আলোচনা- 'উপকূলের মাটির মানুষের কান্না' by জয়নুল আবেদীন

সিডরে বিধ্বস্ত হওয়ার পর দক্ষিণ উপকূলীয় জনপদের মানুষ আইলার জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে। ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। ভেসে গেছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সুন্দরবনসংলগ্ন সাতক্ষীরার বিপন্ন মানুষ এখনো সকাল-বিকেল জোয়ারের পানিতে ভাসে আবার ভাটার টানে জেগে ওঠে। এমনিভাবে কাটে সুন্দরবনসংলগ্ন বনলাউডোন গ্রামের দুই হাজার মানুষের জীবন। বাঁধের ওপর এবং প্রাইমারি স্কুলে তারা আশ্রয় নিয়েছে। এখানে একসময় সচ্ছল গৃহস্থের ধান-চালের অভাব ছিল না।
প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় লাউ-কুমড়া, কচুসহ নানা জাতের শাকসবজি এবং বাগানে নারিকেল-সুপারি ফলত প্রচুর। এখন অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য শাকসবজি হয় না, এমনকি নারিকেল গাছে নারিকেল ফলে না। এখানে বড় সমস্যা পানীয় জলের। ১০ থেকে ১৫ মাইল দূর থেকে পানীয় জল আনতে হয়। পানীয় জল আবার পর্যাপ্ত নয়। রেশনিংয়ের মাধ্যমে সামান্য পরিমাণ পান করে। ফলে রোগবালাই লেগেই আছে। খোলপেটুয়া নদীবেষ্টিত পদ্মপুকুর ও গাবুরার মানুষ এখনো খুঁজে ফেরে স্বজনদের। জেলে পরিবারগুলোর কান্না এখনো থামেনি। পটুয়াখালীর বেঁচে যাওয়া দুর্গত মানুষ আর মাঝেরচরের মানুষের কান্না আজও থামেনি। বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, মঠবাড়িয়া, বৃহত্তর খুলনার দক্ষিণাঞ্চল, ভোলা ও নোয়াখালীর দ্বীপাঞ্চলের জেলে সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র মানুষসহ সিডর ও আইলার ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সমগ্র দক্ষিণ উপকূলে তিন কোটি লোক বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরো তিন কোটি মানুষ। একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে বাস্তুচ্যুত হয় ৬০ লাখ মানুষ। অদূর ভবিষ্যতে দেড় কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হবে। সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কয়েক লাখ ঘরবাড়ি, প্রায় এক লাখ উপাসনালয় এবং ৬৬৭ বর্গ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ধ্বংস হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে অসংখ্য কালভার্ট ও ব্রিজ। কিন্তু সিডরে বিধ্বস্ত তিন বছর ও আইলার জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া মানুষের ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, বেড়িবাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্র আজও নির্মিত হয়নি। বিপন্ন মানুষের আহাজারি একটুও কমেনি।
আইলা ও সিডরের উদ্বাস্তু ৬০ লাখ মানুষ ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে। খুলনা, যশোর ও চট্টগ্রামের বস্তিতেও আরো অনেক উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়ে নানাভাবে পরিবেশ দূষণ করছে। বাড়ছে শহরে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ। গত ৮ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অঙ্ফাম আয়োজিত বরগুনার জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার চার জেলে প্রতীকী জলবায়ু আদালতে তাঁদের অভিযোগ উত্থাপন করেন। আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞের উপস্থিতিতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, এই জেলে সম্প্রদায়ের মানুষের দুর্ভোগের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী। অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত জেলে সম্প্রদায় ও অন্য হাজার হাজার হতদরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ ও মৃত্যুর জন্য দায়ী অধিক কার্বন নির্গমনকারী শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো। তাই এ শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোকেই সব দায়ভার বহন করতে হবে। হাজার হাজার উপার্জনক্ষম মানুষের মৃত্যুতে কয়েক লাখ পরিবার আজ নিঃস্ব-রিক্ত। