রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্রের স্বার্থে পারস্পারিক সম্মানবোধ' by ড. আবু এন. এম. ওয়াহিদ

উনিশ শ' বাহাত্তর সাল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কতর্ৃক আযোজিত নবীনবরণ অনুষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান অতিথি ছিলেন যথাক্রমে, তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান এবং প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল ফজল। প্রধান অতিথির ভাষণে অধ্যাপক আবুল ফজল সামান্য কয়েকটি কথা বলেছিলেন। দীর্ঘ আটত্রিশ বছর পর, আজও মনে পড়ে তাঁর সেদিনের দুয়েকটি কথা।
তিনি বলেছিলেন, "শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র টেকে না। আধুনিক গণতন্ত্রের সুতিকাগার - ইংল্যান্ডে একটা কথা খুবই প্রচলিত, 'হার ম্যাজেস্টিজ গভর্নমেন্ট এন্ড হার ম্যাজেস্টিজ অপজিশন'। যার মানে, সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী দল সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ দু'এর সমন্বয়ে বৃটিশ গভর্নমেন্ট কাজ করে। একটা ছাড়া আরেকটা অচল। বাংলাদেশের জন্যও এটা অপরিহার্য"। অধ্যাপক আবুল ফজলের কথার সূত্রধরে, বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সামপ্রতিক ধারা, চর্চা, ও বর্তমান হালচালের একটা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
উনিশ শ' নব্বই-একানব্বই এর গণ-আন্দোলন, গণ-অভু্যত্থান, ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু'টি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জাতীয় রাজনীতিতে, জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং জামাতে ইসলামীর গুরুত্ব প্রান্তিক অবস্থানে চলে যায়। ওই সময়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আবির্ভাব সুস্থ গণতন্ত্র বিকাশের জন্য শুধু শুভ লক্ষণই নয়, বরং অপরিহার্য ছিলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাদের সম্পকর্, প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার গন্ডি পেরিয়ে, অতি দ্রুত শত্রুতায় পরিণত হলো। যা, গত বিশ বছর ধরে, ক্রমান্বয়ে অবনতি হতে হতে, বর্তমানে তাদের মধ্যে এক যুদ্ধংদেহী অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কারোরই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এর পেছনে অনেকগুলো জটিল ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। দোষ, কম বেশি দু'তরফেই আছে, এবং আরো দোষের বিষয় হলো, কোনো পক্ষই এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট নয়। দু'পক্ষই দু'এক বার যে উদ্যোগ নেননি, তাও নয়। কিন্তু তাদের উদ্যোগগুলো যে নিছক লোক দেখোনো ছিলো, তা যেমন তারা নিজেরা জানেন, তেমনি জনগণও জানে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্টে, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বৈরি সম্পর্ক কোনো অবস্থাতেই বাঞ্ছনীয় নয়। এটা কোনো দলের জন্যই শুভ নয়। দেশের জন্য তো নয়ই। এক দল আরেক দলকে রাজনৈতিক এবং কুটনৈতিক কৌশলে চাপের মুখে রাখতেই পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, অংগ সংগঠনের ঠ্যাংগাড়ে বাহিনী, এবং হয়রানী মূলক মামলা দিয়ে, বিরোধী দলকে কোনঠাসা করে রাখা, কোনো অবস্থাতেই কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে যুক্তি সংগত কাজ হতে পারে না। আমাদের দেশে কঠিন বাস্তবতা হলো, দু'দলই পালাক্রমে, এই নেতিবাচক নোংরা কাজটি সঠিকভাবেই করতে কসুর করছে না। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে, উভয় দলই স্বীকার করবে যে, গণতন্ত্রে দু'দলই সমানভাবে অপরিহার্য। এক পক্ষ ছাড়া আরেক পক্ষের অস্তিত্ব অর্থহীন।
