রাষ্ট্র যখন নির্মম হয়ে ওঠে by সৈয়দ বদরুল আহ্সান

আমাদের এই রাষ্ট্রটা ক্রমাগতভাবে নির্মম হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা-ই বা কী করে বলি? সত্য তো আরও রূঢ় হতে পারে। বোধ করি, আমাদের এখন বলতে দ্বিধা নেই যে রাষ্ট্র বহু বছর আগেই নির্মম হয়ে গেছে। এবং বর্তমানে যা দেখছি তাতে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে এখন সেই নির্মম হওয়ার ভিত্তিটা দিনে দিনে মজবুত হচ্ছে। তা-ই যদি না হয়, তবে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের মতো একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় মানুষ—একজন খাঁটি দেশপ্রেমিককে কেন পুলিশি আক্রমণের শিকার হতে হবে? এমন একজন শিক্ষক যখন পুলিশি নির্যাতনের কারণে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন তখন সেই লজ্জা বহন করার ভার আমাদের সবার ওপর বর্তায় এই কারণে যে আমাদের নীরবতার জন্যই, আমাদের প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকার ফলেই রাষ্ট্র এত ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। যে দেশে শিক্ষককে লাঠিপেটা করা হয় সে দেশে বর্বরতা যে কী গভীর রূপ নিয়েছে, সে ব্যাখ্যা আমাদের না দিলেও চলে। যে দেশে পুলিশ হিংস্র হয়ে ওঠে এবং এতটুকু দ্বিধা করে না নাগরিককে পেটাতে, সে দেশে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রে নিশ্চয় পচন ধরেছে। ঠিক একই ধরনের পচন ধরেছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বেছে বেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান ছিল শত্রুরাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রকে আমরা একসময় বাংলাদেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। আজ যখন খোদ বাংলাদেশকে একটি ভয়ঙ্কর রূপ দেওয়া হয়েছে এবং এই কাজটি ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে আরম্ভ করা হয়, তখন আমাদের একটাই প্রশ্ন—নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের নিজ রাষ্ট্রের হাতে কতটা নিরাপদ? আজ আনু মুহাম্মদকে পুলিশ পিটিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। আগামীকাল একই কায়দায় আরেকজন শিক্ষক নির্যাতনের শিকার হবেন। এবং সেই আহত শিক্ষককে হাসপাতালে গোটা কয়েক মন্ত্রী সহানুভূতি জানাতে যাবেন, বলবেন তদন্ত করা হবে। ওই পর্যন্তই।
তবে আনু মুহাম্মদকে নিয়ে যে এত লজ্জাকর একটি কাণ্ড ঘটে গেল তাতে তো অবাক হওয়ার কিছুই নেই। বিশেষ করে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে ঢাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে পাঠিয়ে দিল এবং সেই রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তাঁদের ওপর কী অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল, সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি আমাদের সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা ওইসব ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পারব, যাঁরা এ অপরাধ করেছেন এবং তাঁদের সবাইকে বিচারের কাঠগড়ার দাঁড় করাতে পারি। হ্যাঁ, পৃথিবীতে অনেক দেশ রয়েছে যেখানে রাষ্ট্র আরও বেশি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের তো অন্য রকম রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল। এই দেশে তো সামরিক শাসন হওয়ার কথা ছিল না। একাত্তরের বিজয়ের পর বাঙালি জাতি তো কখনো ভাবেনি, এই নতুন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে একদিন আবার নতুন করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রচলন হবে। একে একে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ স্বাধীন দেশে নিহত হয়েছেন এবং অন্যদিকে যারা পাকিস্তানের হয়ে কাজ করেছিল, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হয়েছে। এসব ব্যক্তি একাত্তরে নির্মমতার পরিচয় দিয়েছিল। সেই নির্মম রূপ তারা আবার স্বাধীন বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয় ১৯৭৫-এর পরবর্তী সময়ে। তাই আজ যখন রাষ্ট্রকে নির্মম রূপ ধারণ করতে দেখি, তখন সেই অতীতেই ফিরে যেতে হয়। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে আমাদের সব সাহসী রাজনৈতিক নেতাকে আমরা নিহত হতে দেখেছি। নির্মমভাবে জাতির জনককে হত্যা করা হয় অথচ আমরা কোনো প্রতিবাদ করিনি। আজ যখন জেনারেল সফিউল্লাহকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তাঁর ভূমিকার কারণে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় এবং সেটা যথার্থ কারণেই, তখন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি না কেন—কই, আমরা তো সেই দিন কোনো প্রতিবাদ করিনি! যে বঙ্গবন্ধুর কথায় আমরা যুদ্ধে গিয়েছি সেই বঙ্গবন্ধু যখন মৃতদেহ হয়ে সিঁড়িতে পড়ে আছেন তখন আমরা সবাই তো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাড়িতে বসে ছিলাম। আমাদের হাত থেকে আমাদেরই সৃষ্ট রাষ্ট্র ফসকে গেল। এবং তারপর ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর আকার নিতে শুরু করল। যে দেশের মানুষ এত আন্দোলন করল বছরের পর বছর গণতন্ত্র আদায়ের জন্য, সে দেশেই আবার সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে নিল এবং জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ আমাদের সেই সুন্দর স্বপ্ন, সেসব আকাঙ্ক্ষাকে গুঁড়িয়ে দিলেন—যেগুলো আমরা এত দিনে হয়তো বাস্তবায়িত করতে পারতাম। তাঁরা ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের মতো নিজেদের রাষ্ট্রের সঙ্গে এক করে ফেলেন; স্বৈরশাসকের মতো রাষ্ট্রও হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর।
