ফেলানীর মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ- নিজ ভূমেই প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের মানবিক চেহারা

পূর্ব ভারতের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় সংস্থা মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) মনে করে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বিরুদ্ধে আইনি প্রয়োগ না হওয়ায় সীমান্তে তাদের অত্যাচার দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর এ জন্য ভারতের দুর্বল আইন ব্যবস্থা, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন, রাজনৈতিক সদিচ্ছাকেই মূলত দায়ী করছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত ইস্যুতে দীর্ঘ দিনের কাজের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ ওই সংস্থাটি।
গত কয়েক মাসে বিএসএফের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা, নির্যাতনসহ ৮০০ অভিযোগ মাসুমের দপ্তরে রয়েছে। এরমধ্যে সামপ্রতিক গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ কুচবিহারের হিনহাটায় কাঁটতারের বেড়া ওপর ফেলানীকে গুলি করে হত্যার ঘটনা। মানবাধিকার সংস্থা 'মাসুম' ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে বিএসএফ ও বিডিআরের নির্যাতন নিয়েই মূলত কাজ করে।
মাসুমের চেয়ারম্যান কিরিটি রায় কালের কণ্ঠকে জানালেন, ভারতীয় আইনে কাউকে গুলি করে হত্যা করার বিধান নেই। সেটা বিএসএফ হোক, কিংবা অন্য কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হোক। কিন্তু দুর্ভাগ্য সীমান্তে প্রতিদিন বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করে মারছে তারা। আর সব ক্ষেত্রেই যুক্তি; 'চোরাকারবারি কাঁটাতারের বেড়া টপকে সীমান্ত পার হতে যাচ্ছিল। বাধা দিতে গেলে বিএসএফের ওপর হামলা হয়। আত্মরক্ষায় বিএসএফ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। ফলাফল মৃত্যু।'
কিন্তু এসব যুক্তিকে মাসুমের চেয়ারম্যান খোঁড়া এবং হাস্যকর বলে আখ্যায়িত করেছেন। পরিসংখ্যান ঘেঁটে তিনি বলেন, 'অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় গুলিতে নিহত হওয়াদের কাছে ঘাস কাটার কাস্তে, খুন্তি নয়তো ছোট লাঠি পাওয়া গিয়েছিল। এসব দিয়ে নিশ্চয় একে-৪৭ এর মতো অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়া সম্ভব নয়। আর যুক্তির খাতিয়ে ধরে নেওয়া যাক যে সবাই চোরাকারবারি। কিন্তু ভারতীয় সংবিধানে চোরাকাবারিকে গুলি করে মেরে ফেলারও অধিকার দেওয়া হয়নি। বরং ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে রাইট-টু লাইভ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে প্রত্যেক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে। সুপ্রিম কোর্টের বহু নির্দেশনাতেও বলা হয়েছে আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে গুলি চালালেও অবশ্যই সেটা হাঁটুর নিচে করতে হবে। কিন্তু ফেলানীর ক্ষেত্রে কি সেটা হয়েছে? হয়নি। এখানে ঘোরতম অন্যায় হয়েছে। এর পরই দেখুন কোনো তদন্ত হয়নি। মামলা হয়নি। আমাদের তদন্তে মেয়েটিকে যথেষ্ট দূর থেকে নিশানায় এঁকে গুলি করা হয়েছিল। এর কী উত্তর দেবে বিএসএফ ?'
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তেই বিএসএফ সবচেয়ে বেশি গুলি করে মানুষ হত্যা করে বলে মাসুমের পরিসংখ্যান দিয়ে কিরিটি রায় বলেন, 'বাংলাদেশ ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র, পাকিস্তানের মতো শত্রুরাষ্ট্র নয়। নেপাল-ভুটানের মধ্যেও সীমান্ত আছে। এসব সীমান্তে তো গুলি করে মানুষ মারার খবর নেই। তবে কেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে? তিনি বলেন, 'উত্তর প্রদেশ থেকে গরু আসে। সেই গরু মুর্শিদাবাদ, বনগাঁ, বসিরহাট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাচার হচ্ছে। গোটা নেটওয়ার্কের মধ্যে পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় রাজনৈতিক মাফিয়া জড়িত। পাচারের সময় তো গরু আটক করা হয় না। প্রকৃত গরু পাচারকারীদের আটক করা হয় না। তা হলে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থায় ভালো থাকায় অপেক্ষাকৃত অর্থনীতিকে কম শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ, সেই দেশের সীমান্তঘেষা গরিব মানুষ কাজের সন্ধানে যদি সীমান্ত পেরিয়ে এসে থাকে, তবে কেন তাঁদের পশুর মতো গুলি করে মারা হবে?'
জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোটিয়ার অন হিউম্যানরাইটস ডিফেন্ডারের সেক্রেটারি মাগারেট সের্কাজ্ঞায়ে সাতদিনের সফরে ভারতের অবস্থান করছেন। বৃহস্পতিবার কলকাতায় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে ফেলানীর খবরও দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে কিশোরীর মরদেহ ঝুলে থাকার ছবিও দেখানো হয় তাঁকে। ওই দৃশ্য দেখে বিস্মিত হন মার্গারেট। বিষয়টি জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস শাখায় আলোচনা করার আশ্বাস দিয়ে কলকাতা ত্যাগ করেন। ফেলানীর ঘটনা ছাড়াও সমপ্রতি কলকাতার অদূরে দমদম সেন্ট্রাল জেলে বাংলাদেশি এক তরুণীর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা নিয়েও জাতিসংঘের মানবাধিকার শাখার ওই কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে মাসুমের তরফ থেকে।
ফেলানীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে কোচবিহারের জেলাজুড়ে। সেখানে ভারতের গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা সমিতির স্থানীয় সম্পাদক সুমন গোস্বামী এরমধ্যে বিএসএফের এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে জনমত তৈরি শুরু করেছেন। দিনহাটায় ফেলানীর মৃত্যুর ঘটনায় সুশীল সমাজকে নিয়ে আগামী সপ্তাহে এক প্রতিবাদ সভা করবে এপিডিআর। তাঁর দৃষ্টিতে ফেলানীর মৃত্যুর ঘটনা 'নারকীয়'। কালের কণ্ঠকে তিনি বললেন, 'একটি শিশুকে এভাবে গুলি করে মারা হলো, স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে তাহলে বিএসএফের মধ্যে কী কোনো মানবিকতা বোধ নেই!'
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশালের সদস্য মোক্তার আহমেদ বলেছেন, 'বিএসএফের প্রতি সীমান্তে বসবাসকারী ভারতীরাও ক্ষুব্ধ। প্রায়ই ভারতীয় কৃষককে গুলি করে মারার ঘটনায় ঘটছে। কিছু হলেই গুলি করা বিএসএফের নেশা হয়ে গেছে। এটা বন্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু বিস্ময়কর, কোনো লাভ হচ্ছে না'।
ফেলানীর মৃত্যুর খবরে আবেগতাড়িত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীমহল। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী বলেন, 'এমন মৃত্যুও যেন আর দেখতে না হয়। এটা নিয়ে অবশ্যই দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কথা বলা উচিত।' তিনি আরো বলেন, 'এই ঘটনাটিকে স্বাভাবিক ভাবেই ভারত বিদ্বেষীরাও ব্যবহার করতে চাইবে। এটা হলে খুবই দুঃখজনক হবে। এ রকম ঘটনায় ভুল বার্তা পেঁৗছাচ্ছে।'
সাংবাদিক অমিত বসুর ভাষায়, 'ফেলানীর মৃত্যুর সচিত্র খবর পেয়ে গা শিউরে উঠেছিল প্রত্যেক পাঠকের। কেউ যদি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত কিংবা বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাকে তবে নিশ্চয়ই দেশের আইন অনুযায়ী অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শাস্তি হবে। কিন্ত এভাবে নিরস্ত্র মানুষের ওপর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলি চালানোর ঘটনায় ভারতের মানবিক চেহারাটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।'
=============================
বাজার চলে কার নিয়ন্ত্রণে  উঠতি বয়সের সংকট : অভিভাবকের দায়িত্ব  বিকল্প ভাবনা বিকল্প সংস্কৃতি  অন্ধত্ব ও আরোগ্য পরম্পরা  খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার  কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন  ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার  ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র  পানি সংকট পানি বাণিজ্য  ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল  গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক  কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?  আত্মসমর্পণের সেই বিকেল  আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না  সংবিধানের অনেক বক্তব্য পারস্পরিক সংঘাতমূলক  পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক ‘ভবঘুরের’ স্পর্ধা  আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলো না


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ সুব্রত আচার্য্য কলকাতা থেকে


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.