ইতিহাস- সিপাহি বিদ্রোহঃ সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে

চট্টগ্রাম বাংলাদেশে সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা হয় চট্টগ্রামে। সে সময় ৩৪ নম্বর দেশীয় পদাতিক বাহিনীর তিনটি কম্পানি ছিল চট্টগ্রামে। এসব কম্পানিতে কোনো বাঙালি সৈন্য ছিল না। ব্যারাকপুরে ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চে মঙ্গল পাণ্ডের বিদ্রোহের পর চট্টগ্রামের দেশীয় সৈন্যদের পুরো বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় ক্যাপ্টেন পি এইচ আর ডয়েল। পরে ২২ এপ্রিল এক আবেদনপত্রের মাধ্যমে নিজেদের এসবের বাইরে রাখার প্রতিজ্ঞা করে দেশীয় সৈন্যরা। তার পরও ইংরেজ প্রশাসন সিপাহিদের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেনি। শহরে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। যা শহরে স্থানীয় এবং ইউরোপীয়দের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি করে।
সন্দেহ আর উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে নভেম্বর মাসটি চলে আসে। তখন পর্যন্ত ইংরেজ প্রশাসন নির্দিষ্ট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে তারা গোপন সূত্রে এটা জেনে যায়; ১৭ নভেম্বর ব্যারাকের এক ভোজসভায় সিপাহিরা বিদ্রোহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। অবশেষে তা-ই হয়। পরের দিন অর্থাৎ ১৮ নভেম্বর রাত ৯টায় কারাগার দখলের মাধ্যমে বাংলাদেশে সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা হয়। কারাগার থেকে কয়েদিদের মুক্ত করা হয়। বিদ্রোহের পর সিপাহিরা আর চট্টগ্রামে থাকেনি। সরকারি কোষাগার লুট করে অর্থ-সম্পদ এবং তিনটি সরকারি হাতিসহ ১৯ নভেম্বরের শেষ রাতে নেপালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তারা। যাওয়ার আগে নিজেদের ব্যারাকে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়।
কুমিল্লা
চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সিপাহিরা নেপাল যাওয়ার পথে প্রথমে ত্রিপুরা যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা ত্রিপুরা রাজাকে বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির বিরুদ্ধে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেন না রাজা। তা ছাড়া কুমিল্লায় থাকা ইউরোপীয়রা সিপাহিদের মোকাবিলা করার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছিল ঢাকায়। শহরের কোষাগারের টাকা পয়সাও পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকায়। সম্ভবত ডিসেম্বরের প্রথম দিকে কুমিল্লা শহরের ২০ মাইলের মধ্যে চলে আসে বিদ্রোহীরা। কিন্তু দাউদকান্দিতে ইউরোপীয় নৌবাহিনী মোতায়েন থাকায় সিপাহিরা দিক পরিবর্তন করে সিলেট চলে যায়।
সিলেট
ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো সিপাহি বিদ্রোহের সময় সিলেটেও দারুণ উত্তেজনা দেখা যায়। এর কারণও ছিল, ৭৩ নম্বর দেশীয় পদাতিক বাহিনীর সদরদপ্তর ছিল জলপাইগুড়িতে। যা ছিল সিলেটের কাছেই। বিদ্রোহের প্রথম থেকেই সিলেটের ইংরেজ প্রশাসন আর স্থানীয়দের মধ্যে যথারীতি সন্দেহ আর উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সিলেটে থাকা ইউরোপীয়রা ঘন ঘন সভা করে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা ঠিক করার চেষ্টা করছিলেন। তাদের মূল চিন্তা ছিল সিলেট কোষাগারের অর্থ কিভাবে বিদ্রোহীদের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। কেউ কেউ তো প্রস্তাব করেন কোষাগারের অর্ধেক অর্থ সিপাহিদের দিয়ে দেওয়া হোক এ শর্তে, কোষাগারের বাকি অর্থ নিরাপদ থাকবে। শেষ পর্যন্ত সেটা আর হয়নি। সিলেটের তখনকার কালেক্টর লারকিন এবং অন্যান্য ইংরেজ টাকা কলকাতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। তা ছাড়া জয়ন্তিয়ার রাজা দেবেন্দ্র সিংহ যাতে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ না দেন সে ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। সে সময় সিলেটে থাকা লাইট ইনফ্যান্ট্রির সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ করেনি। যদিও তারা ছিল উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের। তবে অক্টোবর মাসে দুর্গা পূজার দিন সুরমা নদীর তীরে (সম্ভবত দেবী দুর্গা বিসর্জনের দিন) সৈন্যদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের কারণে এক রাত সৈন্যদের জঙ্গলেই কাটাতে হয়, পরের দিন