সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড-ওরা আমাকে মাইক্রোতে তুলে নিয়ে যায় : কালা মিয়া by লিটন শরীফ

২০ দিন নিখোঁজ থাকার পর গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে বাড়ি ফিরলেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন হুমায়ুন কবির ওরফে এনামুলের বাবা মকবুল হোসেন ওরফে কালা মিয়া (৬০)। তাঁর ভাষ্য,


এনামুলের সন্ধান জানার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন সদস্য তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফার্নিচার ব্যবসায়ী কালা মিয়া মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ ইউনিয়নের পূর্ব দক্ষিণভাগ (দোহালিয়া) গ্রামের বাসিন্দা।
বড়লেখা থানার ওসি কালা মিয়ার ফিরে আসার সত্যতা নিশ্চিত করে কালের কণ্ঠকে বলেন, কালা মিয়ার জবানবন্দি গ্রহণ করে সাধারণ ডায়েরি গ্রহণ করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার কালা মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর ফিরে আসার কৃতজ্ঞতায় বাড়ির লোকজন কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জ্ঞাপন করেছেন। তাঁকে দেখতে বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকে দেখতেও এসেছেন। কালা মিয়াকে বড় ক্লান্ত মনে হলেও লোকজনের সঙ্গে হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় করছেন। বৃদ্ধা মা জমিরুন বেগম (৭৫) ছেলের পাশে থাকছেন সর্বক্ষণ।
কালা মিয়ার ভাষ্য : '২৭ সেপ্টেম্বর সকালে চারজন লোক আমার ফার্নিচারের দোকান থেকে ছয়টি চেয়ার ও একটি ডাইনিং টেবিল ক্রয়ের কথা বলে বাড়ির পাশে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নিকটে রাখা কালো গ্লাস লাগানো কালো রঙের মাইক্রোবাস তুলে নিয়ে যান। এ সময় গাড়িতে আরো ছয়জন লোক বসা ছিলেন। গাড়িতে ওঠার পর কালো কাপড় দিয়ে আমার চোখ বেঁধে জানানো হয়, তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন। পরে তাঁরা আমাকে কোথায় নিয়ে গেছেন বলতে পারি না।'
কালা মিয়া জানান, ওই দিন আনুমানিক আড়াইটার দিকে নির্জন এক বাগানে নিয়ে তাঁর কাছে এনামুলের টেলিফোন নম্বর ও ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়। তথ্য গোপন করলে তাঁর জান যেতে পারে বলে হুমকি দেওয়া হয় বলেও কালা মিয়া দাবি করেন। তিনি বলেন, 'আমি বারবার তাঁদের বলি, এনামুলের সাথে এখন যোগাযোগ নাই। তার পরও দুই দিন চোখ বাঁধা অবস্থায় আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চলে।' এ সময় তাঁর কানে ইলেকট্রিক শক দিয়ে নির্যাতন চালানো হয় অভিযোগ করে তিনি বলেন, 'পরবর্তীতে ২০ দিন আমাকে দিনভর চোখ বেঁধে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁরা সব সময় এনামুলের অবস্থানের খবর জানতে চান। কোথায় কোথায় নিয়ে গেছেন, তা আমি বলতে পারব না।'
ছেড়ে দেওয়া প্রসঙ্গে কালা মিয়া বলেন, 'বুধবার মাগরিবের নামাজের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুই সদস্য ভৈরবের অদূরে মহাসড়কের পাশে আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যান। সেখানে ১০ মিনিট পর তাঁরা আমার চোখ খোলেন এবং আমার মোবাইল ফোন ও ছয় শ দশ টাকা ফেরত দিয়ে চলে যান। যাওয়ার আগে তাঁরা হুমকি দেন, তুলে নেওয়ার বিষয়ে মুখ খুললে ঈদের আগে আমাকেসহ পরিবারের সদস্যদেরও তুলে নেওয়া হবে। এরপর ২০ টাকা গাড়িভাড়া দিয়ে রাত সাড়ে ১১টার সময় ভৈরবে আসি। পরে সেখানকার লোকজনের সহায়তায় সিলেটের বাসে উঠি। রাত ১২টার দিকে আমার ছেলে লাভলু আমার মোবাইলে ফোন দিয়ে জানতে পারে আমি বাড়িতে আসছি। রাত ৩টার দিকে সিলেটে আসলে ছেলেরা আমাকে আজ (১৮ অক্টোবর) ভোরে বাড়ি নিয়ে যায়।'
নিখোঁজ ছেলে সম্পর্কে কালা মিয়া বলেন, 'এনামুল ছোটকাল থেকেই লেখাপড়া না করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। এ থেকে শোধরানোর জন্য তাকে তাবলিগেও পাঠিয়েছিলাম। আট বছর আগে তাবলিগের কথা বলে ঢাকায় চলে যাওয়ার পর তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বছরখানেক আগে এলাকায় আসলেও আমার সাথে তার কোনো কথাবার্তা হয়নি। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যায় জড়িত থাকলে এনামুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হউক।'
কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় গত মঙ্গলবার 'সেই দারোয়ান হুমায়ুনের বাবা ১৮ দিন নিখোঁজ' শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় পর তা বড়লেখাসহ সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠের শেষ পৃষ্ঠায় 'পরিবারের ধারণা- কালা মিয়াকে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খখলা রক্ষাকারী বাহিনী' শিরোনামে আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। কালা মিয়ার বৃদ্ধা মা জমিরুন বেগম বলেন, সাংবাদিকরা রিপোর্ট করায় তাঁর ছেলে ফিরে এসেছেন।
বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কামরুল হাসান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ফিরে আসার পর কালা মিয়ার জবানবন্দি গ্রহণ করে সাধারণ ডায়েরি গ্রহণ করা হয়েছে। কালা মিয়ার সব বক্তব্য নথিবদ্ধ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। যেহেতু এ নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে, বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না।'
কালা মিয়ার ছেলে লাভলু বলেন, 'বুধবার রাত ১২টার পর মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠানোর পর দেখি ফোন খোলা। এরপর কল দিয়ে অন্য প্রান্ত থেকে আব্বার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। ভোরে আব্বাকে সিলেট থেকে বাড়িতে নিয়ে আসি।'
কালা মিয়াকে দেখতে আসা এলাকার নজরুল ইসলাম, আব্দুস শহীদ, লাল মিয়া, ছমির উদ্দিন, খায়রুল ইসলামসহ অনেকেই বলেন, কালা মিয়া এলাকায় শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে পরিচিত।

No comments

Powered by Blogger.