বিশেষ রচনা- মেডির মিরাকল by মাসুদ রহমান

খারাপ আবহাওয়ায় গাড়ি চালনায় যুক্তরাষ্ট্রের ওরিগনবাসী এক কথায় ওস্তাদ। না হয়ে উপায় নেই, সেখানকার আবহাওয়া যে বড়ই খাপছাড়া। এখন ভালো তো তখন খারাপ! ৩৯ বছর বয়সী স্টেফানি ম্যাকরেও ওরিগনবাসী। স্বভাবতই তিনিও ‘ঝড়কে আমি করব মিতে’ নীতিতে অভ্যস্ত। ২০০৯ সালে তেমনি এক ঝড়-বাদলামুখর দিনের কথা। ঘড়িতে তখন ঠিক রাত সাড়ে আটটা। ম্যাকরে তাঁর ফোর্ড গাড়িতে চেপে টিলামুকের পাশের একটি গির্জার উদ্দেশে বেরিয়েছিলেন। সঙ্গে তিন ছেলেমেয়ে।
ম্যাকরের ১১ বছর বয়সী বড় মেয়ে মেডি বসেছিল তাঁর পাশেই। পেছনের আসনে বাকি দুজন। একজনের বয়স দুই, আরেকজনের তিন। সন্ধ্যা থেকেই ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। সাউথ প্রেইরি রোডে উঠতেই বৃষ্টির দাপুটে ভঙ্গি দেখে প্রমাদ গুনতে হলো ম্যাকরেকে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এতই বড় বড়, পারলে যেন গাড়ির উইন্ডশিল্ড ভেঙে ফেলে! তার পরও গাড়ি ছুটতে থাকল। সাউথ প্রেইরি রোডের পরই ফসেট খাঁড়ি। সেই খাঁড়ি পেরোনোর জন্য বিশাল এক বাঁক নিতে হয়। ম্যাকরে গাড়ির স্টিয়ারিং সেভাবেই ঘোরালেন। আর ঘোরাতে না ঘোরাতেই তাঁর চোখ ছানাবড়া! দেখেন, সামনের রাস্তা পুরোপুরি গায়েব! আর সেখানকার ছোট্ট কালভার্টটিও হাওয়া, পানির তোড়ে গুঁড়িয়ে গেছে তা। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘটে গেল আরেক দুর্ঘটনা। প্রাণপণ চেষ্টা করেও গাড়ির গতি রোধ করতে পারলেন না ম্যাকরে। পুরোপুরি লাগামছাড়া গাড়িটা পড়ল গিয়ে পাক্কা ২০ ফুট নিচে, ১০০ ফুট প্রস্থের নদীর জলে! অজস্র পাথর আর ভেঙে পড়া গাছপালার ডালের সঙ্গে ম্যাকরের গাড়িটিও পাক খেতে থাকল লাট্টুর মতো। পাক খেতে খেতে গাড়িটি গড়াতে লাগল টিলামুক নদীর দিকে। ঘটনাস্থল থেকে মাত্র সোয়া মাইল দূরেই সেই নদী। চিল-চিৎকার দিলেন ম্যাকরে, ‘হায় খোদা, বাঁচাও আমাদের!’
কিন্তু বাঁচার কোনো আশাই দেখলেন না ম্যাকরে। মত্ত হাতির মতো ছুটতে থাকল গাড়িটা। সঙ্গে জানালার কাচে জলের প্রবল বেগ। ভাগ্যিস, গাড়িটি একসময় কতগুলো গাছের গুঁড়ির মধ্যে আটকে গেল! তা দেখেই ঝট করে উঠে দাঁড়াল ম্যাকরের মেয়ে মেডি! ছোট্ট মেয়েটা গাড়ির পেছনের জানালাটা খুলে ফেলল কী মনে করে। হাঁ করে সব দেখতে থাকলেন ম্যাকরে। ‘কদিন আগেই পা ভেঙে ফেলেছিল, এখনো ঠিক সেরে ওঠেনি মেয়েটা! এ অবস্থায় কী করছে সে?’ মনে মনে ভাবেন তিনি। নদীর জল তখন ক্রমবর্ধমান। মেডি হঠাৎ গাড়ির ছাদে উঠে মাকে বলল, ‘সবাইকে নিয়ে ওপরে উঠে এসো।’ কল দেওয়া পুতুলের মতো তা-ই করলেন ম্যাকরে। দুই বছরের বাচ্চাটিকে বুকে আর তার বড়টিকে দুই পায়ের মধ্যে নিয়ে বিধ্বস্ত ছাদে বসে থাকলেন মেয়ের কথামতো। আশ্চর্যের ব্যাপার, বাচ্চা দুটি তখন পুরোপুরি শান্ত!
