রোহিঙ্গা জামায়াত বিএনপির সঙ্গে আ. লীগও জড়িত by পারভেজ খান

রামুর বৌদ্ধ জনপদে হামলায় জোরালো ও মূল ভূমিকা রাখে জামায়াতে ইসলামী। তারা কৌশলে ব্যবহার করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের। আর ওই তাণ্ডব চালাতে টাকাপয়সার জোগান দেয় রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরএসওসহ কয়েকটি এনজিও।


স্থানীয় প্রশাসন ঘটনার পূর্বাভাস পেলেও তাতে গুরুত্ব দেয়নি। পুলিশসহ বিভিন্ন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল সমন্বয়ের মারাত্মক অভাব। গোয়েন্দারাও ছিলেন চুপচাপ।
রামুর বৌদ্ধপল্লী-মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটের ঘটনায় সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে এ তথ্য। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুল ইসলাম। ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা প্রতিহত করতে ২২টি সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর কড়া নজরদারি, নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর ভিন্ন নামে ও গোপনে কর্মকাণ্ড চালানো এনজিওগুলোকে খুঁজে বের করা, ভবিষ্যতে জরুরি মুহূর্তে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত মোতায়েনের জন্য জেলা সদরে একক কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ঘটনাটি সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত ও সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার ঘটনার সূত্র থেকে মূলত রামুর ঘটনার সূত্রপাত। রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরএসওর শীর্ষ পর্যায়ের দুজন নেতা কক্সবাজারে একটি আবাসিক হোটেলে থেকে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
সূত্র জানায়, এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে সংযুক্ত করা ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিটিই যে ঘটনার মূল কারণ নয়, তদন্তে তার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। মূলত ছবিটি সংযুক্ত করার খবর প্রকাশ পায় ১৮ সেপ্টেম্বর, কিন্তু তখন সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। হামলা শুরু হয় ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে। তবে ছবিটি সংযুক্ত করা হয়েছিল এ অবস্থা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। এর পেছনে কাজ করেছেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা তোফাইল আহমেদ। বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে ছবি সংযুক্ত করার অভিযোগে মুক্তাদির নামে যে যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার কাছ থেকেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুক্তাদিরের খালু হচ্ছেন এই তোফাইল। হামলা ও অগ্নিসংযোগের জন্য যাতে বেশি লোককে উসকানি দিয়ে সম্পৃক্ত করা যায়, সে কারণে একটি বিশেষ দিনকে তারা বেছে নেয়। সেদিন ছিল রামুর হাট।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ২০০ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল জামায়াত নেতা তোফাইল আহমেদের। সাবেক শিবির নেতা তোফাইল বিভিন্ন সন্ত্রাসমূলক ঘটনায় আগেও একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। এলাকায় তার একটি সংগঠিত বিশাল মৌলবাদী চক্র আছে, যারা ওই দিন মোটরসাইকেলে করে সরাসরি ঘটনায় যোগ দেয়। রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও তোফাইলের ঘনিষ্ঠতা আছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তবে ২৯ সেপ্টেম্বর ঘটনার সূত্রপাত ঘটে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সমাবেশ আর মিছিলকে ঘিরেই। ওই সমাবেশে অংশ নেওয়া কাজল-সাদ্দামসহ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীকে কৌশলে ব্যবহার করেছে এই চক্র। ঘটনার পেছনে বিএনপি দলীয় এমপি লুৎফর রহমান কাজলেরও একটা ইঙ্গিত বা ইশারা ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমপি কাজল ঘটনার সময় সেখানে এসে পৌঁছালেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেননি। বরং তাঁর সহকারী দেলোয়ার অনেককে টেলিফোন করে সেখানে ডেকে এনেছেন বলেও জানা গেছে। তবে আওয়ামী লীগের কারো বিরুদ্ধে হামলা, লুট বা অগ্নিসংযোগে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি।
পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর পৃথক যে হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে সেটাও প্রথম ঘটনারই রেশ ধরে এবং একই পরিকল্পনার ছকে আঁকা। তাতে অংশ নেওয়া লোকজনও প্রায় একই। একটি চক্র উপস্থিত থেকে পর্যায়ক্রমে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তদন্তে পাওয়া গেছে। আর এসব ঘটনার নেপথ্যে থেকে মদদ দিয়েছে আরএসওসহ স্থানীয় বেশ কয়েকটি এনজিও আর কক্সবাজারের কয়েকটি কওমি মাদ্রাসা। ওই এলাকায় কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত কয়েকটি এনজিওরও সম্পৃক্ততা রয়েছে।