মুখে না বললেও, আওয়ামী লীগের মনোভাব, "আমরা যখন বিরোধী দলে ছিলাম, তখন বিএনপি আমাদেরকে সংসদে কথা বলতে দেয়নি। আমরা এখন দেবো কেন"? বিএনপির মনোভাব, "আমরা যখন সরকারে ছিলাম, তখন আওয়ামী লীগ সংসদকে কার্যকর করতে দেয়নি। আমরা এখন দেবো কেন"? এ যেন দু'টি ক্ষুদ্র বালক-বালিকা খেলায় ঝগড়া করে আড়ি দিয়ে বসে আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সম্পর্ক পুনস্থাপনে, কেউ যদি মনে করেন দু'দল সামনাসামনি আলোচনার টেবিলে বসে, এক দিনে সব সমস্যার সমাধান করে নতুন যাত্রা শুরু করবে, তাহলেও সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে কোন এক যায়গা থেকে যে যাত্রাটা শুরু করে, আস্তে আস্তে বরফ গলার সুযোগ করে দিতে হবে, এতে আশা করি কেউই দ্বিমত পোষণ করবেন না। আমার মতে, এই শুরুটা হওয়া উচিৎ সংসদে। যেখানে যাওয়ার আগে, দু'দল একটা নূ্যনতম ঐকমত্যে পৌঁছাবে যে, সংসদীয় ভাষায় উভয় দল সংসদে কথা বলতে শুরু করবে। কেউ কাউকে গালমন্দ করবে না, মিথ্যাচার করবে না, অহেতুক নোংরা ভাষায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করবে না, কেউ কারো চরিত্র হনন করবে না, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আর আমার মতে এর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে, একটু নমনীয় হয়ে, রাজনৈতিক উদারতা দেখিয়ে।
নির্বাচনের সময় উভয় দলই জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, সংসদকে তারা সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ বিন্দু বানাবে। বলাইবাহুল্য সংসদ যদি সর্বাংশে কার্যকর হয়ে গড়ে ওঠে, তাহলে সে হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি বড় সাফল্য। এক্ষেত্রে মত ভিন্নতা সত্ত্বেও উভয়দলের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানবোধের বহি:প্রকাশ থাকা দরকার কথায় ও কাজে। দু' দলকেই যথেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের সাথে কাজ করে যেতে হবে। কারণ খেলায় জিততে হলে, জনগণকে ইম্প্রেস করতে হবে। আর জনগণ যে বোকা নয়, তার প্রমাণ তারা বার বারই দিচ্ছে। কঠিন সত্যটি উভয় দলকেই উপলব্ধি করতে হবে।
========================
শিল্প-অর্থনীতি 'চরম দরিদ্রদের তালিকা প্রণয়ন করা হবে' by জাহাঙ্গীর শাহ  বিশেষ রচনা- মেডির মিরাকল by মাসুদ রহমান  ভ্রমণ- 'ঘুরি দেশে দেশে' by মাহফুজ রহমান  প্রকৃতি- 'বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে হাঁক, দ্বিগুণ হবে বনের বাঘ' by খসরু চৌধুরী  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'সংসদীয় গণতন্ত্র, না ভানুমতির খেল' by সোহরাব হাসান  গল্পালোচনা- 'এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু...' by মুস্তাফা জামান আব্বাসী  ফিচার গল্প- ‘ইতালির রাস্তায় পুলিশ খুঁজতাম' by বাবুল আক্তার  খবর- মৃত ভেবে মাছুমার নিথর দেহ ওরা ফেলে দেয় মহাসড়কে  অদ্ভুত ফিচার- 'বাংলার বিস্ময়ঃ আশ্চর্য কুলাগিনা' by মেহরিন জাহান  স্মরণ- 'ডা. মিলনকে যেন না ভুলি' by পলাশ আহসান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'যার যা কাজ' by আতাউস সামাদ  নিবন্ধ- 'অবলা বলে কেন না-বলা থাকবে' by মোস্তফা হোসেইন  ইতিহাস- সিপাহি বিদ্রোহঃ সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে  আন্তর্জাতিক- 'কোরিয়া সীমান্তে তুলকালাম' by দাউদ ইসলাম  আন্তর্জাতিক- 'চেচনিয়ার ‘যুদ্ধবাজ ইমাম’ by মিজান মল্লিক  আন্তর্জাতিক- আমি স্বাধীনতা চাই না: রমজান কাদিরভ  সাহিত্যালোচনা- 'মৃত্যুশতবার্ষিকীর তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  গল্পসল্প- 'দুঃখটাকে ভাগাভাগি করি' by মুহম্মদ জাফর ইকবাল  গল্প- 'দাদার দোকানে শূন্য দশক' by সালাহউদ্দিন


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ ড. আবু এন. এম. ওয়াহিদ
টেনেসী ষ্টেট ইউনিভার্সিটি


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.