস্থা খুব খারাপের দিকে। ডাক্তারিতে অলৌকিক ঘটনা ঘটানো লুও দাশান আমাদের বলেছেন সে কথা। অসুস্থতার গোড়ায় আছে তাঁর অন্ত্রের তিনটে গহ্বর থেকে উঠে আসা তাপ। অতএব এর চিকিৎসায় লাগবে এমন এক অমোঘ দাওয়াই যা খুব ঠান্ডা, খুব তেতো। ডাক্তার তাঁর মেঝে পর্যন্ত লম্বা গাউনের কিনারটা হাতে তুললেন; তারপর তিনি দরজা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন বাবা তাঁকে মিনতি জানালেন একটা কোনো ওষুধের কথা বলে যাওয়ার জন্য।
‘হুম্ম্ম্... ওষুধ...’ অলৌকিক-ঘটনা ঘটানো ডাক্তার লুও বাবাকে বললেন শুয়োরের পিত্তথলি চেপে তার রসটা তাঁর মাকে খাওয়াতে, এতে তাঁর চোখ কিছুটা হলেও ভালো হবে।
‘ছাগলের পিত্তথলি হলে কাজ হবে?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
‘ছাগলেও চলবে,’ ডাক্তার বললেন,’ ভালুকেও চলবে। কিন্তু ধরো কোনো মানুষের পিত্তথলি যদি পেতে তো... হা, হা...। তা হলে, হুঁ, আমি অবাক হব না তোমার মায়ের চোখের দৃষ্টি যদি পুরো স্বাভাবিকও হয়ে যায়।’
বাবা একটা সবুজ চায়ের পাত্রে মা কুইশান ও লুয়ান ফেনশাঙের পিত্তথলি চেপে বের করা তরলটা রাখলেন, এবার দুই হাতে পাত্রটা বাড়িয়ে দিলেন দাদির দিকে। দাদি ওটা ঠোঁটের কাছে তুললেন, তাঁর জিভের আগা দিয়ে তরলটা একটু ছুঁয়ে দেখলেন। ‘গাউজির বাবা,’ দাদি বললেন, ‘এই পিত্ত তো মহা মহা তিতা। কিসের পিত্ত এটা?’
বাবা উত্তর দিলেন, ‘এটা মা মানে ঘোড়া আর লুয়ানের পিত্ত।’
‘কী বললে, ঘোড়া তা আমি জানি, কিন্তু লুয়ান আবার কী জিনিস?’
আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, বোকার মতো ঝট করে বলে ফেললাম, ‘দাদিমা, এটা মানুষের পিত্ত, মা কুইশান আর লুয়ান ফেঙশানের পিত্তের রস। বাবা ওদের পিত্তথলি বুক ফেঁড়ে খুঁড়ে এনেছেন!’
একটা চিৎকার দিয়ে দাদি পেছন দিকে পড়ে গেলেন তার ইটের বিছানায়, মরে পাথর।

No comments

Powered by Blogger.