এবার হত্যা মামলার আসামি: ক্রিকেটে সাকিবের ভবিষ্যৎ কোথায়? by সৌরভ কুমার দাস

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোয় পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর গত এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশজুড়ে চলা গণ হত্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। আদাবর থানায় এমনই একটি মামলায় জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নাম এসেছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, এই মামলার পর ক্রিকেটে সাকিবের ভবিষ্যৎ কী হবে।

গত কয়েক বছর ধরেই মাঠের বাইরে বেপরোয়া সাকিব বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিলেন। যখন ইচ্ছা ছুটি নিয়েছেন, যখন ইচ্ছা খেলেছেন। নির্বাচকরাও জানতেন না সাকিব কোন সিরিজে খেলবেন আর কোন সিরিজে খেলবেন না। সাকিব নাকি সরাসরি ডিল করতেন তৎকালীন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হোসেন পাপনের সঙ্গে। সরকার পতনের পর লাপাত্তা পাপন পদত্যাগ করেছেন, বিসিবির নতুন সভাপতি হয়েছেন ফারুক আহমেদ। প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই সাকিবের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন তিনি।

তবে এতদিন মাঠের বাইরে সবকিছুই সাকিব সামলে নিয়েছেন। মাঠে ভালো খেলেছেন, ভক্তরা ছিল পাশে। কিন্তু সর্বশেষ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাকিবের ভক্তরাই তাকে ধুয়ে দিয়েছেন। ছাত্রদের পক্ষে সাকিব কিছু বলেননি, সেটা শাসক দলের সংসদ সদস্য হিসেবে বলতে পারবেন না এই যুক্তি দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কানাডার গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি লীগে এক দর্শককে প্রশ্ন করে বসেন ‘দেশের জন্য কী করেছেন?’ এতে যেন আরও ক্ষেপে ওঠে শিক্ষার্থীরা। এমনকি দেশে যখন প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে তখন সামাজিকমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়ানোর ছবি ছবি আপলোড করেন সাকিব। সবমিলিয়ে সবদিক থেকেই সমর্থন আসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল সাকিবের। তবে এর মধ্যে সবাইকে কিছুটা অবাক করে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের প্রথম অনুশীলনেই যোগ দেন তিনি। যদিও সচরাচর দেখা যায় টেস্ট খেলতে চান না সাকিব। বোঝাই যাচ্ছে গত নির্বাচনে মাগুরা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া সাকিব এই পদ হারিয়ে এখন ইমেজ উদ্ধারে নেমেছেন।
তবে এবার সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলেন সাকিব আল হাসান। দেশজুড়ে আওয়ামীলীগের এমপিদের নামে মামলা হওয়ার তালিকায় তার নামও যোগ হলো। ৫ই আগস্ট সকালে রাজধানীর আদাবরে অবস্থিত রিংরোডে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান গার্মেন্টস কর্মী মো. রুবেল। হত্যার অভিযোগে নিহতের বাবা রফিকুল ইসলাম বাদি হয়ে আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় আসামির তালিকায় ২৮ নম্বরে আছেন আওয়ামী লীগের মাগুরা-১ আসনের সাবেক এমপি সাকিব আল হাসান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মামলার ১ নম্বর আসামি। এছাড়া সবমিলিয়ে আসামি করা হয়েছে ১৫৩ জনকে।  

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ওইদিন মিছিলে পুলিশের দু’টি বুলেটের মধ্যে একটি বুকে ও আরেকটি পেটের বাম পাশে এসে লাগে রুবেলের। এরপর গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল  হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। সেখান থেকে পাঠানো হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। জরুরি অবস্থায় সোহরাওয়ার্দীতে রুবেলের সার্জারি হলেও আইসিইউ স্বল্পতায় তাকে ভর্তি করানো হয় কেয়ার জেনারেল হাসপাতালে। এ হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রুবেল। দেশে যার নামে খুনে ইন্ধন দেওয়ার মামলা হলো তিনি পাকিস্তানে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন ক্রিকেটে। চলমান প্রথম টেস্টে বল হাতে একটি উইকেটও নিয়েছেন। বরাবরই বলা হয়, সাকিবকে মাঠের বাইরে কোনো কিছু স্পর্শ করতে পারে না। তবে সেই দিন বোধহয় আর নেই। আগে ধারাবাহিক পারফর্মেন্সই ছিল তার শক্তি, সেটাও অনেকদিন ধরেই সঙ্গ দিচ্ছে না। বিসিবি সভাপতি হিসেবে প্রথম দিন সংবাদ সম্মেলনে ফারুক আহমেদ বলেছিলেন, বাইরে থেকে সাকিব খেলতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা করবেন তারা। এই মামলা হওয়ার পর সাকিব দেশে আদৌ ফিরবেন কিনা সেটা নিয়েও এবার প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। আর যদি দেশে ফেরেন, এই মামলায় সাকিবকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে জাতীয় দলে সাকিবের ভবিষ্যৎ কী হবে! যদিও মামলা থাকলেই যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারবেন না এমন নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটেই এর অনেক উদাহরণ আছে। ২০১৫ সালে ধর্ষণ মামলায় আদালত থেকে জামিন নিয়ে বিশ্বকাপ খেলেছিলেন রুবেল হোসেন।

তবে আইনি জটিলতা পাশে রেখে বিসিবি সাকিবের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিবে। পারফর্মেন্সের অজুহাতে তারাও কি সাকিবের ব্যাপারে নরম থাকবে এটাই আলোচনার বিষয়। সাকিবের ব্যাপারে জানতে দৈনিক মানবজমিনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বিসিবি ক্রিকেট অপরারেশন্সের ম্যানেজার শাহরিয়ার নাফিসের সঙ্গে। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হননি বলে উত্তর দিতে চাইলেন না তিনি।
দৈনিক মানবজমিনকে নাফিস বলেন, ‘আমি আসলে বোর্ডে আসার পর এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইনি। ফলে বোর্ড এই বিষয়গুলো কিভাবে ডিল করে সেটা জানতে হবে। আর এ ব্যাপারে বলতে পারবেন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী।’

এরপর প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। মোবাইল নম্বরে কল করা হলে সংযোগ করা সম্ভব হয়নি। এরপর হোয়াটসঅ্যাপে দুইবার কল দেওয়া হলেও রিসিভ করেননি প্রধান নির্বাহী। আর নির্বাচক প্যানেলের চেয়ারম্যান গাজী আশরাফ হোসেন লিপু পাকিস্তান থাকায় তার সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ফলে সাকিবের ব্যাপারে এই মুহূর্তে বোর্ডের অবস্থান জানা যায়নি। তবে ফর্ম, সাম্প্রতিক সব অবস্থা মিলিয়ে মাঠের ক্রিকেটে সাকিবের ভবিষ্যৎ ভালো কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.