‘মা, আমি বাইরে গিয়ে দেখি সাহায্য পাওয়া যায় কিনা।’ বলেই মেডি ইতিউতি তাকাতে থাকল। চারপাশে তখন ঘনঘোর আঁধার! মেয়ের প্রস্তাবে কী বলবেন ভেবে পান না মা। এমন বিপদের সময় ছোট্ট মেয়েটা তাঁকে প্রতিনিয়ত অবাক করছে। ভেবে দেখলেন, এটাই শেষ আশা। তাই সব দিক চিন্তা করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, মা! আমি তোমার জন্য গর্বিত, সাবধানে থেকো!’
মায়ের মুখে অমন কথা শুনেই উঠে দাঁড়াল মেডি। মনে মনে বলল, ‘জানি, আমি পারবই!’ খাঁড়ি থেকে তাদের দূরত্ব তখন ২৫ ফুটের মতো। ৯৫ পাউন্ডের ছোট্ট মেডির কাঁধে তখন গুরুদায়িত্ব। জানে, তার ওপরই নির্ভর করছে বাকি সবাই। হঠাৎ গাড়ির ওপর চিকন-চাকন মতো একটা গাছের ডাল দেখেই বুকে সাহস পায় সে। চোখ বন্ধ করে তাতেই ঝুলে পড়ে। সেটা ধরে ধরে মেডি একসময় ঠিকই খাঁড়িটার তীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ঝাঁপ দেয় একটা ঝোপের মধ্যে। মা ম্যাকরের অবস্থা ততক্ষণে আরো সঙ্গিন। জল উঠে গেছে বুক পর্যন্ত। পা দুটিও পুরো নিঃসাড়। তবে খানিক বাদে খাঁড়ির তীরে মেয়ের অবয়ব দেখে আশায় বুক বেঁধে থাকেন তিনি।
তীরে উঠেই দৌড়াতে শুরু করে মেডি। দৌড়াতে দৌড়াতে সামনে একটা বেড়া চোখে পড়ে তার। সেটা ডিঙানো ছাড়া উপায় নেই। তবে তা করতে গিয়েই আবার আরেক বিপদ! বিদ্যুতায়িত সেই বেড়ায় শক খায় মেডি! তাতেও নিরস্ত হয় না সে। চার-পাঁচবার চেষ্টা করে সফল হয় একসময়। ফের দৌড়। হঠাৎ দূরে পাহাড়ের ওপর পোর্চ লাইট চোখে পড়ে। সাহস বেড়ে যায় দশ গুণ। সেদিক পানেই ছুটতে থাকে মেডি। সেখানে পৌঁছেই লোকজনকে সবকিছু খুলে বলে সে। লোকজন তড়িঘড়ি করে ফোন দেয় ৯১১ নম্বরে। কয়েক মিনিট বাদেই ছুটে আসেন উদ্ধারকর্মীরা।
মেডিকে নিয়ে তারা ছোটেন দুর্ঘটনাস্থলে। ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। কাত হয়ে ভাসতে থাকা একটা কিছু চোখে পড়ে মেডির। কিন্তু ‘না, এটা আমাদের গাড়ি নয়!’ বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। খানিক বাদেই আঁধার ফুঁড়ে ম্যাকরের গলা শোনা যায়, ‘আমি এখানে! আমাদের উদ্ধার করো!’ ব্যস, হাসি খেলে যায় মেডির চোখেমুখে। উদ্ধারকর্মীরাও ছুটে যান শব্দের উৎসস্থলের দিকে। কিন্তু গাড়িটির অবস্থান দেখে তাঁদের আক্কেলগুড়ুম। তাঁদের মই যে অত দূর যায় না। বুদ্ধি খেলে যায় উদ্ধারকারী দলের প্রধানের। আরও ৩৫ ফুট লম্বা মই জুড়ে নিয়ে ছুটে যান ম্যাকরের কাছে। একে একে উদ্ধার করেন সবাইকে।
