মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর: বঙ্গবন্ধু পরিষদের পদধারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় by শুভ্র দেব

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) বঙ্গবন্ধু পরিষদের পদধারী কর্মকর্তারা আছেন বহাল তবিয়তে। শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের কাছে এখনো অসহায় ১৫ বছর ধরে সুবিধাবঞ্চিত কর্মকর্তারা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এসব কর্মকর্তার ইশারায় চলছে ডিএনসি’র সমস্ত কার্যক্রম। নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে বদলি, নিয়োগ, টেন্ডার, মাদকের স্পট থেকে মাসোহারা তোলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছেন তারা। অধিদপ্তরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন, পদোন্নতি, বদলিতে সংগঠনের নেতাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। বেপরোয়া কর্মকর্তারা বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে দলীয় দাপট দেখিয়ে পুরো অধিদপ্তরকে কব্জা করে রেখেছেন। সাবেক সুরক্ষা সচিব, অধিদপ্তরের মহাপরিচালকদের ম্যানেজ করে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। গড়েছেন অবৈধ সম্পদ। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে তাদের অনৈতিক অনেক কর্মকাণ্ডের সংবাদ প্রচার হয়েছে। কিন্তু লোক দেখানো বিভাগীয় মামলা করে সিন্ডিকেটের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারি সকল অফিসে সংস্কার হচ্ছে। দুর্নীতিবাজ, প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের অপসারণ করা হয়েছে। তাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীও এখন সংস্কারের জন্য সোচ্চার। তারা চাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন নেতাকর্মীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেসব কর্মকর্তারা প্রভাব বিস্তার করছিলেন তাদের সরিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সুবিধাবঞ্চিতদের সেসব পদে যাতে পদায়ন করা হয়। শিগগিরই সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ ছাড়া এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয়েছে।

ডিএনসি সূত্র বলছে, যেসব এলাকায় মাদকসেবী, মাদক কারবারি, মদের বার বেশি- সেসব এলাকায় মাদকের কর্মকর্তাদের অবৈধ আয় বেশি হয়। তাই ওই এলাকায় পোস্টিং পাওয়াকে অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ ভাষায় ‘প্রাইস পোস্টিং’ বলা হয়। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছত্রছায়ায় বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতারা দিনে দিনে হয়ে উঠছিলেন আরও বেপরোয়া। এ ছাড়াও অধিদপ্তরে নিয়োগ দেয়া হতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো তালিকা অনুযায়ী। এ ছাড়াও কর্মকর্তারা তাদের অবৈধ আয় থেকেও নিয়মিত মাসোহারা দিতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। ভাগবাটোয়ারা এবং ফায়দা নিতে অধিদপ্তরের পাল্টাপাল্টি দুটি কমিটি গঠন করেছে চক্রটি।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটে যারা রয়েছেন  তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু পরিষদের একটি কমিটির সভাপতি প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি ও উপ-পরিচালক (ঢাকা উত্তর) আবুল হোসেন, সহ-সভাপতি ও উপ-পরিচালক মো. রবিউল ইসলাম, দপ্তর সম্পাদক ও সহকারী পরিচালক রাহুল সেন, প্রচার সম্পাদক ও সহকারী পরিচালক শিরিন আক্তার রয়েছেন। এ ছাড়াও চক্রে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের অপর কমিটির সভাপতি ও উপ-পরিচালক (ঢাকা-গোয়েন্দা) রবিউল ইসলাম, একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপ-পরিচালক হামিমুর রশিদসহ আরও অনেকে।

ডিএনসি সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ও প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক বিভাগীয় মামলা। যার মধ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে পুলিশের অভিযানে ৫ কেজি হেরোইন জব্দ করা হয়। রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য সেটি ডিএনসি ল্যাবে পাঠানো হয়। কিন্তু আসামি পক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে দুলাল ভুল প্রতিবেদন দেন। ধরা পড়ার পরে  দেশ জুড়ে আলোচিত এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। এ ছাড়াও ৮ মাস আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে যৌথ অভিযানে একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে দুই কোটি টাকার হেরোইন উদ্ধার করা হয়। এরপর সেই হেরোইন ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হলে সেখানে অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন দিয়েছেন ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা। প্রতিবেদনে সরাসরি মাদক না লিখে তিনি লিখেছেন, ‘মাদকসদৃশ বস্তু পাওয়া গেছে।’ এভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাদকের বড় চালানে ভুল ও অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতানোর অভিযোগ রয়েছে দুলাল কৃষ্ণ সাহার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে ২টি বিভাগীয় মামলা চলছে। আরও দুটি মামলায় তাকে তিরস্কার দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ভুয়া কোর্ট সার্টিফিকেট দিয়ে টিএডিএ বিল নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে রাসায়নিক পরীক্ষার টাকার বিনিময়ে ভুল রিপোর্ট ও নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য করে টাকা আয়ের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সব অভিযোগই মিথ্যা। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে এসব করছে। বিভিন্ন সময়ের বিভাগীয় মামলার বিষয়ে বলেন, চাকরি করতে গেলে অনেক কিছুই থাকতে হবে।
বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি ও ঢাকা মেট্রো উত্তরের উপ-পরিচালক আবুল হোসেন ছাত্র জীবনে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা।