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন ধনী দেশ, যেগুলো ক্ষতিকর অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ করছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অবশ্যই তাদের দায়ী করব এবং তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লড়াই করব। কেননা সামগ্রিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন সর্বজনীন মানবাধিকারের হুমকি। জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য, সম্পদ, জীবিকা, সংস্কৃতি, বেঁচে থাকার উপায়, বাসস্থান, স্বাধীনভাবে চলাচল ইত্যাদির নিশ্চয়তা দানে বিঘ্ন ঘটায়, যা মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের মৃত্যু, খরা, বন্যা, তাপ, সাগরস্ফীতির জন্য ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন, পশুপাখির ক্ষতিসহ ব্যাপকভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট, বিভিন্ন রোগ ও পানি সরবরাহ ধ্বংস হয়। একই সঙ্গে ব্যাপকহারে বাস্তুচ্যুতি ও জাতীয় উন্নয়নে বিঘ্ন ঘটায়। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব, খাদ্যনিরাপত্তা প্রভৃতির জন্যও হুমকি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদ ও চুক্তি প্রণয়ন ও অনুস্বাক্ষর করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সনদ ও চুক্তি হচ্ছে মন্ট্রিয়ল ও কিয়োটো প্রটোকল। কিয়োটো প্রটোকল অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রগুলো নির্দিষ্ট সময়ে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, সীমিতকরণ ও লঘুকরণের লক্ষ্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জি-৮ ধনী দেশগুলো তাদের করপোরেট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে গ্রিনহাউসের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা স্বীকার করেও অঙ্গীকার রক্ষা করছে না। তাদের অঙ্গীকার রক্ষার বা বাধ্যবাধকতার জন্য কোনো আইন নেই। তারা শুধু প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্তু পালন করছে না। অথচ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশসহ সাগরতীর ও দ্বীপাঞ্চলের মানুষ। এ ভয়ংকর দস্যুসদৃশ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো, যারা বাংলাদেশসহ সাগরতীরবর্তী বহু দেশের লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ও বাস্তুচ্যুতির জন্য দায়ী, তাদের এ বাস্তুচ্যুত মানুষের অভিবাসনসহ স্বীকৃত ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে পারছি না। দাতাগোষ্ঠীর দিকে না তাকিয়ে ত্বরিত ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা সরকারের দায়িত্ব।
ভবদহ ও কপোতাক্ষ-তীরবর্তী ১০ লাখ জলনিমগ্ন দুর্গত মানুষের পাশে দীর্ঘ আট বছরেও দাঁড়ায়নি কোনো সরকার। সরকারি দল, বিরোধী দল, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দেশীয় প্রতিনিধি বাকপটু বিলাসী ধনিকগোষ্ঠী আবেগে কখনো রুমালে চোখ মোছে। সরকারি দল ও বিরোধী দল কেউ গদি রক্ষা ও কেউ গদি পাওয়ার জন্য এবং করপোরেট বহুজাতিক কম্পানির বন্ধুত্বের দৌড়ে কে কত আগে যাবে তার জন্য মূলত লড়াই। কিন্তু তারা কি কখনো বনলাউডোনের পদাবলি শুনে বিচলিত হয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন? একদিকে হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু অপুষ্টি ও পানীয় জলের অভাবে কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় প্রভৃতি রোগে মরছে, অন্যদিকে তথাকথিত নিওলিবারিলিজম বা নয়া উদারীকরণের নামে এককেন্দ্রিক নয়া উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির চাপে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলো সর্বস্বান্ত হচ্ছে।
