ব্রাজিল ৩: ১ আর্জেন্টিনা -আর্জেন্টিনায় ব্রাজিলের উত্সব


খেলোয়াড় ম্যারাডোনা বা দর্শক ম্যারাডোনা অনেক বেশি সজীব, সপ্রাণ। একটা গোল হলে শিশুতোষ উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন। একটা গোল খেলে তাঁর মুখে গুমরে ওঠে কান্নার দমক। দর্শক ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার জয়ে নিজের জার্সিকে আকাশি-নীল পতাকা বানিয়ে ঘোরান বন বন করে। কিন্তু কোচ ম্যারাডোনা অন্য রকম। তিনি নির্বিকার। তিনি পাথুরে মূর্তি হয়ে ডাগআউটে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। বড়জোর দাঁত দিয়ে নখ কামড়ান। কাল পুরোটা ম্যাচই যেমন নিশ্চুপ রইলেন। আর ২৪ থেকে ৩০—এই ৬ মিনিটে ব্রাজিল যখন ২ গোল করে ম্যাচের ভাগ্যলিপি প্রায় লিখে ফেলেছে, তখন নখ কামড়াতে থাকলেন।
কী আর করবেন! ফলপ্রত্যাশী দুঙ্গার দুর্দান্ত এই ব্রাজিলের বিপক্ষে ০-২ গোলের উল্টো স্রোতে গিয়ে অতিকাঙ্ক্ষিত জয়টা পাওয়া সম্ভব নয়, এটা হয়তো বুঝেই গিয়েছিলেন ‘এল পেলুসা’। হ্যাঁ, নিজেদের মাঠে সর্বস্ব পণ করে আর্জেন্টিনার চাওয়া জয়টা ব্রাজিল ছিনিয়েই নিয়ে গেছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলে পরাজয়ের লজ্জায় ডুবিয়ে লাতিন আমেরিকার ১০ দলের মধ্য থেকে সবার আগে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের টিকিট কেটে ফেলেছে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। এই অঞ্চল থেকে সরাসরি চার দল যাবে বিশ্বকাপের মূল পর্বে। কিন্তু পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে থাকা দুদলের চেয়ে তিন ম্যাচ বাকি থাকতে ৯ পয়েন্টেরও বেশি এগিয়ে গিয়ে নির্ভার এখন কাকা, রবিনহো, লুসিও বা দুঙ্গার ব্রাজিল। এই দলটিকে লুসিও কিংবা দুঙ্গার ব্রাজিল নামেই ডাকা ভালো। এখানে কাকা কিংবা রবিনহোর আক্রমণাত্মক, শিল্পিত ফুটবলের ছোঁয়া তো ছিল না। এই দলটি অধিনায়ক ও রক্ষণভাগের নেতা লুসিওর নেতৃত্বে, দুঙ্গার তত্ত্বাবধানে রক্ষণকে নিয়ে গেছে ইতালীয় শিল্পের পর্যায়ে। গোলকিপার হুলিও সিজার গোলপোস্টে যেন অতন্দ্র প্রহরী। আর লুসিও, লুইজাও, মেইকন ও সান্তোস আর্জেন্টিনার আক্রমণগুলোকে নস্যাত্ করেছেন হাসতে হাসতে।
এই লুইজাওই কাল সূচনা করেছেন আর্জেন্টিনার সর্বনাশের। ২৪ মিনিটে এলানোর ফ্রিকিকে ডি-বক্সের মধ্যে ফাঁকায় বল পেয়ে অব্যর্থ হেডে শেল বিঁধিয়েছেন মেসিদের বুকে। সেট পিসের এই গোলটাই খেলার চিত্রটা দেয় বদলে। যে আর্জেন্টিনা প্রথম ২০ মিনিট ছিল প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক, মেসি ও তেভেজের মাধ্যমে অন্তত বার দুই যারা কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্রাজিলের রক্ষণ, তারা যেন হারিয়ে যেতে থাকে খেলা থেকে। আক্রমণের মূল স্তম্ভ লিওনেল মেসিকে আর কেউ যোগ্য সমর্থন দিতে না পারায় নৈরাশ্যই জমা হয় তাদের কাছে।
