পা খুঁজছে ষোলো মাত্রা

লেভেন্ডিস’ মার্কা নয়, পুরোপুরিই ‘লেভেন্ডিস’ কাকা রেফারিদের কোপদৃষ্টিতে পড়ে গেল সেদিন। বেচারাকে লাল কার্ড দেখিয়ে খেলার শেষ মুহূর্তে মাঠছাড়া করেছেন। এই দিন ‘গা ঝাড়া’ দিয়ে তার আসল ফর্মে প্রায় চলে এসেছিল। সারা মাঠ দাপিয়ে খেলছিল, বলের জোগান দিচ্ছিল সবাইকে গোল করার জন্য।
আর্জেন্টিনার মেসি বা তেভেজের মতোই অপ্রতিরোধ্য ব্রাজিলের এই কাকা। তার তো ফাউল করা সাজে না। কিন্তু প্রতিপক্ষের তিন-চারজন প্রতি মুহূর্তে ঘিরে থাকায় ব্যূহ ভেদ করে বের হওয়ার নানা কসরত করতে করতে, বিপক্ষের ছেঁকে ধরা খেলোয়াড়দের ক্রমাগত ধাক্কা খেতে খেতে কখন যে রেগে কাঁই হয়ে বড়সড় ফাউলের ভাবনা মনে পোষা শুরু করেছিল কাকা, তা দর্শক তেমন না বুঝলেও মাঠের ‘জজ সাহেব’ রেফারি ঠিকই গুরুত্ব দিয়ে নজরে রাখছিলেন। ফলে শেষতক লাল কার্ড দেখিয়ে বিদায় করেছিলেন নির্দ্বিধায়। তবে বোঝা গেল না, কাকা তাতে খুশি খুশি ভাব নিয়ে মাঠ ছাড়ছিলেন কেন?
কাকার এই লাল কার্ড খাওয়া ব্রাজিলের জন্য বিপদ ডাকারই শামিল। তো, এই কাকাকে লেখার শুরুতেই ‘লেভেন্ডিস’ বলা হলো কেন, তার ব্যাখ্যাটি এবার খোলাসা করি। অনেকের মতো ব্রাজিলের এই খেলোয়াড়টি আমারও খুব পছন্দের। ফুটবল খেলোয়াড়দের ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’—ঢাকাইয়া ভাষায় যে বলে ‘চাপা-টাইট’ এবং ‘গিটঠু লাগা’—সে ব্যাপারটি কাকার ক্ষেত্রে খাটে না। বেশ সুদর্শন, হ্যান্ডসাম খেলোয়াড়। সেই জন্যই ‘লেভেন্ডিস’ শব্দটির ব্যবহার। শব্দটি গ্রিক। মানে হলো ‘অতীব হ্যান্ডসাম।’
একেই বোধহয় বলে, ‘এক ভাষার বুলি অন্য ভাষায় গালি’। এই শব্দটি অর্থাৎ ‘লেভেন্ডিস’ কথাটি বাংলায় আঞ্চলিকতা মিশিয়ে আমরা উচ্চারণ করি ‘মাজুল’ বা ‘ল্যাবা-স্যাবা’ অর্থে। একেবারেই বিপরীত দিক। কাউকে তেমন দেখলে ঠাট্টা করে এই শব্দ ব্যবহূত হয়। তো, কাকার জন্য ঠাট্টা করে বাংলার শব্দটি বলা নয়, এটি দারুণ প্রশংসাসূচক অর্থে বলা। যা-ই হোক, খেলার কথায় আসা যাক। দেখতে দেখতে খেলা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রথম পর্ব প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে এরই মধ্যে খেলার ভাবগতিক পাল্টেছে অনেকটাই। এত দিনে বড় দলগুলোর যেন হুঁশ ফিরেছে। আড়মোড়া ভেঙে স্বমূর্তিতে ফেরার চেষ্টায় নেমেছে। আন্ডারডগ ভাবা দলগুলোর কাছে গদি হারানোর যে উপক্রম হয়েছে এবং দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়েছে, তা থেকে নিষ্কৃতি পেতে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে বড়রা।
এমনটা তো হতেই হবে। কারণ, সবার লক্ষ্য মই দিয়ে ওপরে ওঠার দিকে। প্রাথমিক ধাপগুলো পেরিয়ে যাওয়ার ভাবনাই এখন সবার কাছে মুখ্য। ‘চলো চলো, ষোলোয় চলো’—এই একটাই মন্ত্র আউড়ানো চলছে এখন। পরবর্তী সময়ে কী হবে, সেটা নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। তবে গণনা বা হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গেছে ষোলোতে পা দেওয়া নিশ্চিত বা প্রায়নিশ্চিত দলগুলোর। ষোলোতে পৌঁছে কার সঙ্গে কার খেলা পড়বে এবং কাকে কে কীভাবে ট্যাকল করবে, তার ছকও তৈরি শুরু করে দিয়েছে।
তো, ষোলোতে যাওয়ার খেলায় যাদের প্রায় ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ার পথে, তাদের মধ্যে আর্জেন্টিনাই নিজেদের মান-সম্মান, নাম-সুনাম আর শক্তি-সামর্থ্য দেখিয়ে সবার চেয়ে সেরা বলে বিবেচিত যে হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। ব্রাজিল মন ভরাতে পারেনি। পর্তুগাল ছন্দে ফিরেছে। তবে দুর্বল প্রতিপক্ষকে একগাদা গোল দিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লেও ‘সমানে সমান’দের সঙ্গে কত দূর কী করবে তা এখনো সঠিক করে বলা যায় না। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়। স্পেন হন্ডুরাসকে হারাল। কিন্তু সমপর্যায়ের সঙ্গে খেলতে গিয়ে কী করবে, কে জানে। ছয়টি মহাদেশের মধ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা ভালো গেল না। এশিয়া থেকে শুধু দক্ষিণ কোরিয়া এ পর্যন্ত নিজেদের ষোলোর জন্য টিকিয়ে রাখতে পারল। অন্য দুটির তো হাল খারাপ। অতএব, মূল পর্বের দিকে এগিয়ে যাওয়া দলগুলো দক্ষিণ আমেরিকা আর ইউরোপেরই হবে চিরাচরিত নিয়মে, তা প্রায় সবার ধারণা। তবে দক্ষিণ আমেরিকা বনাম দক্ষিণ আমেরিকা যে ফাইনাল হবে না, তা-ই বা কে বলতে পারে। খেলা দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপের কাপটা চিরদিন ওখানেই ঘুরেফিরে থাকবে যেন। আটলান্টিক বা প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে আসা সহজ হবে না। চিলি, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, মেক্সিকোর যে ভাবসাব, তাতে এবার যেমনই ফলাফল হোক, ভবিষ্যতে অন্যদের জন্য খবর হয়ে যাবে।
তো, এবার আমার কথা বলি। এখনো সাপোর্ট দেওয়ার দল কোনটা হওয়া উচিত, ভেবে উঠতে পারিনি। ষোলো দলের খেলার পর্বের পরই মনে হয় ঠিক করতে হবে। সেই পর্বের দিকে তাকিয়ে আছি।

No comments

Powered by Blogger.