পরদিন ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন ম্যাকরে, সঙ্গে ছিল মেয়ে মেডি। দিনের আলোয় সবকিছু দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল তাদের। উদ্ধারকারী দলের প্রধানও ছিলেন সেখানে। সবকিছু দেখে তিনি তো মহা বিস্মিত, ‘মেডি যে ডালটি ধরে খাঁড়ির তীরে পৌঁছেছিল, তা খুব বেশি হলে চার ইঞ্চি ডায়ামিটারের! ছোট্ট মেয়েটা সেই ডালে কী করে ঝুলল, তা আমার মাথায় ঢোকে না! অবিশ্বাস্য!’ সত্যিই অবিশ্বাস্য কাজ করেছিল মেডি। তাই তাকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে একটা। তবে সে খুশি খেলার সঙ্গীদের কাছে ফিরে যেতে পেরে। আর তার মা ম্যাকরে বললেন, ‘মিরাকল থেকে কোনো অংশে কম ছিল না তা!’
=========================
ভ্রমণ- 'ঘুরি দেশে দেশে' by মাহফুজ রহমান  প্রকৃতি- 'বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে হাঁক, দ্বিগুণ হবে বনের বাঘ' by খসরু চৌধুরী  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'সংসদীয় গণতন্ত্র, না ভানুমতির খেল' by সোহরাব হাসান  গল্পালোচনা- 'এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু...' by মুস্তাফা জামান আব্বাসী  ফিচার গল্প- ‘ইতালির রাস্তায় পুলিশ খুঁজতাম' by বাবুল আক্তার  খবর- মৃত ভেবে মাছুমার নিথর দেহ ওরা ফেলে দেয় মহাসড়কে  অদ্ভুত ফিচার- 'বাংলার বিস্ময়ঃ আশ্চর্য কুলাগিনা' by মেহরিন জাহান  স্মরণ- 'ডা. মিলনকে যেন না ভুলি' by পলাশ আহসান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'যার যা কাজ' by আতাউস সামাদ  নিবন্ধ- 'অবলা বলে কেন না-বলা থাকবে' by মোস্তফা হোসেইন  ইতিহাস- সিপাহি বিদ্রোহঃ সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে  আন্তর্জাতিক- 'কোরিয়া সীমান্তে তুলকালাম' by দাউদ ইসলাম  আন্তর্জাতিক- 'চেচনিয়ার ‘যুদ্ধবাজ ইমাম’ by মিজান মল্লিক  আন্তর্জাতিক- আমি স্বাধীনতা চাই না: রমজান কাদিরভ  সাহিত্যালোচনা- 'মৃত্যুশতবার্ষিকীর তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  গল্পসল্প- 'দুঃখটাকে ভাগাভাগি করি' by মুহম্মদ জাফর ইকবাল  গল্প- 'দাদার দোকানে শূন্য দশক' by সালাহউদ্দিন  শিল্পি- 'সফিউদ্দিন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র-অশেষ আলোর আলোর আধার' by সৈয়দ আজিজুল হক  নিবন্ধ- 'সব শিল্পই যাবে প্রকৃতির কাছে। by খান মিজান  গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুর


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
রিডার্স ডাইজেস্ট অবলম্বনে মাসুদ রহমান


এই রচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.