বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কম প্রত্যাশার সম্মেলন নিয়েও অনেক আশা by শওকত হোসেন

জেনেভায় সারা বছরই কোনো না কোনো সম্মেলন লেগে আছে। জাতিসংঘের অনেকগুলো সংস্থার প্রধান কার্যালয় সুইজারল্যান্ডের এই ছোট শহরটিতে। এ কারণেই হয়তো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সপ্তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন নিয়ে তেমন উত্তাপ চোখে পড়ল না, যেমনটি চোখে পড়েছিল ষষ্ঠ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে, ২০০৫ সালে।
এর ওপর পৌঁছেছি রোববার। তাই ছুটির দিনের আমেজ সর্বত্র। রাস্তায় খুব একটা মানুষ চোখে পড়ে না। সূর্যের মুখও দেখা গেল না। মেঘলা আবহাওয়া, এখন প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে বলে জানা গেল।
সাংবাদিকদের জন্য ব্যাজ আনতে যেতে হবে ডব্লিউটিওর প্রধান কার্যালয়ে। মূল ফটকের সামনেই কয়েক সারি ইস্পাতের ব্যারিকেড বসানো। উদ্দেশ্য, বিক্ষোভকারীদের বাধা দেওয়া। শনিবার এখানে বিশ্বায়নবিরোধীরা বিক্ষোভ করেছে। পুলিশের বাধার মুখে গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে বলেও জানা গেল।
এ ঘটনায় ডব্লিউটিওর মহাপরিচালক প্যাসকাল লামি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, যাঁরা ডব্লিউটিওর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন, তাঁদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ভাষা যারা সংলাপ বা গঠনমূলক আলোচনা কোনোটাই চায় না, এ রকম কিছু লোকের সহিংসতায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’
লামি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ডব্লিউটিও সব সময়ই সুশীল সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে, ভবিষ্যতেও করবে।
এবারের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ইন্টারন্যাশনাল করফারেন্স সেন্টার জেনেভায় (সিআইসিজি)। সোমবার বেলা তিনটায় সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা (বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সম্মেলন শুরু হয়নি)। সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনের পরেই শুরু হবে সম্মেলনের মূল কাজ। এই মূল অধিবেশনে প্রতিটি দেশের দলনেতা তিন মিনিট করে বক্তব্য রাখার সুযোগ পাবেন। এই তিন মিনিটে মূল কথাগুলো বলে দিতে হবে। এই তিন মিনিটের বক্তৃতাপর্ব চলবে তিন দিন ধরে। এর পাশাপাশি শেষ দুই দিন অর্থাত্ সোম ও মঙ্গলবার দুটি কর্ম-অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রথম কর্ম-অধিবেশনের বিষয়বস্তু ঠিক করা হয়েছে ‘দোহা কর্মপরিকল্পনাসহ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা’। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন সংস্থাটির মহাপরিচালক প্যাসকাল লামি। দ্বিতীয় কর্ম-অধিবেশনের বিষয়বস্তু ‘উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও উত্তরণে ডব্লিউটিওর অবদান’। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাধারণ অধিবেশনের সভাপতি চিলির অর্থমন্ত্রী আন্দ্রেস ভেলোসকো এতে সভাপতিত্ব করবেন। ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সমাপনী অধিবেশনের পর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সম্মেলন শেষ হবে।
এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা এবং সাম্প্রতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিবেশ’।
এবারের সম্মেলন কোনো দরকষাকষির বৈঠক নয়। এটি মূলত ডব্লিউটিওকে টিকিয়ে রাখার বৈঠক।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি দুই বছর পরপর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন হতে হবে। কিন্তু ২০০৫ সালের পর চার বছরের মাথায় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই দিক থেকে দরকষাকষির বৈঠক না হলেও এটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। ফলে সম্মেলনের মূল অধিবেশন শুরুর আগেই যার যার অবস্থান নেওয়া শুরু হয়ে গেছে।
যেমন, উদ্বোধন হওয়ার আগে থেকেই বিভিন্ন দেশ বা দেশগুলোর জোট অনেকগুলো বৈঠক করে ফেলেছে। ডব্লিউটিওর বিভিন্ন ইস্যুতে কে কোন অবস্থান নেবে, সেটি ঠিক করতেই এসব বৈঠক হয়েছে।
মূলত কৃষির ওপর ভর্তুকি কমানো এবং অকৃষি পণ্যের শুল্ক হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় দুই বছর পরপর সম্মেলন করার বাধ্যবাধকতা মানা হয়নি। আবার দোহা উন্নয়ন আলোচনার অগ্রগতিও অনেক ধীর। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা দেওয়ায় আলোচনার গতি আরও পিছিয়ে পড়েছে।
এই অবস্থায় ২০১০ সালের মধ্যে দোহা উন্নয়ন আলোচনা শেষ করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এবারের সম্মেলনেই আলোচনা অনেকখানি এগিয়ে রাখতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ডব্লিউটিওর গ্রহণযোগ্যতা এমনিতেই নানা প্রশ্নের মুখে। আর এই মুহূর্তে ডব্লিউটিওর সবচেয়ে বড় সমর্থক এখন ছোট অর্থনীতির দেশগুলো। এই বাণিজ্য আলোচনা সফল করার তাগিদ এসব দেশ থেকেই বেশি আসছে।
এবারের বৈঠক নিয়ে প্রত্যাশা কম। তবে ডব্লিউটিও ঠিকমতো কাজ করছে কি না, সেই পর্যালোচনা এবার হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যেভাবে আলোচনা ও দরকষাকষি চলছে, তা সঠিক কি না, সে প্রশ্নও কেউ কেউ করছেন। আবার ডব্লিউটিওর নিজেরই সংস্কার প্রয়োজন বলেও আলোচনা নানা দিক থেকে তোলা হচ্ছে।
ফলে এবারের সম্মেলন দরকষাকষির বৈঠক না হলেও ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এদিকে তিন দিনের সম্মেলনের প্রাক্কালে উন্নয়নশীল দেশগুলো এক বিবৃতিতে দোহা আলোচনাপর্ব দ্রুত শেষ করতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
২০০১ সালের কাতারের রাজধানী দোহায় ডব্লিউটিওর চতুর্থ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে বিশ্ব বাণিজ্যের দোহা পর্ব সূচনা করা হয়। কিন্তু কৃষি খাতে উদারীকরণ ও অকৃষি খাতে বাজারসুবিধা দেওয়া নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে মতবিরোধ দূর না হওয়ায় এখন পর্যন্ত এই পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করা যায়নি।
উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোগ করছে, উন্নত দেশ বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র দোহা পর্ব সমাপনে বাধার সৃষ্টি করেছে।
জেনেভায় ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেলসো অ্যামোরিম যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘শুধু একটি দেশ আমাদের সামনে এগোতে বাধা দিচ্ছে।’
গতকাল সোমবার সম্মেলন শুরুর আগে কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক ১৯টি দেশের জোট কেয়ার্নস গ্রুপ কৃষি বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবধান না কমায় হতাশা ব্যক্ত করেছে। এই দেশগুলো বিশ্বের কৃষি রপ্তানির ২৫ শতাংশ অংশীদার।

No comments

Powered by Blogger.