নিবন্ধ- 'অবলা বলে কেন না-বলা থাকবে' by মোস্তফা হোসেইন

আলোর দিশা খোঁজে নারী, পুরুষের কাছে। বন্ধু, আপনজন কিংবা স্বামী যে নামেই তিনি সানি্নধ্যে আসুন না কেন, পথসঙ্গী হওয়ার কথা তাঁর। প্রয়োজনে হতে পারেন পথপ্রদর্শকও। এই দুয়ে মিলে সুন্দর জীবন রচিত হবে, এই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যত্যয় ঘটে অনেক ক্ষেত্রে। পুষে রাখা স্বপ্নগুলো খান খান হয়ে যায় অপঘাতে। কেন রক্তাক্ত হয় স্বপি্নল সব ইচ্ছা? স্পষ্টতই বলা যায়, ব্যক্তি-মানুষটি তখন মনুষ্যত্বের বোধ হারিয়ে ফেলে, আবেগ-ভালোবাসা পরাজিত হয় স্বার্থের কাছে, তখনই ব্যত্যয় ঘটে।
সেই স্বার্থও আবার ব্যক্তিকেন্দ্রিক। একান্তই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় মানুষ। নিজের কথা চিন্তা করে, নিজের স্বার্থকে সর্বোচ্চে স্থান দেয়। ভালোবাসা, মনুষ্যত্ববোধ, আবেগ_সবই তুচ্ছ হয় তাঁর কাছে। নিজের ঘনিষ্ঠতম মানুষটিকেও ডিঙিয়ে যেতে থাকে সেসব আকাঙ্ক্ষা। বলে নেওয়া ভালো, সেই পেছনে পড়া মানুষটি আর কেউ নন, তিনি পুরুষেরই জীবনসঙ্গিনী এবং ধর্মত তার নাম স্ত্রী। সেই স্ত্রীকে পুরুষ দূরে ঠেলে দিতে দ্বিধা করে না। তার ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাতে একবারের জন্যও দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। কেন এমন হয়? কেন মানুষের কাছে মানুষের মূল্য থাকে না? ব্যক্তি-সংঘাত এখানে সৃষ্টি হয় একেবারেই অমানবিকতাকে কেন্দ্র করে। যদি খোঁজ করা হয় কারণ সম্পর্কে, স্পষ্ট দেখা যাবে_পুরুষত্বের অহংবোধ আর পুরুষের ব্যর্থতা ঢাকার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রচেষ্টা হিসেবেই নেমে আসে দুর্যোগ। সেই দুর্যোগই তৃতীয় বিশ্বে নারীর গায়ে আঘাত হিসেবে কার্যকর হয়। আসে শারীরিকভাবে, কখনো বা মানসিকভাবেও।
বাংলাদেশ সে ক্ষেত্রে অগ্রগামী অনেকটা। নারীর ওপর শারীরিক কিংবা মানসিক আঘাতের অবস্থানটা কোথায়? কী পরিমাণ নারী এ দেশে নির্যাতিত হয় প্রতিদিন? কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই কারো কাছে, যা আছে সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। একেকটি প্রতিষ্ঠান একেক রকম পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ তহবিলের একটি তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের অন্তত ৪৭ শতাংশ নারী পুরুষের হাতে নির্যাতিত হয় নিত্যদিন। আর এ নির্যাতনটা বর্বরোচিতভাবে শারীরিক আঘাতের মাধ্যমেও হয়ে থাকে। গত বছরের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে শুধু যৌতুকের কারণে ৮১ জন নারীকে জীবন দিতে হয়েছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এসব ঘটনায় গ্রামীণ সালিস কিংবা সামাজিক বিচারেও নারীই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। নারী নির্যাতনের সংখ্যা এবং মাধ্যমেরও কমতি নেই এ দেশে। বিচারের নামে নারী নির্যাতিত হয় সামাজিকভাবে, এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয় নারী প্রতিপক্ষ পুরুষের কুপ্রস্তাব কিংবা নির্যাতন নীরবে সহ্য না করার কারণে। জঘন্যতম এ আঘাতের মাত্রা যে কত ভয়াবহ তা বোঝা যায় ২০০৯ সালের একটি পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে। সে সময় বাংলাদেশে ১৮১ জন নারীর গায়ে এসিড ছুড়ে মারা হয়েছে প্রায় একই কারণে। অথচ কঠোর আইন আছে এসিড নিক্ষেপকারীর বিরুদ্ধে। কিন্তু আইন প্রয়োগে যে উপাদান প্রয়োজন সে যে কঠিন হয়ে পড়ে ভুক্তভোগীর পক্ষে জোগাড় করা। ফলে আইন থেকে যায় কাগজে-কলমে। নারী মুক্তি পায় না নির্যাতন থেকে। আর কোনো এসিড নিক্ষেপকারীই ফাঁসিতে ঝোলে না আদালতের রায়ে।