তবে ব্রাজিলের সমার্থক যে ছন্দময় আক্রমণাত্মক ফুটবল, সেটি তেমন দেখা গেল কই! কাকার কারিকুরি যাও দু-একবার দেখা গেছে, রবিনহো ছিলেন অদৃশ্য। আর্জেন্টিনা কেঁপে উঠেছে লুইজাওয়ের মতো দীর্ঘদেহী ডিফেন্ডারদের ভয়ে, যারা লাফিয়ে উঠে কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারঙ্গম। ভয় পেয়েছে দীর্ঘদেহী স্ট্রাইকার লুইস ফ্যাবিয়ানোকে আর সেট পিস বিশেষজ্ঞ এলানোকে। যাঁর ফ্রিকিক মানেই আর্জেন্টিনার রক্ষণের বিপদ এবং পরীক্ষা। ৩০ মিনিটে লুইস ফ্যাবিয়ানো দলকে ২-০ এগিয়ে দিলেন আরেকটা ফ্রিকিক থেকেই। গোললাইন বরাবর গিয়ে কাকার সেন্টারে ফিলিপ মেলোর শট আর্জেন্টাইন গোলকিপার মারিয়ানো আন্দুজার দখলে নিতে পারেননি। তাঁর হাত থেকে বল পড়ে যায় মাটিতে। তখনই ধূর্ত, ক্ষিপ্র ফ্যাবিয়ানোর অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ।
আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগ ছিল যাচ্ছেতাই, পুরো দলের সমন্বয়হীনতার মূল প্রতীক। আর এটা দেখেই ব্রাজিল শূন্যে খেলতে চেয়েছে বেশি। তাতে আরও কয়েকটি সেট পিস আদায় করে ব্যবধান বাড়ানোর মতো সুযোগও তারা তৈরি করেছে।
দ্বিতীয়ার্ধে গোল শোধে মরিয়া আর্জেন্টিনা যখন আরও বেশি আক্রমণমুখর, লুসিওরা নিজেদের গুটিয়ে ফেলেছে। আঁটসাট, আর্জেন্টিনাকে কোনো সুযোগ না দিতে এককাট্টা। আর্জেন্টিনা ম্যাচে ফেরার আশা জাগানিয়া গোলটা পায় তখনই। প্রায় মাঝমাঠ থেকে দুর্দান্ত এক ভলিতে গোল করেন জেসাস দাতোলো (১-২)। রোজারিওর গ্যালারিতে নিভে যাওয়া প্রাণচাঞ্চল্য জেগে ওঠে হঠাত্ করেই। তবে সেটি স্তব্ধ করে দিয়েছেন ওই ফ্যাবিয়ানোই। ঘড়ির কাঁটাটা দুই মিনিট পেরিয়েছে কি পেরোয়নি, কাকার দুর্দান্ত এক থ্রু পাস থেকে ফ্যাবিয়ানোর গোলটি ছিল দারুণ। এগিয়ে আসা গোলকিপার আন্দুজারের ওপর দিয়ে বল পাঠিয়ে দিয়েছেন জালে। এ বছর ১০ ম্যাচে এটি তাঁর ১১তম গোল। রোনালদো-আদ্রিয়ানোদের ছায়া থেকে বেরিয়ে ব্রাজিলের মূল স্ট্রাইকার হয়ে উঠেছেন এই সেভিয়া-তারকাই।
ম্যারাডোনার ‘বদলি ঘোড়া’রা একটা কিছু করার চেষ্টা করে গেছেন এর পরও। মিলিতো প্রায় গোল পেয়েই গিয়েছিলেন মেসির পাস থেকে। তবে ব্রাজিলিয়ান গোলকিপার হুলিও সিজার ছিলেন যেন সত্যিকারেরই জুলিয়াস সিজার, ‘রোমান বীরত্বগাথা’র নায়ক। ম্যারাডোনার জামাই আগুয়েরোও ‘দাপাদাপি’ করেছেন বিচ্ছিন্নভাবে। নিজের ওজন অনুযায়ী খেলতে পারেননি, কিন্তু মেসিও ব্রাজিলের নিশ্ছিদ্র রক্ষণের জন্য হুমকি হয়েছিলেন। তবে সবই নিষ্ফলা। একসময় সেই অমোঘ বাঁশি। ব্রাজিলের জয়োত্সব। পাথুরে মুখে ম্যারাডোনার নখ খুঁটতে থাকা।
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ অভিযাত্রা একখণ্ড কালো মেঘেই ঢাকা পড়ল এই পরাজয়ে। তা-ও ভালো, দিনের আরেক ম্যাচে কলম্বিয়ার কাছে ইকুয়েডরের পরাজয় তাদের চতুর্থ স্থান টিকিয়ে আশাটা বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু পথটা কঠিন। হায় ৫ সেপ্টেম্বর! ক্যালেন্ডারে এই তারিখটা কেন যে আসে আর্জেন্টিনার কাছে! ১৬ বছর আগে এই তারিখেই নিজেদের মাঠে কলম্বিয়ার কাছে ৫-০ গোলে হেরে প্লে-অফ খেলতে হয়েছিল ম্যারাডোনার দলকে। ‘আর্জেন্টাইন ঈশ্বর’ তখন ছিলেন খেলোয়াড়। এবার কোচ। আবারও কি প্লে-অফ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য?

No comments

Powered by Blogger.