গ্যাস রপ্তানির ধারাটি সোজা ভাষায় বলবেন কি? by বদরূল ইমাম

গ্যাস রপ্তানির বিষয়টি নিয়ে আবারও আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে। অনেকের মনেই প্রশ্ন, শেখ হাসিনা ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মুখের ওপর গ্যাস রপ্তানির প্রস্তাব ‘না’ করে দিয়েছিলেন। তাঁর আমলেই আবার এ আন্দোলনের প্রয়োজন হচ্ছে কেন? ২০০১ থেকে ২০০৯ সময়ে দেশের গ্যাসচিত্রে আশাপ্রদ মজুদও বাড়েনি, আবার নিজস্ব চাহিদাও কমেনি, বরং গ্যাসসংকট দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। আবার এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারের এ রকম কঠোর দমননীতিই বা কেন? পুলিশ আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের পা ভেঙে দিয়ে এবং অন্যদের জখম করে যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে তাতে সরকার-সমর্থিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে দেখা গেছে।
গ্যাস রপ্তানির বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে বিএনপি আমলের আন্দোলনের পটভূমি ছিল বিদেশি কোম্পানি কর্তৃক পাইপলাইন মারফত সুনির্দিষ্ট গ্যাস রপ্তানির প্রস্তাব। আর আন্দোলনের বর্তমান প্রেক্ষাপট হলো বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে গ্যাস অনুসন্ধান চুক্তি করার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত নীতিমালায় গ্যাসকে তরলীকৃত করে রপ্তানির সুযোগ রাখার কয়েকটি ধারা। এ নীতিমালাসংক্রান্ত নথিটি ‘মডেল পিএসসি ২০০৮’ নামে পরিচিত। পুরো নাম Model Production Sharing Contract 2008। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বিদেশি কোম্পানিগুলো প্রথম থেকে প্রোডাকশন শেয়ারিং চুক্তির অধীনে অনুসন্ধান কাজ করে আসছে। তাই বর্তমান ‘মডেল পিএসসি ২০০৮’ যে কোনো নতুন নথি তা নয়, বরং এটি ইতিপূর্বে প্রণীত নীতিমালা বা মডেল পিএসসির পরিমার্জিত সংস্করণ।
উপরিউক্ত নীতিমালায় বর্ণিত গ্যাস রপ্তানিসংক্রান্ত ধারাগুলো নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পরবিরোধী মতপ্রকাশ করে। আন্দোলনরত বিরোধী পক্ষ বলে, এ নীতমালায় গাস রপ্তানির ধারা সুস্পষ্ট, এতে গ্যাস রপ্তানি অনিবার্য এবং গ্যাস রপ্তানির লক্ষ্য নিয়েই এটি প্রণীত হয়েছে। তাই সরকার এটি বাতিল না করলে আন্দোলন অপরিহার্য। সরকার বা পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। তাদের মতে, গ্যাস রপ্তানির ধারায় প্যাঁচ রাখা হয়েছে, যাতে প্রকৃতপক্ষে তা কখনো বাস্তবায়িত হবে না। দেশের গ্যাসসম্পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে নীতিমালায় ভিন্নতর ব্যাখ্যার অবকাশ কাম্য নয়, বরং এ ব্যাখ্যা হতে হবে একক, সুস্পষ্ট ও বোধগম্য। কেউ কেউ বলতে পারেন, আইনি বিষয়ের ব্যাখ্যা সাধারণের জন্য কখনো বা সরল নাও হতে পারে। কিন্তু দেশের গ্যাসসম্পদ রপ্তানি করব কি করব না এ নীতিমালায় এমন জটিলতা থাকবে কেন, যা জনগণের কাছে সহজবোধ্য হবে না? উপরিউক্ত বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট আলোচনা করতে হলে ‘মডেল পিএসসি ২০০৮’-এ বর্ণিত গ্যাস রপ্তানিসংক্রান্ত ধারাগুলো আলোচনা করা প্রয়োজন। ‘মডেল পিএসসি ২০০৮’-এ রপ্তানিসংক্রান্ত ধারাগুলোয় (Articles) কী বলা আছে? পাঠকের সুবিধার্থে নিচে প্রাসঙ্গিক ধারাগুলো উল্লেখ এবং এ নিয়ে আলোচনা করা হলো।