দেশে সামরিক শাসন এখন নেই। কিন্তু সেই শাসনের রেশ এখনো রয়ে গেছে। ওই যে ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ধরে নিয়ে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হলো এবং ছাত্রদের অমানবিকভাবে কষ্ট দেওয়া হলো এ সবই সেই সামরিক শাসন ও সামরিক মেজাজের বহিঃপ্রকাশ। আজ যখন আমরা জাতি হিসেবে প্রস্তুতি নিচ্ছি বাংলাদেশ রাইফেলসের সেসব জওয়ান, যারা এতগুলো সামরিক বাহিনীর অফিসার হত্যা করল, তাদের বিচারে আনার জন্য, তখন আমাদের এও দাবি থাকবে—সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীর যে লোকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের ওপর ২০০৭ সালে নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের বিচারের সম্মুখীন করা হোক। বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করতে হলে সব ধরনের অন্যায়-অত্যাচারের তদন্ত এবং সেটা দ্রুততার সঙ্গে করা প্রয়োজন। যে নম্র, ভদ্র ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র আমরা পেয়েছিলাম ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত, সে রাষ্ট্রকে ফিরে পেতে হলে বর্তমান যে রাষ্ট্রীয় নির্মমতা রয়েছে, সেটা আগে দূর করা দরকার। পুলিশ সাংবাদিক পেটাবে এবং প্রবীণ ফটোসাংবাদিককে ঘুষি মেরে মটিতে ফেলে দেবে—এটা আমরা যত দিন সহ্য করে যাব তত দিন আমরা আমাদের নিজেদের বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব। ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদকে কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ হাজতে নিয়ে যাবে, আর আমরা বলব দেশে গণতন্ত্র বিরাজমান, তা তো হয় না। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান সেই শহরের মেয়রের প্রদত্ত হুমকির কারণে এবং প্রাণ ও মানসম্মান রক্ষা করার জন্য শহর ত্যাগ করবেন—এ বাস্তবতা আমরা কেন মেনে নেব? শাসক দল ভালো করে জানে, এ ক্ষেত্রে কী ঘটেছে। তাহলে আইনগতভাবে সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অপারগ কেন? ক্ষমতাসীন হলে অথবা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেই কি সবাইকে ভয় দেখাতে হয়?
বিগত বিএনপি-জামায়াত আমলে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক পদে পদে অপমানিত হয়েছে। যখনই বিরোধী দল কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা বলেছে তখনই রাষ্ট্র পথে-প্রান্তরের যাকেই পেয়েছে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়েছে এবং সোজা কারাগারে নিয়ে গেছে। কেউ গ্রাম থেকে এসে গুলিস্তানে নেমেছেন, কেউ তাঁর কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার জন্য পথে নেমেছেন, কেউ হাসপাতালে অসুস্থ আত্মীয়কে খাবার দেওয়ার জন্য বেরিয়েছেন—এঁরা সবাই পতিত হয়েছেন কারাগারে। তাঁরা কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন অনেক দিন পর—বিভিন্ন পর্যায়ে পুলিশকে খুশি করে। রাষ্ট্র যে এসব নাগরিককে এবং যেহেতু তাঁরা অতি দরিদ্র—এঁদের অপমান করল, এ দিকটা দেখবে কে? আজ পর্যন্ত তো এ বিষয়ে কোনো প্রতিকার চাওয়া হয়নি, কোনো মামলা করা হয়নি সেদিনকার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে।
আর প্রতিকারের কথা যখন উঠেছে তখন আরেকটু বলতে হয়। এই গেল কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের মাঝে অনেকেই তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন এই বলে যে যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে কিছুসংখ্যক সামরিক ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে সেই এলাকার বাঙালি বসবাসকারীরা সম্ভাব্য বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। উত্তরে এটাই বলব যে সে ধরনের সমস্যা হবে না। তারপর যেটা বলব এবং যে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো—আমরা বাঙালিরা কোন অধিকারে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণের এলাকায় নিজেদের জন্য ঘরবাড়ি সম্পত্তি করলাম? ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে যে হারে চাকমা এবং অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠী আমাদেরই রাষ্ট্রের হাতে নিপীড়িত হয়েছে সেই কথা আমরা বলি না কেন? এই যে অগণিত টক শো হয় টেলিভিশনে এবং বিভিন্ন জায়গায় এত গোলটেবিল আলোচনা হয় পার্বত্য অঞ্চলকে নিয়ে, সেখানে তো কেউ বলে না, কতজন আদিবাসী প্রাণ হারিয়েছে তাদের জায়গাজমি ও ঐতিহ্য আমাদের বাঙালিদের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে। যখন ফিলিস্তিনি এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয় তখন আমরা যথার্থই প্রতিবাদ করি। সেই প্রতিবাদটি আমরা আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রে করি না কেন—যখন আমাদের বাঙালিরাই সাঁওতালদের বাসভূমি দখল করে নেয়, যখন চাকমা নরনারী আমাদের ভয়ে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়?
চোখ বন্ধ করে থাকলে হবে না। বাস্তবতাকে অস্বীকার করা অথবা ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে ডিনায়াল মোডে থাকা অত্যন্ত নাজুক এবং ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাতে পারে। রাষ্ট্র কল্যাণকর হলে, আধুনিক মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হলে অবশ্য তা হয় না, আনু মুহাম্মদও রাজপথে লুটিয়ে পড়েন না এবং আদিবাসীরাও ভয়ে পালিয়ে বেড়ায় না।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.