নতুন বাংলাদেশ গঠনে সিরাজুলের ভীষণ প্রয়োজন ছিল -শোকসভায় বক্তারা
গত ১১ই আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত। তার স্মরণে গতকাল এম সিরাজুল ইসলামের পরিবার ও দ্য ঢাকা ফোরাম (টিডিএফ) শোকসভার আয়োজন করে। রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইন’-এ আয়োজিত সভায় তার বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে আলোচনা হয়। শুরুতে এম সিরাজুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন ও মোনাজাত করা হয়।
আলোচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বক্তব্যের শুরুতে আন্দোলনে শহীদ ছাত্র-জনতার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। তিনি বলেন, সবুজ (এম সিরাজুল ইসলাম) বলেছিলেন এই সরকার (আওয়ামী লীগ) বেশিদিন থাকবে না। এখন সেই সরকার নেই। এই সময়টায় সবুজ থাকলে অনেক বেশি খুশি হতেন।
এ সময় তিনি এম সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে নানা সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করেন। এরপর তিনি বলেন, তিনি ছিলেন পজেটিভ। নট রি-অ্যাকটিভ। আর রি-অ্যাক্ট করতেন থিওরিটিক্যালি। সবুজ ছিলেন স্পষ্ট কথা বলার মানুষ। আমিও বলি বি-পজেটিভ। রি-অ্যাক্টিভ হবেন না। আমি যদি বলি আমরা সব করে ফেলবো। ১০টা কথা বললে দু’টা কথা তো সত্যি হবে। কিন্তু আমরা দেশের স্বার্থে মানুষের স্বার্থে কাজ করে যাবো।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সবুজ ছিলেন অসাধারণ দেশপ্রেমিক একজন মানুষ। শুধু তাই নয়, তিনি ভালো- পিতা, স্বামী, বন্ধু। সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন মেধাবী, বুদ্ধিমান এবং স্পষ্টবাদী। এই ধরনের মানুষ সব সময় আসে না। আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছাত্রজীবন থেকে, ১৯৬৫ সাল থেকে। তার সঙ্গে মত সব সময় এক ছিল তা- না। তবে মানুষ ছিল একদম খাঁটি। আন্দোলনের সময় বহুবার তার বাসায় গিয়েছি। আলোচনা করেছি। আমীর খসরুসহ আমরা জেলে গিয়েছিলাম। তখন বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। সবুজ অনেক ঝুঁকি নিয়ে এই দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের অনেক আশা ছিল যখন এই দেশ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন হবে আমরা সবুজকে বিশেষ কাজে লাগাতে পারবো।
তিনি বলেন, এই দু’মাসেই যে মানুষ শহীদ হয়েছেন তা নয়। গত ১৫ বছর ধরেই অসংখ্য মানুষ শহীদ হয়েছেন। ভয়াবহ ফ্যাসিস্টের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য তারা প্রাণ দিয়েছেন। সবুজ লড়াই করেছেন তার লেখনীর মধ্য দিয়ে, কথার মধ্য দিয়ে। নামের মতোই সবুজ ছিল। ছিল প্রাণবন্ত। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। দেশ হারিয়েছে অত্যন্ত দেশপ্রেমিক একজন কূটনীতিককে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাবেক এই কূটনীতিকের সঙ্গে নানা স্মৃতি রোমন্থন করেন। এ সময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বলেন, সবুজ ভাইয়ের বক্তব্য স্টেট ফরোয়ার্ড। যেকোনো অনুষ্ঠানে তার বক্তব্য শ্রোতারা এত গুণমুগ্ধ হয়ে শুনতেন যে, তারপর আর বক্তব্য দিতে সমস্যা হতো। এই মানুষটা কোনোদিন রাজনীতি করেননি। তবুও ছিলেন সাবলীল। তিনি দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আর্টিকেল লিখতেন। তার বক্তব্য, লেখনী বিরোধী দলের রাজনীতিকে বস্তুনিষ্ঠ অবস্থায় নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, বর্তমান এই প্রেক্ষাপটে উনাকে দরকার ছিল। উনাকে আমরা মিস করবো, সম্মান করবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল্লাহ বলেন, বেশির ভাগ কূটনীতিক আত্মরক্ষায় নিয়োজিত থাকেন। তিনি সাধারণের মধ্যে ছিলেন অসাধারণ। বাংলাদেশের বুকের ওপর যে জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল। তখনও তিনি আশার সঞ্চার দেখিয়েছেন। সঠিক সময় সঠিক কথা বলার অপূর্ব ক্ষমতা ছিল তার। তিনি ছিলেন কথার শিল্পী। কূটনীতিকরা অনেকেই টাইয়ের নট কিংবা কাটা চামচ কই রাখবেন তা নিয়ে চিন্তা করেন। মানুষের কথা চিন্তা করেন না। সবুজ ছিলেন তার ব্যতিক্রম।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, সবুজ হয়ে উঠেছিলেন ন্যায় নিষ্ঠার প্রতীক। সবুজ একাকীও উজ্জ্বল ছিলেন। অবসরের পর তুলে নিলেন কলম। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অনবরত কাজ করে গেছেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সবুজের যে কন্ট্রিবিউশন তা যেন আমরা ভুলে না যাই। অনেকে আমাকে বলেন- যুদ্ধ যে করলেন পেলেন কি? আমি বললাম কী আবার পাবো মুক্ত বাতাস পেয়েছি। সবুজের কিছু পাওয়ার আশা ছিল না।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, তার সঙ্গে আমার সবশেষ কথা হয়েছিল সেদিন আমরা ভবিষ্যৎ ফরেন পলিসি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, দেশে ফিরে আমরা সিরিয়াস ফরেন পলিসি নিয়ে কাজ করবো। কিন্তু আমরা একজন গুণী মানুষকে হারিয়েছি। আমরা দেশের জন্য তার অবদান আজীবন স্মরণে রাখবো।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে তার পরিচিতজনরা বক্তব্য রাখেন। তারা সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলামের গুণের প্রশংসাসহ দেশ গঠনে তার অবদানের কথা তুলে ধরেন। সভায় বিএনপি’র অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, মিজানুর রহমান মিনু, আবদুল হালিম, আবদুল কাইয়ূম, নজমুল হক নান্নু, সুজা উদ্দিন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, নূর মোহাম্মদ খান, জহির উদ্দিন স্বপন, শামা ওবায়েদ, সাবেক কূটনীতিক ইফতেখার করীম, শাহেদ আখতারসহ অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে মরহুমের সহধর্মিণী নাসরিন ফৌজিয়া, দুই কন্যা মৌসুমী ইসলাম সাবরিনা ও নওরিনসহ মরহুমের স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম গত ১১ই আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। সিরাজুল ইসলামের কর্মজীবন শুরু হয় তৎকালীন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস থেকে। তিনি ক্যানবেরা, নয়া দিল্লি, ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ে বাংলাদেশ মিশনে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া তিনি মিশর (১৯৯৯-২০০২) ও জাপানেও (২০০২-২০০৬) রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দক্ষিণ এশিয়া ও দূরপ্রাচ্যের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেয়ার আগে তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান ডিগ্রি নেন। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর সেখানেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন।
১৯৭৫-৭৬ সালে তিনি কানাডার ব্রক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ছাত্রজীবনে তিনি খেলাধুলার সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ বিভাগের হয়ে ক্রিকেটও খেলেছেন। এছাড়া ১৯৬৮-৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেনিস দলের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে তাকে টেনিসে ব্লু পুরস্কার দেয়া হয়। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম হলিডে, দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ডেইলি সান ও ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসে কলাম লিখতেন।
No comments