চারুশিল্প- কারওয়ান বাজার: নির্মাণ-বিনির্মাণ

শিল্পীদের মধ্যে সব সময়ই নানা মত ও পথ থাকে। কেউ নিজেকে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ ভাবতে পছন্দ করেন, কেউ আবার শুধু শিল্পের সঙ্গেই নিজের দায়বদ্ধতা স্বীকার করেন। তবে একজন শিল্পীর মত-পথ আসলে শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে শিল্পীর নিজস্ব কর্মকাণ্ড ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই।


যেমন ১২ অক্টোবর কারওয়ান বাজারে তৌফিকুর রহমানের প্রদর্শনীটি উদাহরণ হিসেবে নেওয়া। এই প্রদর্শনীতে শিল্পীর শিল্প সৃষ্টির পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে এসেছে। শিল্পী নিজের কিছু ভাবনাকে দৃশ্যশিল্পের কৌশলে ভাষা প্রদানে, নিরীক্ষায় নেমেছিলেন বলা যায়।
‘কারওয়ান বাজার: জীবন, শিল্প, প্রক্রিয়া’ শিরোনামে চার ঘণ্টা স্থায়ী স্থাপনা (ইনস্টলেশন) শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর জন্য শিল্পী তৌফিকুর রহমান বেছে নিয়েছিলেন কারওয়ান বাজারের দীর্ঘদিনের পুরোনো রেস্তোরাঁ ‘নবান্ন’কে। ধারণার দিক থেকে এ রকম আরেকটি প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল গত ২৬ আগস্ট বেগুনবাড়ির একটি স’ মিলে। সেই প্রদর্শনীর সঙ্গে এই প্রদর্শনীটির আঙ্গিকের, আয়োজনের পুরো সাদৃশ্য রয়েছে।
নবান্নের আয়োজনে বিষয়ভিত্তিক চারটি স্থাপনাকর্ম উপস্থাপন করেছেন শিল্পী তৌফিকুর রহমান। ‘কালো হাতে সোনা’ শীর্ষক স্থাপনায় ধানের বস্তার ছোট ছোট আকৃতির ওপরে কালো হাতের বিভিন্ন ধরনের ভঙ্গিমার প্রকাশ ঘটিয়েছেন শিল্পী। যা দিয়ে শিল্পী উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে পণ্যের অর্থনৈতিক যাত্রার কথা তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর কালো হাত এখানে এসেছে একটি নেতিবাচক শক্তির প্রতিভু হয়েই। কালো হাতের প্রতিনিধি হতে পারেন কোনো অসাধু ব্যবসায়ী কিংবা মুনাফাখোর, ফড়িয়া প্রমুখ। শিল্পী একই সঙ্গে কালো হাতের শক্তিকে চিনে নেওয়ার জন্য দর্শকের কল্পনাকে উসকে দিতে চেয়েছেন।
বরফখণ্ডের ভেতর হিমায়িত মাছ। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে কারওয়ান সিং নামের একজন মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীর হাতে গোড়াপত্তন ঘটে ঢাকার সর্ববৃহৎ এই পাইকারি বাজারের। ‘হিমায়িত মাছের মাথা’ স্থাপনায় রান্নাঘরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত মাছের সংরক্ষণের প্রতিটি পর্যায়কে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে।
‘সংরক্ষিত টেবিল’ বা ‘রিজার্ভড টেবিল’এই স্থাপনাটি হাজির হয়েছে অনুপস্থিতের উপস্থিতির রহস্যময়তা এবং উদ্বেগের ধারণাকে ধারণ করে। ‘সাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থান একখণ্ড ব্যক্তিগত জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে।’ শিল্পী এই স্থাপনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এ রকম ব্যাখ্যাই দিয়েছেন।
কারওয়ান বাজার এখন ১৮ শতকের কারওয়ান সিংয়ের বাজার হয়ে নেই। এর পরিধি বেড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপ্তি বেড়েছে বিপুল পরিসরে। কারওয়ান বাজার এখন একই সঙ্গে পাইকারি ও খুচরা বাজার। এখানে কাঁচা সবজি, মাছ, মাংস ও বিবিধ বিচিত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের পসরা বসছে প্রতিদিন-প্রতিরাত। আবার এই এলাকাতেই দেশের বড় কয়েকটি করপোরেট অফিস, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার প্রধান দপ্তর। ফলে কারওয়ান বাজার দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্রও। তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘আমি আসলে চেয়েছি, গ্যালারির বাইরে এসে খুব জনবহুল কোনো জায়গায় দৃশ্যশিল্পের ভাষায় আমার চিন্তাকে নিরীক্ষা করতে। দৈনন্দিন জীবন-প্রক্রিয়ার মধ্যেই শিল্পের অবস্থান। শিল্পীর নির্মিত শিল্পকে মানব অস্তিত্বের তাগিদে গড়ে ওঠা স্থাপনা শিল্পের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়াও আমার উদ্দেশ্য ছিল।’
আয়োজনের দিন অন্য আর দশটি দিনের চেয়ে নবান্ন রেস্তোরাঁটি সেজেছিল ভিন্নভাবে। ভেতরের পরিবেশ-পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। নানা সমন্বয়, সংযোজন-বিয়োজন ও সংমিশ্রণের মাধ্যমে একটি রেস্তোরাঁর প্রতিদিনকার প্রতিকৃতির নতুন রূপান্তর ঘটে ওই দিনের দৃশ্যশিল্পের ব্যাকরণসিদ্ধতায়। ফলে দর্শককে তার স্মৃতি ও বাস্তবের নবান্নের ভিন্নরূপে সজ্জিত দুই চেহারাই ভিন্ন এক অভিজ্ঞতায় মুখোমুখি করিয়ে দেয়।
তবে প্রদর্শনীতে কারওয়ান বাজারে নিত্যদিন যাতায়াত করা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি কতজন ছিলেন বা আদৌ কেউ ছিলেন কি না, সেটা দৃষ্টিগোচর হয়নি। বড় একদল শিল্পরসিক উপভোগ করেছে পুরো আয়োজনটি। প্রদর্শনীটি ১২ অক্টোবর বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চলে। প্রদর্শনীর ব্যাপ্তি খুব সামান্য হলেও এ আয়োজন একটি ভিন্ন ধরনের দৃশ্যশিল্প চিন্তা পাঠের অভিজ্ঞতার অবতারণা করেছিল আগত দর্শকের সামনে।

No comments

Powered by Blogger.