নির্যাতন হয় ধর্মের নামেও। কী দুর্বিষহ সেই চিত্র। ফতোয়া দেওয়া হয় ধর্মের কথা বলে। সেই ফতোয়ার সিংহভাগেরই ভুক্তভোগী হয় নারী। ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজও যদি বিচারের বিষয় হয়, সেখানেও দেখা যায় অপরাধী যেন একা নারী। গ্রাম্য সালিস হলে তো কথাই নেই। পুরুষ বিচারকদের চোখ চলে যায় নারীর দিকে। নারীকেই দোররা খেতে হয়, ভর্ৎসনা খেতে হয় কিংবা গ্রামছাড়া-সমাজছাড়া হতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষক পার পেয়ে যায়, কিছুই হয় না তার। কারণ সামাজিকভাবে নারীর অবস্থান দুর্বল হয় আর ধর্ষক হয়ে থাকে প্রভাবশালী।
নারী নির্যাতনের মাত্রা বাংলাদেশে বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনক হারে। ২০০৯ সালের একটি পরিসংখ্যান দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। ইত্তেফাকের একটি সংবাদে জানা যায়, ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ১২ হাজার ৬৪৯টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সেই হিসাবে বলতে হয়, প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছে প্রায় ৩৫ নারী, যা ২০০৮ সালের চেয়ে কিছু কম। বীভৎস চিত্র বলে মনে হয় কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরে বিচারপ্রার্থী মহিলা আসে গড়ে দৈনিক প্রায় পাঁচজন। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে যারা বিচার চাইতে আসে তা নির্যাতিতদের সামান্য অংশ মাত্র। বলতে দ্বিধা নেই, আগতদের প্রায় সবাই ঢাকা শহরের।
সেই অর্থে বলা যায়, সারা দেশের চিত্র কতটা ভয়াবহ। গ্রামের নারী কখনো মুখ খুলে কিছু বলে না। সামাজিক প্রথা এখনো এতই অতীতমুখী যে সেখানে নির্যাতন সইতে সইতে চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলেও নারী অভিযোগ করে না স্বামী কিংবা শ্বশুরের বিরুদ্ধে। আর স্বামী যতই নির্যাতন করুক না কেন, তারা মনে করে_স্বামীর পদতলে স্ত্রীর বেহেশতহেতু স্বামীর নির্যাতন সইতে পারাটা তার জন্য ত্যাগেরই পরিচায়ক।
এমনি বর্ণনা একের পর এক দেওয়া যাবে। কিন্তু প্রতিকারের সহজ উপায় কী? আর ভুক্তভোগীদের সহায়তায় কি কেউ এগিয়ে আসবে না? আইনগত দিকটি দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সুতরাং রাষ্ট্র তার নাগরিককে সুরক্ষার জন্য কতটা আন্তরিক। তা নির্ভর করে সেখানে প্রযোজ্য আইনগত দিকগুলোর দিকে তাকালে। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ প্রণীত হয়েছে জাতীয় সংসদে। বিধিমালা প্রণীত না হলেও এ আইন কিছুটা আশার আলো দেখাতে পারে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে গিয়ে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ (২০০৩ সালে সংশোধিত) প্রয়োগ করতে গিয়ে বেশ কিছু অসুবিধা হচ্ছে। এ নিয়েও প্রয়োগকারী সংস্থা এবং ভুক্তভোগীদের অভিমত ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে। সুতরাং এ মুহূর্তে সবার আগে প্রয়োজন হচ্ছে, সেই আইনটি আবারও সংশোধন করা। আর পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০-এর আলোকে বিধিমালা প্রণয়নের কাজটিও অতি দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের আইনটি সংশোধন করা কতটা যে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে তা উপলব্ধি করা যায় সাম্প্রতিক ইভ টিজিংয়ের কারণে কিশোরীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা দেখার পর। শঙ্কা দেখা দিয়েছে, আইন করেও এ প্রবণতা রোধ করা যাবে কি না। একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। ইভ টিজিংয়ের কারণে আত্মহত্যা করছে কিশোরী। কিংবা ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শিক্ষক কিংবা অভিভাবককে প্রাণও দিতে হচ্ছে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রী সিমি, মোহাম্মদপুরের ফাহিমা, গাইবান্ধার তৃষার মতো অনেক মেয়েকেই জীবন দিতে হয়েছে ইভ টিজিং সইতে না পারায়। উচ্চ আদালত থেকে কিছু দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে এ অপঘাতকে মোকাবিলা করার জন্য। সরকারও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বিচারের ব্যবস্থা করছে। কিন্তু তার পরও বলা যাবে না ইভ টিজিংয়ের পরিধি খুব একটা কমেছে।
সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, নারী যখন মায়ের আসনে বসেন তখন তিনি যেমন শ্রদ্ধেয়, বোনের আসনে বসেন তখনো তিনি সম্মানের; কিন্তু যখনই এর বাইরে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক হয় তখনই ব্যত্যয় ঘটে কেন? তিনি মা যেমন, তেমনি প্রেয়সীও তো হতে পারেন। কিন্তু শত্রু হবেন কেন? আর এ শত্রুতারও যে যোগসূত্র নেই। তার পরও তাঁকে তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিতই শুধু নয়; বরং তাঁকে নির্মমতার দিকে ঠেলে দেওয়া হবে কেন? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে সন্তান, স্বামী, ভাই কিংবা তাদের মতো পুরুষদের। তাদের মনে রাখতে হবে, শান্তির জন্য শাস্তি নয়, চাই ভালোবাসা। যে ভালোবাসা হতে পারে একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে। সেখানে যদি খাঁদ মিশে যায়, যদি সেখানে বিষাক্ত কাঁটা বিঁধে যায় তাহলেই অশান্তিপূর্ণ হবে পৃথিবী। তেমনটা চাই না আমরা কেউ। সম্মান করব প্রেয়সীকে। সম্মান করব নারীকে। তাঁকে নিজের সুখ-দুঃখের অংশীদার করব নিজেরই শান্তির আশায়। আমরা স্মরণ করতে পারি, ডরথি আর কলগ্যানের কবিতার পঙ্ক্তিমালা-
'I promise to give you the best of myself
and to ask of you no more than you can give me
I promise to respect you as your own person
and to realize that your interests, desires and needs
are no less important my own, I promise to share with you my time and my attention...
=========================
ইতিহাস- সিপাহি বিদ্রোহঃ সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে  আন্তর্জাতিক- 'কোরিয়া সীমান্তে তুলকালাম' by দাউদ ইসলাম  আন্তর্জাতিক- 'চেচনিয়ার ‘যুদ্ধবাজ ইমাম’ by মিজান মল্লিক  আন্তর্জাতিক- আমি স্বাধীনতা চাই না: রমজান কাদিরভ  সাহিত্যালোচনা- 'মৃত্যুশতবার্ষিকীর তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  গল্পসল্প- 'দুঃখটাকে ভাগাভাগি করি' by মুহম্মদ জাফর ইকবাল  গল্প- 'দাদার দোকানে শূন্য দশক' by সালাহউদ্দিন  শিল্পি- 'সফিউদ্দিন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র-অশেষ আলোর আলোর আধার' by সৈয়দ আজিজুল হক  নিবন্ধ- 'সব শিল্পই যাবে প্রকৃতির কাছে। by খান মিজান  গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুরী  ইতিহাস- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের হৃদয়সংবেদী ডায়েরি' by দেবেশ রায়  স্মরণ- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের মৃত্যু-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি' by বেলাল চৌধুরী  ইতিহাস- 'বাংলায় সিপাহি বিদ্রোহ' by রিদওয়ান আক্রাম  শিল্প-অর্থনীতি 'এখন প্রয়োজন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের' by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্র : চাইলেই ধরা দেয় না' by এমাজউদ্দীন আহমদ  আন্তর্জাতিক- 'কোরীয় অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে?' by জগলুল আহমেদ চৌধূরী


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মোস্তফা হোসেইন


এই নিবন্ধ'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.