Articles 15.5.1 : Subject to article 15.5.4, 15.5.5 and 15.6 Contractor shall have the right to export any marketable natural gas produced from the contract area in the form of Liquified natural gas (LNG). ...Where contractor intent to export the natural gas as LNG, the related LNG facilities shall be constructed and operated on the basis of a special LNG export agreement between contractor and Petrobangla. এর মূল অর্থ দাঁড়ায়, ধারা ১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫ এবং ১৫.৬ বিবেচনায় এনে কোম্পানি গ্যাস রপ্তানি করতে পারবে, তবে গ্যাসকে তরলীকরণ অর্থাত্ এলএনজি করে রপ্তানি করতে হবে। এখন দেখা যাক ধারা ১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫ এবং ১৫.৬তে কী উল্লেখ করা হয়েছে।
Article 15.5.4 Where Petrobangla has installed necessary facilities to transport and use gas to meet domestic requirements, Petrobangla shall be entitled at its option to retain in kind any natural gas produced up to Petrobangla’s share of profit gas, but in no event more than 20% of the total marketable natural gas. এর মূল অর্থ দাঁড়ায়, যেখানে পেট্রোবাংলা দেশের চাহিদা মেটাতে গ্যাস পরিবহনের ব্যবস্থা করে নেবে, সে তার অংশের প্রফিট গ্যাস নিতে পারবে, তবে তা কখনো মোট প্রাপ্ত গ্যাসের ২০ শতাংশের এর বেশি হবে না।
Article 15.5.5. Contractor shall not enter into any agreement for LNG export unless the price or the pricing formula and the agreement itself are previously approved by Petrobangla. Such approval shall not be withheld where Contractor can demonstrate that the price received... represent the fair market value... এর মূল অর্থ দাঁড়ায়, কোম্পানি তরলীকৃত গ্যাস রপ্তানির কোনো চুক্তি করবে না, যদি না পেট্রোবাংলা গ্যাসের নির্ধারিত মূল্য ও চুক্তিটি অনুমোদন করে।
Article 15.6. (a) Contractor shall offer its share of cost recovery gas and profit gas to Petrobangla, and Petrobangla shall undertake that it or its affilities will purchase the gas... (b) If a written notice of a market outlet is not given by Petrobangla within six months after the date of submission of the Evaluation report..., the contractor will be free to find a market outlet within Bangladesh... (c) Contractor has the option to sell contractor’s share of natural gas in the domestic market to a third party, subject to Petrobangla’s right of first refusal. মূল অর্থ দাঁড়ায়, কোম্পানি তার অংশের গ্যাস পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রয়ের প্রস্তাব দেবে, পেট্রোবাংলা তা কেনার সম্মতি জানাবে। ছয় মাসের মধ্যে পেট্রোবাংলা ক্রয়-সম্পর্কিত নোটিশ না দিলে কোম্পানি নিজে ক্রেতা খুঁজে নেবে। পেট্রোবাংলার গ্যাস কেনার ব্যাপারে প্রথম অসম্মতি দেওয়ার অধিকার থাকবে এবং কেবল তারপর কোম্পানি অন্যত্র গ্যাস বিক্রি করতে পারবে।
