বৃষ্টির রূপকার by শাশ্বতী মজুমদার

শিল্পী হওয়ার জন্য সারাক্ষণ স্টুডিওতে বসে ছবি আঁকতে হবে—এমনটা মোটেও মনে করেন না মাহমুদুল হক। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে সুপ্রতিষ্ঠিত ষাটোর্ধ্ব এই শিল্পী তাঁর কাজের প্রয়োজনে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশের বহু প্রান্তে। একই সঙ্গে তিনি আড্ডাপ্রিয় ও বন্ধুবৎসল। কিন্তু এ জন্য তাঁর কাজের কখনো ক্ষতি হয়নি, বরং দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা, আড্ডা, চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে চিত্রিত করেছেন তাঁর ক্যানভাস।
ছাত্রাবস্থা থেকেই চর্চা করতেন বিমূর্ত ও আধা বিমূর্ত ধারার। ষাট ও সত্তরের দশক থেকে অদ্যাবধি যে শিল্পচর্চা, তাতে কোনো ছেদ পড়েনি। তাঁর চিত্রচর্চায় মোহাম্মদ কিবরিয়ার প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। পরবর্তীকালে সেই প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে তিনি নিজস্ব জগৎ ও শৈলী নির্মাণ করেছেন। রিয়েলিস্টিক ছবির নির্দিষ্টতা তাঁকে আকর্ষণ করে না। তাঁর মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে বিমূর্ত ফর্মই তাঁকে অসীম কল্পনার জগতের সন্ধান দেয়। এ কারণে তাঁর অধিকাংশ ছবি শিরোনামহীন। কারণ এই নাম একটি ছবির বিষয়বস্তুকে সীমাবদ্ধ করে ফেলবে। যেমন তাঁর শিরোনামহীন একটি ছবিতে দেখা যায় ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা ও গাঢ় নীল। ফোরগ্রাউন্ডে সাদা-কালোর আঁকা বিমূর্ত ফর্মে একত্রে জড়াজড়ি করে আয়তাকার বিন্যাস ও বুনন সৃষ্টি করেছে। এখানে প্রকৃতির ফর্মগুলোকে আংশিক বা কখনো পুরোপুরি ভেঙে দিয়ে দিগন্তের বিস্তার কিংবা আকাশের আবহ সৃষ্টি করেছেন। ছবির বিষয়কে সংবেদনশীল ও অনুভূতিময় করার জন্য ছবিতে কমনীয়তার সঞ্চার করেছেন। সামনের জড়াজড়ি করা ফর্মগুলো অরণ্যের আবহ সৃষ্টি করেছে। শিল্পী ছবিটির নির্দিষ্ট নাম দিয়ে একে কোনো গণ্ডিতে আবদ্ধ করতে চাননি। দর্শক চাইলে ছবিটি দেখে সমুদ্রের অনুভূতিও পেতে পারেন। শিল্পীর কাছে ছবির মূল বিষয়টি হলো ভালো লাগা। তাঁর বিশ্বাস, একজন শিল্পীর কাছে বস্তুগত বাস্তবতা এবং বাস্তবতার ধারণা বা অনুভব সমানভাবেই বাস্তব। যেখানে বস্তুগত বাস্তবতা ব্যর্থ, সেই সত্যকে ছোঁয়া সম্ভব বাস্তবতার অনুভব দিয়ে।
শিল্পীর বিখ্যাত কয়েকটি ছবি হরাইজন (Horizon), ইমেজ অব আ ওয়াল (Image of a wall), ব্লু অ্যান্ড ব্ল্যাক (blue and balck), বৃষ্টি-২, গোধূলি, অনেক বৃষ্টির পরে, লাল ও কালো, তিন মহিলা ইত্যাদি।
প্রকৃতি ও দিগন্তের নানা দৃশ্যকে তিনি বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে এঁকেছেন। বাংলার নৈসর্গ তুলে ধরতে বৃষ্টি নিয়ে সিরিজ ছবি এঁকেছিলেন। বৃষ্টিবিধৌত রূপকল্প তুলে ধরেছেন নিরীক্ষামূলক কল্পনার সাহায্যে। গোধূলির আবহ তুলে ধরতে লাল, হলুদ ও গৈরিক রং ব্যবহার করেছেন।
মাহমুদুল হক ১৯৪৫ সালে বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে অনার্সের পরে মাস্টার্স করেন জাপানের Tsukuba ইউনিভার্সিটি থেকে। দেশ-বিদেশে তিনি অনেক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন এবং অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর কর্মজীবনের ব্যাপ্তি অনেক দূর বিস্তৃত। তিনি জাপান, পাকিস্তান, ইউএসএ, জার্মানিতে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। বাংলাদেশে জাতীয় জাদুঘরের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাপচিত্র বিভাগের প্রফেসর হিসেবে কর্মরত।

No comments

Powered by Blogger.