পাশাপাশি ঘটনার পেছনে রামুর আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপের পরস্পরবিরোধী অবস্থানও দায়ী বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। রামু উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজলের সঙ্গে তাঁরই ছোট ভাই কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা সাইমুম সরওয়ার কমলের প্রকাশ্য বিরোধিতা রয়েছে। মূলত এই দুই ভাইয়ের বিরোধকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগও দুই ভাগে বিভক্ত। কমল গত সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার সদর-রামু সংসদীয় আসনে মহাজোটের প্রার্থী ছিলেন। বিএনপি নেতা লুৎফুর রহমান কাজলের কাছে তিনি পরাজিত হন। দুই ভাইয়ের এ বিরোধকেও কাজে লাগিয়েছে জামায়াত নেতা তোফাইল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, তদন্তে বের হয়ে এসেছে প্রশাসনের ব্যর্থতাও। ফুটে উঠেছে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতার অভাব এবং তাৎক্ষণিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার ব্যাপারে বিচক্ষণতার অভাব। বিশেষ করে সে সময়ের কক্সবাজার জেলা প্রশাসক জয়নুল বারী ও পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের ব্যর্থতার বিষয়গুলোও। জেলা প্রশাসক জয়নুল বারী কয়েক দিন আগেই বদলির আদেশ পেয়েছিলেন। ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি ছিলেন বিদায় অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত। আর ঘটনার খবর পেয়েও তিনি যথাযথ গুরুত্ব দেননি। পরে পুলিশ সুপারকে নিয়ে তিনি ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হলেও ভয়ে সেখানে না গিয়ে পথে অপেক্ষা করেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাঁরা ঘটনাস্থলে যান।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রয়োজনের তুলনায় পুলিশ ছিল কম। কিন্তু আগাম খবর লাভে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কর্তব্যরত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও। গোয়েন্দাদের কেউ কেউ খবর পেলেও গুরুত্ব দেননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ রয়েছে। মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে তা প্রকাশ করা হবে।
সুপারিশনামা
২২টি সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাতটিতে বলা হয়েছে-
এক. বৃহত্তর কক্সবাজার আর নাইক্ষ্যংছড়িতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ওপর বিশেষ নজর রাখা। ক্যাম্পে যেসব রোহিঙ্গা অবস্থান করছে তাদের চলাচল আর কর্মকাণ্ডের ওপরও কঠোর এবং সতর্ক নজরদারি প্রয়োজন।
দুই. রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরএসওসহ কয়েকটি এনজিওর কর্মকাণ্ড ওই এলাকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও তারা ভিন্ন নামে এবং গোপনে তাদের কর্মকাণ্ড ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। এসব সংগঠনকে খুঁজে বের করা এবং তাদের প্রতি নজর রাখতে হবে। সংগঠনের ব্যাংক হিসাবের ওপরও নজরদারি রাখা।
তিন. নাইক্ষ্যংছড়ির অনেক দুর্গম স্থান আছে, যেখানে যাতায়াত করা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও প্রয়োজনের তুলনায় কম। এই সমস্যাকে মাথায় রেখে পুলিশের একটি দাঙ্গা দমন ইউনিটকে সেখানে মোতায়ন করা, যাতে কোথাও কিছু ঘটলে তারা দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে পারে। চার. গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড আরো বাড়াতে হবে।
পাঁচ. ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে বা জরুরি যেকোনো মুহূর্তে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংস্থা যাতে কক্সবাজার থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে একজনের নির্দেশে পরিচালিত হতে পারে সে জন্য একক কমান্ডিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ছয়. কক্সবাজারের দুর্গম জঙ্গল আর পাহাড়ি এলাকায় অনেক কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এই মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
সাত. এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো বিশেষভাবে পর্যালোচনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের আওতায় আনা।
তদন্ত-সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা জানান, এ ধরনের একটি ঘটনার তদন্ত চালাতে যে সময়ের প্রয়োজন, সেটা এ ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি। পেলে তদন্তকাজ আরো বিস্তৃত হতে পারত, বের হতো আরো অনেক অজানা ঘটনা। পাশাপাশি জড়িত হিসেবে যাদের নাম এসেছে তাদের ব্যাপারে পাওয়া অভিযোগগুলো আরো জোরালোভাবে উপস্থাপন করা যেত। এর পরও এ স্বল্প সময়ের মধ্যে যেটুকু পাওয়া গেছে তার ওপর ভিত্তি করেই ৬৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। তদন্তে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে ১২৩ জনের।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর রামু-উখিয়ার বৌদ্ধ বসতিতে তাণ্ডব চালায় দুর্বৃত্তরা। রামুর সাতটি বৌদ্ধমন্দির ও বিহার ছাড়াও কমপক্ষে ৩০টি বাড়ি ও দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয় আরো শতাধিক বাড়ি ও দোকানে। পরদিন ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

No comments

Powered by Blogger.