কিবরিয়া ভাইকে মনে পড়ে by শাহ মোহাম্মদ ইমাম মেহেদী

সেদিন ছিল ২০০৪ সালের অক্টোবর অথবা নভেম্বরের রোববারের এক সকাল। রোববারের ভোর সব সময় আমার কাছে অলস সময় কাটানোর দিন। সারা সপ্তাহের কর্মব্যস্ততা শেষে এই রোববার এলে যেন কিছুই করতে ইচ্ছা হয় না, এমনকি একটি টেলিফোন কল রিসিভ করাও আলসেমিতে ভরে যায়।
সেই আচমকা মুহূর্তে ফোন পেলাম। ওপাশ থেকে কিবরিয়া ভাই বললেন, ‘আমি আজ সারা দিন কোথাও বের হচ্ছি না। তোমরা সবাই চলে আসো না। নানা গল্প করা যাবে।’ শুনে খুবই ভালো লাগল। লন্ডনে বসে এই ভাবনাহীন দিনে অনেক কিছুই স্মরণ করা যাবে।
মনে পড়ে বছরের দুই ঈদের দিনে আশপাশের সবাইকে নিয়ে চিন্তা করা অথবা কে কোথায় কেমন আছে খবরাখবর নেওয়া।
আমরা গেলাম। সাউথ লন্ডনের একটি হোটেলে বসলাম। অত্যন্ত ঘরোয়া পরিবেশে পারিবারিক বিষয়-আশয় নিয়ে আলাপ শুরু হলো। আমাদের পরিবারের কে কোথায় কী করছেন, এ প্রসঙ্গেই আলাপ উঠল। বুঝলাম, পরিবারের কে কোথায় কী করছেন, তার জ্ঞান পুরোপুরি পাকা বা ওয়াকিবহাল। আমাদের দাদার দেওয়া জামে মসজিদ থেকে শুরু করে গ্রামের ও এর আশপাশের অনেক ঘটনাই উঠে এল। কিবরিয়া ভাইয়ের সঙ্গে এতটা নিরিবিলি পরিবেশে শুধু লন্ডনে বসে পরিবারের সুখ-দুঃখের অনেক ঘটনার সুরাহা খোঁজা আমাদের পক্ষে ছিল একটি অবিস্মরণীয় আলোচনা।
দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বললেন, ‘মেহেদী, তুমি বুঝতে পারছ না, এই লন্ডনে বসে দেশে আজ কী চলছে? এর বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হয়ে উঠতে হবে, সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে, তা না হলে সাধারণ মানুষের মুক্তি নেই। ধর্মের নাম নিয়ে এরা যে অপরাধ করছে, তা কোনো অবস্থায় মেনে নেওয়া যায় না। ওদের আইনের আওতায় সোপর্দ করতেই হবে।’
এ উপলক্ষে বলে রাখা ভালো, ইতিমধ্যে বাংলাভাই ও তার অনুসারীরা ৬৪টি জেলায় বোমা ফাটিয়েছে। তাদের রাজনৈতিক মতবাদ তারা জোরেশোরে চালিয়েছে এবং দাম্ভিকভাবে বলেছে, তারা বাংলার যেকোনো জায়গায় যেকোনো মানুষের বিরুদ্ধে যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে। তাই এই নিষ্ঠুর খড়গের খোরাক হয়েছিলেন আইভি রহমানের মতো নারী আর কত জানা-অজানা প্রাণ, যা প্রতিদিনের নানা মিডিয়ায় চলে আসছিল।
ক্ষণিকের জন্য হলেও আমরা সবাই নিশ্চুপ। তখন কিবরিয়া ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম, তাঁর চোখে দেখতে পেলাম আগুনের ফুলকি। যার মধ্যে সর্বদাই দেখে আসছি অফুরন্ত জ্ঞানের সমাহার, অসংখ্য অভিজ্ঞতায় ভরপুর। অত্যন্ত ব্যথিত মনে দেশে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু সেটি তাঁরই জীবনে এভাবে ঘটে যাবে, আমরা কেউ ভাবতে পারিনি।
মনে পড়ে, ভাষা আন্দোলনের কথা। সেই আন্দোলনে কিবরিয়া ভাই সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং অভিযুক্তও হন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। কিবরিয়া ভাই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি তখন খুবই ছোট। তবে স্পষ্ট মনে আছে, সকালের চা-নাশতা শেষ করে মা-চাচিরা কিবরিয়া ভাইয়ের পড়ার ঘরে আসতেন, গল্পগুজব করতেন। একদিন মা-চাচিরা বসেছেন। কিবরিয়া ভাই আমার মাকে ডাকলেন, ‘ছোট চাচি, বরকত-সালাম-জব্বারের মতো যদি আমার অবস্থা হতো, তবে কী না ভালো হতো, আজ আমি বেহেশতে থাকতাম।’
কিবরিয়া ভাইয়ের মা এ কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সেদিন হয়তো কিবরিয়া ভাই মনের আবেগে কোটি কোটি মানুষের অন্তরের সুখ-দুঃখকে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, কী যন্ত্রণা আর অনাচার-অবিচার তাঁকে দগ্ধ করে চলেছিল। সেদিন কি তিনি জানতেন, সময়ের গতিতে ঝড়ঝঞ্ঝার আবর্তন-বিবর্তনের মধ্যে যে শিকড় গড়ে উঠেছিল জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার খেলায়, দেশ-দশকে তাঁর জ্ঞানের আলো শুধু দেওয়ার সময়, তখন তাঁর আপন জন্মস্থান বৈদ্যেরবাজারে, একটি ছোট্ট এলাকায়, আন্তর্জাতিক দেশি-বিদেশি চক্রের বিষাক্ত থাবায়, গ্রেনেডের প্রচণ্ড আঘাতে ঝাজরা হবে সে মানুষটির শরীর? দিনটি ছিল ২৭ জানুয়ারি ২০০৫। দেশ ও মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রতিফল এভাবে দিতে হলো।
কিবরিয়া ভাই অর্থমন্ত্রী থাকাকালে সাধারণ মানুষের মনে ছিল একটু স্বস্তির নিশ্বাস। এটা বিনা দ্বিধায় বলা যেতে পারে, তাঁর অর্থমন্ত্রী থাকাকালে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের যে জিনিস—চাল, ডাল, মাছ, তরিতরকারি ইত্যাদির দাম ছিল সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। তার কোনো শত্রুও বলতে পারবে না দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে ছিল। তিনি অসহায় মানুষের সমস্যা জানতেন, বুঝতেন।
কিবরিয়া হত্যা সারা জাতির জন্য একটি নিষ্ঠুর কলঙ্কজনক অধ্যায়। তার কালিমা সারা জাতিকে বহন করতে হবে। এই নিষ্পাপ মানুষকে যারা খুন করেছে, এরা কোনো সাধারণ লোক নয়। এরা সমাজের হোমড়াচোমড়া, উঁচু স্তরের লোক। ক্ষমতায় অন্ধ হয়েই এরা এই কাজ করেছে। কিবরিয়া ভাইয়ের মৃদু ভাষণ ওদের শেলবিদ্ধ করেছে।
সত্যি কথা বলতে কি, কিবরিয়া হত্যা জাতির কাছে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশের বুদ্ধিজীবী, লেখক, সমাজসেবক অনেকেই অনেক কিছু লিখেছেন, বলেছেন। কিন্তু ছয় বছর পরও সেই হত্যার বিচার হয়নি। অথচ তাঁর দলই এখন ক্ষমতায়। আমরা এই ঘাতকদের বিচার চাই।
আসুন, আমরা সবাই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শপথ করি, হত্যাকারীরা যে দলেরই হোক, যত শক্তিশালীই হোক, আমরা তাদের খুঁজে বের করব এবং শাস্তি নিশ্চিত করব।
ই-মেইল: emmymehdishah@yahoo.co.uk

No comments

Powered by Blogger.