নিজেদের ব্যারাকে ফেরে তারা। এরপর মোটামুটি সবকিছু একপ্রকার শান্তই ছিল। একসময় শোনা যেতে লাগল চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করা সৈন্যরা সিলেটে আসতে পারে। ডিসেম্বর মাস নাগাদ সেটাই হয়। বিদ্রোহী সিপাহিরা সিলেটে পেঁৗছে যায়। লাইট ইনফ্যান্ট্রির অধিনায়ক মেজর আর বি বাং তাদের বাধা দিতে লাতু থানার সীমান্তে শাহবাজপুর পরগনার করিমপুর হাজির হন। সেখানে ১৯ ডিসেম্বর সকালে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই হয়। প্রথমে বিদ্রোহী সিপাহিরা লাইট ইনফ্যান্ট্রির সৈন্যদের বিদ্রোহে যোগ দিতে আহ্বান করে। কিন্তু সাড়া না মেলায় অবশেষে লড়াই বাধে। যুদ্ধে মেজর বাংসহ
পাঁচ সৈন্য মারা গেলেও বিদ্রোহীরা
পরাজিত হয়ে গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যায়।
রাজশাহী
ভারতের সিপাহি বিদ্রোহের কথা উঠলে ব্যারাকপুরের নাম চলে আসে সবার আগে। কিন্তু ১৮৫৬ সালের জুলাই মাসে ৭৩ নম্বর দেশীয় পদাতিক বাহিনীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে চলে আসত রাজশাহীর নাম। কেননা সে সময় ৭৩ নম্বর দেশীয় পদাতিকের সৈন্য রাজশাহীতেই ছিল। তাঁদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় অভিযুক্ত সিপাহিদের সামরিক আদালতে বিচার করে শাস্তি দেওয়া হয়। এরপর ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালীন কোনো প্রকার উত্তেজনা দেখা যায়নি রাজশাহীতে। স্থানীয় জমিদার এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা সভা করে সরকারের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। রাজশাহীর মেসার্স ওয়াটসন কম্পানি আত্মরক্ষার জন্য সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে স্থানীয় ইউরোপীয়দের নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে। এ ছাড়া স্থানীয় নীল কুঠিয়ালরাও একটি ছোট শক্তিশালী বাহিনী গঠন করে। বিদ্রোহের সময় রাজশাহী থেকে ভারতের মধ্যপ্রদেশসহ অন্যান্য অঞ্চলের কম্পানির সৈন্যদের রসদ পাঠানো হতো। জলপাইগুড়িতে ১১ নম্বর অনিয়মিত অশ্বারোহী বাহিনী বিদ্রোহ করে রাজশাহী চলে এলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই বাধে। তাতে বিদ্রোহীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
সূত্র : সিপাহি যুদ্ধ ও বাংলাদেশ, রতনলাল চক্রবর্তী, বাংলা একাডেমী
==============================
আন্তর্জাতিক- 'কোরিয়া সীমান্তে তুলকালাম' by দাউদ ইসলাম  আন্তর্জাতিক- 'চেচনিয়ার ‘যুদ্ধবাজ ইমাম’ by মিজান মল্লিক  আন্তর্জাতিক- আমি স্বাধীনতা চাই না: রমজান কাদিরভ  সাহিত্যালোচনা- 'মৃত্যুশতবার্ষিকীর তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  গল্পসল্প- 'দুঃখটাকে ভাগাভাগি করি' by মুহম্মদ জাফর ইকবাল  গল্প- 'দাদার দোকানে শূন্য দশক' by সালাহউদ্দিন  শিল্পি- 'সফিউদ্দিন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র-অশেষ আলোর আলোর আধার' by সৈয়দ আজিজুল হক  নিবন্ধ- 'সব শিল্পই যাবে প্রকৃতির কাছে। by খান মিজান  গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুরী  ইতিহাস- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের হৃদয়সংবেদী ডায়েরি' by দেবেশ রায়  স্মরণ- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের মৃত্যু-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি' by বেলাল চৌধুরী  ইতিহাস- 'বাংলায় সিপাহি বিদ্রোহ' by রিদওয়ান আক্রাম  শিল্প-অর্থনীতি 'এখন প্রয়োজন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের' by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্র : চাইলেই ধরা দেয় না' by এমাজউদ্দীন আহমদ  আন্তর্জাতিক- 'কোরীয় অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে?' by জগলুল আহমেদ চৌধূরী  আলোচনা- 'মানসিক নির্যাতনের প্রতিকার কোথায়' by আশরাফ-উল-আলম  আসুন, ওদের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিইঃ গোলটেবিল বৈঠক।এইচআইভি/এইডস : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও মানবাধিকার  আলোচনা- 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'  আলোচনা- 'নেত্রীর অশ্রুপাত, হরতাল এবং অ্যাকশনে বিএনপি' by সঞ্জীব রায়  আলোচনা- 'আরো আলোকিত হোক জনশক্তি রপ্তানি খাত'


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে

এই লিখা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.