কৃষি আলোচনা- 'বরেন্দ্রভূমির কৃষকের বীজবিদ্রোহ' by পাভেল পার্থ

বারও বাংলাদেশে করপোরেট বীজ-প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। করপোরেট সিনজেন্টা কোম্পানির হাইব্রিড টমেটো বীজ চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতারিত রাজশাহীর কৃষকেরা সিনজেন্টার বিরুদ্ধে সংগঠিত করছেন জন-আন্দোলন। বরেন্দ্রভূমির কৃষকদের অভিনন্দন, যাঁরা সিনজেন্টার মতো এক ডাকসাইটে করপোরেটের বিরুদ্ধে বীজের ন্যায্য হিস্যা আদায়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ২০০০ সালের ১৩ নভেম্বর নোভার্টিস ও এসট্রা জেনেকা মিলে তৈরি করে সিনজেন্টা। এর আগে ১৯৯৯ সালে সুইডিশ কোম্পানি এসট্রা এবি ও ব্রিটিশ কোম্পানি জেনেকা মিলে তৈরি হয়েছিল এসট্রা জেনেকা।
যে নভেম্বর মাসে সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেল শহরের রাইন নদীর তীরে সিনজেন্টার জন্ম, মাত্র ১০ বছর পরে সেই মাসেই বাংলাদেশের পদ্মাপাড়ের প্রতারিত কৃষকেরা সিনজেন্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার হাজারো কৃষক সিনজেন্টার হাইব্রিড টমেটো বীজ কিনে নিঃস্ব, প্রতারিত ও রক্তাক্ত হয়েছেন।
চলতি শীত মৌসুমে টমেটো চাষের জন্য স্থানীয় কৃষকেরা সিনজেন্টা বাংলাদেশ লিমিটেডের স্থানীয় ডিলার থেকে সবল এফ-১ হাইব্রিড টমেটো বীজ কিনে জমিতে লাগানোর পর গাছে কোনো ফল ধরেনি এখন পর্যন্ত। একেই বলে, কৃষকের মাথায় হাত। কৃষকেরা ‘গোদাগাড়ী কৃষি উন্নয়ন ঐক্য পরিষদ’-এর ব্যানারে ২৩ নভেম্বর গোদাগাড়ীর মহিষালবাড়ী পশুর হাটে বিক্ষোভ সমাবেশে সিনজেন্টার এই টমেটো বীজে প্রতারণার বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। সিনজেন্টার লাইসেন্স বাতিলের দাবি জানিয়ে স্থানীয় জনগণ এলাকায় সিনজেন্টাকে বয়কটের ঘোষণা করেছে। কৃষকদের এই ন্যায্য দাবির সঙ্গে ইতিমধ্যেই স্থানীয় সাংসদ, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী ও নাগরিক সমাজ একাত্ম হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা প্রধানমন্ত্রীর বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন, যার অনুলিপি কৃষিমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিসচিব ও কৃষি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকদেরও দেওয়া হয়েছে। স্মারকলিপিতে কৃষকেরা জানিয়েছেন, ২০ গ্রাম টমেটো বীজ লাগে এক বিঘা জমির জন্য। সিনজেন্টার সবল এফ-১ হাইব্রিড টমেটো বীজ ২০ গ্রামের দাম ৮৫০ টাকা থাকলেও কৃষকদের কাছ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্তও দাম নেওয়া হয়েছে। এক বিঘা জমি চাষ করতে প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হলেও এখনো জমিতে কোনো টমেটোগাছেই ফল হয়নি। সিনজেন্টার টমেটো বীজ ব্যবহার করে গোদাগাড়ীর কৃষকদের প্রায় ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা, দেশের সব প্রান্তের মানুষ এই করপোরেট বীজে প্রতারণার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি।
সিনজেন্টাই দুনিয়ার প্রথম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যারা কেবল কৃষি বাণিজ্যকেই সরাসরি বাণিজ্যের কেন্দ্র করে আটঘাট বেঁধে জুম-জমিনে নেমেছিল। গ্রিক শব্দ ‘Syn’ মানে সংশ্লেষণ ও সমন্বয় এবং ল্যাটিন শব্দ ‘Gens’ মানে জনগণ থেকেই নাকি ‘Syngenta’ শব্দটি তৈরি হয়েছে। সিনজেন্টার ভাষ্যমতে, সিনজেন্টার মানে হলো ‘Bringing people together’। কিন্তু রাজশাহীতে সিনজেন্টার এই বীজ-প্রতারণা বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তাসহ গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে অভিঘাত তৈরি করার ভেতর দিয়ে জনগণের সঙ্গে তাদের মতো করপোরেট কোম্পানিগুলোর সাংঘর্ষিক সম্পর্ককেই আবারও সত্যে পরিণত করেছে। মনসান্টো, ডুপন্ট, সিনজেন্টা, গ্রুপই লিমাগ্রেইন, ল্যান্ড ও লেকস, বায়ার, কেডব্লিউএস এজি, সাকাটা, ডিএলএফ-ট্রাইফলিয়াম ও টাকিল—এই শীর্ষ ১০ করপোরেট কোম্পানিই সারা দুনিয়ার কৃষি বীজ বাজারের প্রায় ৬৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০৭ সালে সিনজেন্টার বীজ-বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২,০১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর পর এখন পর্যন্ত বছরভিত্তিক সিনজেন্টা কী ফসলের কত বীজ, কতটুকু বিক্রি করে কতটুকু লাভ বা লোকসান করেছে এর কোনো খতিয়ান বারবার সিনজেন্টার কাছে চেয়েও পাওয়া যায়নি। আশা করি, করপোরেট বীজ-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের এই আন্দোলন কৃষকের বীজে কৃষকের আপন অধিকার নিশ্চিতকরণের লড়াইকে আরও মজবুত করবে। বাতিল করবে বীজ ও প্রাণসম্পদে সিনজেন্টার মতো প্রতারক সব করপোরেট কোম্পানির একতরফা নিয়ন্ত্রণ ও দখল।
প্রথম আলো সিনজেন্টার এই সাম্প্র্রতিক বীজ-প্রতারণার খবরটি বেশ গুরুত্ব দিয়ে জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত চার কৃষক সিনজেন্টা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় পরিবেশক রবিউল ইসলামসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ৮ নভেম্বর রাজশাহীর অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে যে মামলা করেছিলেন তার তদন্তভার কৃষি কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে (২৪/১১/২০১০)। কৃষি মন্ত্রণালয় ২৫ জানুয়ারি ১৯৯৩ সালে বিজ্ঞপ্তি আকারে জাতীয় বীজনীতি ঘোষণা করে। এর আগে বাংলাদেশে জাতীয় বীজ অধ্যাদেশ-১৯৭৭, বীজ (সংশোধন) আইন-১৯৯৭, জাতীয় বীজ বিধিমালা-১৯৯৮ গৃহীত হয়। ৩০ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে ‘উদ্ভিদজাত ও কৃষক অধিকার সংরক্ষণ অধ্যাদেশ, ২০০৭’ নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। বাংলাদেশে কৃষকদের পক্ষে বীজসম্পর্কিত আইন ও নীতিমালা না থাকায় বারবার সিনজেন্টার মতো করপোরেট কোম্পানিগুলো দেশের কৃষকদের সঙ্গে একটির পর একটি বীজ-প্রতারণা করে চলেছে। যদিও বর্তমান কৃষিমন্ত্রী বীজ কিনে কৃষক প্রতারিত হলে কোম্পানিকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে নানা সময়ে উত্থাপন করেছেন। কিন্তু এর জন্য একটি সুস্পষ্ট আইন ও নীতিমালা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালের দীর্ঘ বন্যার পর বাংলাদেশ বীজ বোর্ড এসিআই, গ্যাঞ্জেস, ম্যাকডোনাল্ড, মল্লিকা সিড কোম্পানিকে কিছু শর্তসাপেক্ষে হাইব্রিড বীজ আমদানির অনুমোদন দেয়। যেহেতু সেসব হাইব্রিড বীজের নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও সুস্পষ্ট কোনো কাঠামোগত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ছিল না, তাই আজ বাংলাদেশের ধান বাদে সবজি বীজের বাজার প্রায়ই দখল করে নিয়েছে নানা করপোরেট কোম্পানি। জাতীয় বীজনীতিতে বীজ আমদানি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়া বীজ আমদানির ক্ষেত্রে অন্য সব নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হবে (অনুচ্ছেদ-৮.১)। তার মানে কি সিনজেন্টার মতো করপোরেট সব কোম্পানির হাইব্রিড বীজ আমদানির ক্ষেত্রে যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে ফেলা হয়েছে? এর ফলেই কি যা-তা বীজ কৃষকের হাতে গছিয়ে দেওয়ার সাহস করছে এসব কোম্পানি?