প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতার নিজ এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় তার সঙ্গে রয়েছে গভীর সখ্যতা। মেধা ও তালিকায় পেছনে থেকেও সুপারিশে এই আবুল হোসেন উপ-পরিচালক থেকে খুলনা বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালকের পদ বাগিয়ে নেন। এ নিয়ে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরে আদালতে রিট দায়ের হলে তাকে পুনরায় আদালতের নির্দেশে ডিডি পদে পদায়ন করা হয়। বর্তমানে তিনি আছেন অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদ ঢাকা মেট্রো উত্তরের উপ-পরিচালক পদে। ঢাকা উত্তরের অধীনে মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরে রয়েছে একাধিক বিহারি ক্যাম্প। এসব ক্যাম্প থেকে আবুল হোসেনকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে চলে মাদক কারবার। রাজধানীর এসব ক্যাম্পে দিনে কোটি কোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়। রাজধানীর কয়েকটি ক্যাম্পে প্রকাশ্যে সিরিয়াল দিয়ে মাদক বিক্রির অন্তত ডজনখানেক ভিডিও রয়েছে। এই আবুল হোসেন অধিদপ্তরের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গেও অশোভন আচরণ করেন বলেও অভিযোগ আছে। তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা কামানোর অভিযোগ রয়েছে। গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরে আবুল হোসেন সাবেক ডিজি মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকীকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি নেন। অধিদপ্তরের নথিপত্রে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ রেকর্ড আছে। অভিযোগের বিষয়ে আবুল হোসেন বলেন, সভাপতি-সেক্রেটারি সংগঠনে আমার নাম দিয়েছেন। খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালকের পদ নিয়ে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ আমাকে দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি ও উপ-পরিচালক (ঢাকা গোয়েন্দা) মো. রবিউল ইসলাম চাকরি জীবনের বেশির ভাগ সময়েই কাটিয়েছেন রাজধানীতে। এই কর্মকর্তা সবচেয়ে বেপরোয়া ছিলেন অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি মোহাম্মদ আতোয়ার রহমানের সময়। রবিউল তখন ঢাকা মেট্রো উত্তরে ডিডি ছিলেন। দু’জন একই এলাকার হওয়ার সুবাদে এই কর্মকর্তা তখন ডিজির প্রভাব খাটিয়ে পোস্টিং বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। এই কর্মকর্তা তখন প্রধান কার্যালয়ে গেলে সবাই আতঙ্কে থাকতেন। যেদিন তিনি সদরদপ্তরে যেতেন সেদিনই কোনো না কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করিয়ে দেয়া হতো। এখন তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের নাম ভাঙিয়ে একই কায়দায় বদলি বাণিজ্য করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আছে।
এ ছাড়াও অপর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপ-পরিচালক মো. হামিমুর রশীদ তার চাকরি জীবনের প্রায় ৯ বছর কাটিয়েছেন সদর দপ্তরে। এ ছাড়াও প্রাইস পোস্টিং পেয়ে মানিকগঞ্জে ১ বছর ও সম্প্রতি বদলি হয়ে পটুয়াখালীতে আছেন। বঙ্গবন্ধু পরিষদের দুই কমিটির একটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক ও অন্য কমিটিতে সদস্য হিসেবে সহকারী পরিচালক তুষার কুমার ব্যানার্জি। তিনি এখন ঢাকা বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাকরি করছেন। চাকরি জীবনে তিনিও বেপরোয়া। গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং নিয়ে পকেট ভারী করছেন। তার বিরুদ্ধে ২টা মামলা চলমান রয়েছে। এর আগে তিনি মামলার তদন্তে তিরস্কৃত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে এই সিন্ডিকেটে জড়িত বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও সহকারী পরিচালক (স্টাফ অফিসার টু ডিজি) শাহীন মাহমুদ। ছাত্রজীবনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। বর্তমানে ডিজিসহ আরও বেশ কয়েকজন ডিজির স্টাফ অফিসার হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। সাবেক ডিজি মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী তার মাধ্যমে সমস্ত কাজকর্ম করাতেন। ডিজিদের আস্থাভাজন হওয়াতে তিনি কাউকে তোয়াক্কা করেন না। বড় বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গেও অনেক সময় খারাপ আচরণ করার অভিযোগ আছে। বঙ্গবন্ধু পরিষদের আরও অনেক নেতাই দাপট দেখিয়ে চলেন। অন্যান্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু অজানা কারণে তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়, ডিজিরা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমি অধিদপ্তরে আসার এখনো তিন মাস হয়নি। এরমধ্যে আমি সংগঠনটির কোনো কর্মতৎপরতা দেখি নাই। এ ছাড়া প্রভাব বিস্তার করে বদলিরও কোনো কিছু দেখি নাই। আমার ওপর কেউ প্রভাব বিস্তার করে নাই। তিনি বলেন, আমি যোগদানের পর তিনজন ছাড়া তেমন কোনো বদলি হয়নি। তবে যাদের কথা বলেছেন তাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো তথ্য পাই অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।

No comments

Powered by Blogger.