এবার উপরিউক্ত ধারাগুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক। আন্দোলনকারীরা বলছেন, ১৫.৫.১ ধারায় গ্যাস রপ্তানির সুস্পষ্ট অনুমোদন দেওয়া আছে। অপরপক্ষ বলছে, না, ওই ধারাটি বাস্তবায়নের আগে ১৫.৬ ধারাটি বিবেচনায় আনতে হবে আর সেখানেই রয়েছে প্যাঁচ, subject to Petrobangla’s right of first refusal, অর্থাত্ কোম্পানি গ্যাস রপ্তানি তখনই করতে পারবে, যদি পেট্রোবাংলা গ্যাস কিনতে রাজি না হয়। আর বাংলাদেশ কখনো গ্যাস কিনতে অস্বীকার করবে না, যেহেতু গ্যাসের চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই চলবে ও গ্যাসের বিকল্প পর্যাপ্ত কোনো জ্বালানি আসবে না। তদুপরি তরলীকৃত গ্যাস রপ্তানি করতে হলে অতি বড় মজুদ প্রয়োজন হবে এবং তরলীকরণ প্লান্ট তৈরিতে বিশাল বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। তাই কোনো কোম্পানির পক্ষে এককভাবে এ পথ লাভজনক হবে না। আন্দোলনকারীদের মতে, দেশে সমুদ্রবক্ষে কখনো বিরাট গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেলে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু তখন বাংলাদেশ ভবিষ্যতের জন্য বাড়তি গ্যাস সংরক্ষণ করতে পারবে না, কারণ পেট্রোবাংলা গ্যাস না কিনলে তা রপ্তানিযোগ্য।
১৫.৫.৪ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশকে গ্যাস নেওয়ার জন্য নিজস্ব পরিবহনব্যবস্থা অর্থাত্ পাইপলাইন তৈরি করে নিতে হবে। আন্দোলনকারীরা প্রশ্ন করেছেন, যদি গভীর সমুদ্রে অনেক দূরবর্তী স্থানে গ্যাস পাওয়া যায় তাহলে কি বাংলাদেশের পক্ষে গভীর সমুদ্রে অতি ব্যয়বহুল পাইপলাইন তৈরি করা সম্ভব হবে? তার মানে কি এই নয় যে কোম্পানি ওই গ্যাস রপ্তানি করতে পারবে? আর প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের প্রাপ্য গ্যাসের সীমা মোট প্রাপ্ত ২০ শতাংশের বেশি হবে না, তার মানে কী?
আন্দোলনকারীরা বলছেন, মডেল পিএসসি ২০০৮ বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ বজায় রাখতে ও গ্যাস রপ্তানির সুযোগ করে দিতে প্রণয়ন করা হয়েছে। পেট্রোবাংলা বলছে, রপ্তানির লোভ না দেখালে বিদেশি কোম্পানি আকৃষ্ট হবে না, বিশেষ করে সমুদ্রবক্ষে যেখানে বাংলাদেশের পক্ষে নিজস্ব অনুসন্ধান চালানো সম্ভব নয়। অতীতের মডেল পিএসসিগুলোয়ও গ্যাস তরলীকৃত করে রপ্তানির বিধান দেওয়া ছিল, কিন্তু ওই পন্থায় কোনো কোম্পানিই গ্যাস রপ্তানি করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।
‘মডেল পিএসসি ২০০৮ ও গ্যাস রপ্তানি’—এ বিষয়টি নিয়ে তর্কবিতর্ক থেকেই যাবে। নিঃসন্দেহে এর একাধিক ধারা প্রশ্নসাপেক্ষ, কোনো কোনো সরকারি ব্যাখ্যা বিভ্রান্তিমূলক। প্রশ্ন হলো, নীতিমালার ধারাগুলো কি আরও সুস্পষ্টভাবে বিভ্রান্তি এড়িয়ে করা যায় না? বিষয়টি নিয়ে একদিকে যেমন খোলা আলোচনা প্রয়োজন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও এর ধারাগুলোর পরিমার্জনা বিবেচনাযোগ্য। আন্দোলনের কারণে গ্যাস অনুসন্ধান বিলম্বিত হোক তা কারও কাম্য নয়। কিন্তু চুক্তি যদি দেশের স্বার্থের চেয়ে বিদেশি স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, তা কেবল অমঙ্গল ডেকে আনবে। সরকারের উচিত হবে মডেল চুক্তিকে জনগণের কাছে যথার্থ ব্যাখ্যা করা ও জনগণকে আস্থায় এনে তা প্রণয়ণ করা। নিশ্চয়ই তা পুলিশ দিয়ে লাঠিপেটা করে অধ্যাপকের পা ভাঙার চেয়ে উত্তম পন্থা।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, রেজাইনা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।

No comments

Powered by Blogger.