আশা করি, সাম্প্র্রতিক রাজশাহীর বীজ-আন্দোলন আমাদের সঠিক কৃষি ও কৃষকবান্ধব নয়া বীজনীতি গ্রহণে বাধ্য করবে। রাজশাহী-১ আসনের সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী তাঁর দেওয়া ওয়াদা অনুযায়ী, সিনজেন্টার সাম্প্রতিক বীজ-প্রতারণার ঘটনাটি আসন্ন সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন করবেন বলে আশা করি। দেশের প্রাণভোমরা কৃষি আর কৃষিবীজ। টমেটোকে অনেক বাঙালি অঞ্চলের কৃষকেরা বিলাতি বাইগনও বলেন। আমাদেরও আছে কতগুলো দেশীয় বিলাতি বাইগনের জাত। বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীর রয়েছে পুরোনো কাপড় কি গামছায়, ঘরের বেড়ায় কি মাটির দেয়ালে বা ছাই দিয়ে লেপটে টমেটো বীজ সংরক্ষণের এক প্রতিরোধী ইতিহাস। সিনজেন্টা কেন, কোনো করপোরেট কোম্পানিরই সাধ্য নেই নিম্নবর্গের সেই প্রতিরোধ দমিয়ে রাখে। সিনজেন্টার বীজ-প্রতারণার বিরুদ্ধে বরেন্দ্রর সাম্প্রতিক দ্রোহ বীজ ইতিহাসের সেই সত্যকেই জানান দিচ্ছে।
===========================
খবর- ৩০ নভেম্বরের হরতালের আগেই মারমুখী পুলিশ  খবর- চট্টগ্রামে ভাঙ্গা ভাঙ্গির রাজনীতি  ফিচার খবর - নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা’র বিরুদ্ধে রাজপথে আনসার-ভিডিপি!  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'প্রটোকল কার' : গরিবের ঘোড়ারোগ' by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন ডা. মিলন' by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী  রাজনৈতিক আলোচনা- 'প্রয়োজন সরকার ও বিরোধী দলের সহাবস্থান' by ড. তারেক শামসুর রেহমান  আলোচনা- 'উপকূলের মাটির মানুষের কান্না' by জয়নুল আবেদীন  আগামী দিনের লক্ষ্য নির্ধারণে দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলন  দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়ার স্বপ্নের নতুন পথ  প্রকৃতি- বাংলাদেশের ঝুঁকি বাড়ছে কমেনি কার্বন নিঃসরণ by ইফতেখার মাহমুদ  প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস 'সামাজিক ব্যবসা অনেক ক্ষেত্রেই বেশিকার্যকর'  আলোচনা- 'তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে করণীয়' by by মোহাম্মদ জমির  রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্রের স্বার্থে পারস্পারিক সম্মানবোধ' by ড. আবু এন. এম. ওয়াহিদ  শিল্প-অর্থনীতি 'চরম দরিদ্রদের তালিকা প্রণয়ন করা হবে' by জাহাঙ্গীর শাহ  বিশেষ রচনা- মেডির মিরাকল by মাসুদ রহমান  ভ্রমণ- 'ঘুরি দেশে দেশে' by মাহফুজ রহমান  প্রকৃতি- 'বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে হাঁক, দ্বিগুণ হবে বনের বাঘ' by খসরু চৌধুরী  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'সংসদীয় গণতন্ত্র, না ভানুমতির খেল' by সোহরাব হাসান  গল্পালোচনা- 'এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু...' by মুস্তাফা জামান আব্বাসী  ফিচার গল্প- ‘ইতালির রাস্তায় পুলিশ খুঁজতাম' by বাবুল আক্তার  খবর- মৃত ভেবে মাছুমার নিথর দেহ ওরা ফেলে দেয় মহাসড়কে


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ পাভেল পার্থ
গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.