আমরা দেখতে চাই আগামী কানকুন সম্মেলনে জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবে উদ্বাস্তু ৬০ লাখ হতদরিদ্র মানুষের আবাসনসহ তিন কোটি অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণ আদায়। আসন্ন কানকুন সম্মেলনে জি-৮ দেশগুলোকে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী তাদের জাতীয় আয়ের সাত শতাংশ প্রতিশ্রুত অর্থ বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে পরিশোধ করতে হবে। বর্তমান অবস্থায় তাদের ৫০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। বিশ্বের তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি বাড়লে বিপন্ন দেশগুলোতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হবে এবং কার্বন নিঃসরণকারী ধনী দেশগুলোর দায়ও বাড়বে। বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক ভূভাগ তলিয়ে যাবে। সাগরতীরবর্তী নিচু দেশ ও দ্বীপ দেশগুলো তলিয়ে যাবে। তাই কার্বন নিঃসরণ ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে। কিয়োটো প্রটোকল অনুযায়ী কার্বন ডাই-অঙ্াইড নিঃসরণের দায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ শতাংশ, জাপান ১৩, জার্মানি ৭, যুক্তরাজ্য ৫ শতাংশের বেশি, ইতালি, ফ্রান্স, কানাডা প্রতিটি দেশ ৪ থেকে ৫ শতাংশ করে। অবশ্য এ হিসাব পাঁচ বছর আগের। ইতিমধ্যে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ও শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়েছে এবং আমেরিকার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। ভারত, ব্রাজিল ও রাশিয়া উন্নত ও কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। কিন্তু এ দেশগুলো জাতীয় উন্নয়নের ৯ শতাংশ ওপরে কিছুকাল না রাখা পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ হতে রাজি নয়। তাই ধনী দেশগুলোকে এক কাতারে আনতে না পারা পর্যন্ত গরিব দেশগুলোর দুঃখ সহজে ঘুচবে বলে মনে হয় না। ভয়াবহ ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণের প্রভাব থেকে দেশকে রক্ষার জন্য সরকারি দল ও বিরোধী দলের ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা উচিত।
======================
আগামী দিনের লক্ষ্য নির্ধারণে দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলন  দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়ার স্বপ্নের নতুন পথ  প্রকৃতি- বাংলাদেশের ঝুঁকি বাড়ছে কমেনি কার্বন নিঃসরণ by ইফতেখার মাহমুদ  প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস 'সামাজিক ব্যবসা অনেক ক্ষেত্রেই বেশিকার্যকর'  আলোচনা- 'তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে করণীয়' by by মোহাম্মদ জমির  রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্রের স্বার্থে পারস্পারিক সম্মানবোধ' by ড. আবু এন. এম. ওয়াহিদ  শিল্প-অর্থনীতি 'চরম দরিদ্রদের তালিকা প্রণয়ন করা হবে' by জাহাঙ্গীর শাহ  বিশেষ রচনা- মেডির মিরাকল by মাসুদ রহমান  ভ্রমণ- 'ঘুরি দেশে দেশে' by মাহফুজ রহমান  প্রকৃতি- 'বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে হাঁক, দ্বিগুণ হবে বনের বাঘ' by খসরু চৌধুরী  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'সংসদীয় গণতন্ত্র, না ভানুমতির খেল' by সোহরাব হাসান  গল্পালোচনা- 'এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু...' by মুস্তাফা জামান আব্বাসী  ফিচার গল্প- ‘ইতালির রাস্তায় পুলিশ খুঁজতাম' by বাবুল আক্তার  খবর- মৃত ভেবে মাছুমার নিথর দেহ ওরা ফেলে দেয় মহাসড়কে  অদ্ভুত ফিচার- 'বাংলার বিস্ময়ঃ আশ্চর্য কুলাগিনা' by মেহরিন জাহান  স্মরণ- 'ডা. মিলনকে যেন না ভুলি' by পলাশ আহসান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'যার যা কাজ' by আতাউস সামাদ  নিবন্ধ- 'অবলা বলে কেন না-বলা থাকবে' by মোস্তফা হোসেইন  ইতিহাস- সিপাহি বিদ্রোহঃ সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে 


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ জয়নুল আবেদীন
শিক্ষা গবেষক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.