কোটা বিরোধী আন্দোলন: ব্যারিকেডে বিদ্যুৎ! পা হারিয়ে নির্বাক সাগর by ফাহিমা আক্তার সুমি

বাইশ বছর বয়সী সাগর ইসলাম। ঠাকুরগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে। গত ৪ঠা আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ঠাকুরগাঁও  জজ কোর্টের মোড়ে সাগরের জীবনে নেমে আসে এক বিভীষিকা।

রাস্তায় থাকা পুলিশের ব্যারিকেডে দেয়া ছিল বিদ্যুৎ সংযোগ। আর সেই ব্যারিকেডে হাত লেগে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আহত হন। জীবন নিয়ে বেঁচে ফিরলেও পুড়ে যায় সাগরের হাত-পা। কেটে ফেলতে হয় তার পা। সাগরের বাবা খাদেমুল ইসলাম কৃষিকাজ করেন। মা শেফালী বেগম সংসার সামলানোর পাশাপাশি কৃষিকাজে সহযোগিতা করেন। সাগরের গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের সালন্দ গ্রামে। ঘটনার দিন তাকে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। পরে সেখান থেকে আনা হয় ঢাকায়। বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন তিনি। পা হারিয়ে সাগরের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার।

বার্ন ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, ৭০১ নম্বর রুমের ৫ নম্বর বেডে ভর্তি সাগর। চোখেমুখে হতাশার ছাপ। সাগর মানবজমিনকে বলেন, আমার তো সব শেষ। ছোটবেলা থেকেই আমি খেলাধূলা প্রিয় মানুষ। এখন দিন-রাত শুয়ে থাকতে হচ্ছে। ব্যথায় ঘুমাতে পারি না। বাবা-মা পরিবারকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। বাবা অনেক কষ্ট করে খেটে আমাকে পড়িয়েছেন। আমার ইয়ার লস হয়ে যাবে খুব চিন্তায় আছি। এই সেমিস্টার শেষ হলে ইন্টার্ন করতে পারবো। ২০২০ সালে এসএসসি পাস করি। বর্তমানে ঠাকুরগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আরএসই সাবজেক্টে পড়াশোনা করি। পড়া শেষ দিকে চলে আসায় বাবা-মাকে সুখের দিন দেখানোর জন্য আমিও ব্যস্ত ছিলাম। বাবা-মা আমাকে যেমন করে মানুষ করেছে তেমন করে আমিও তাদের আগলে রাখতে চেয়েছিলাম, দূর করতে চেয়েছিলাম তাদের কষ্ট। তবে আমি ভেঙে পড়ছি না, হয়তো আমার চলতে কষ্ট হবে তারপরও বাবা-মায়ের জন্য আমি কিছু করতে চাই।

তিনি বলেন, গত ৪ঠা আগস্ট আন্দোলনে গিয়ে দুপুর ১২টার দিকে রাস্তায় থাকা পুলিশের ব্যারিকেডে হাত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে একটা শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত ও দুই পা পুড়ে যায়। আমার ডান পায়ের পাতা অর্ধেক কাটা পড়ছে। আরেক পায়ের দুইটা আঙ্গুলসহ মাংস কেটেছে। বাম হাত পুড়ে গভীর ক্ষত হয়ে যায়। আমার সামনে এই ঘটনায় দুইজন স্পট ডেড হয়। এমন অবস্থা দেখে ঘটনাস্থল থেকে শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। যখন ব্যারিকেডে হাত দেই তখন আমি এমন বিকট শব্দ ও শরীরের অবস্থা দেখে অজ্ঞান হয়ে নিচে পড়ে যাই। কিছুটা জ্ঞান ফিরে এলে ওই অবস্থায় রাস্তায় হামাগুড়ি দিচ্ছিলাম। পড়ে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা যখন আমাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যায় তখন পুরোপুরি জ্ঞান আসে। ঠাকুরগাঁও জেলা জজ কোর্টের সামনে ঘটনাটি ঘটে। তার পাশেই ছিল আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস।

সাগরের বড় ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে আমি বড়। অভাবের কারণে আমি মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর করতে পারিনি। চেয়েছিলাম ভাইকে পড়াশোনা করিয়ে অনেকদূর নিয়ে যাবো, ও অনেক ভালো চাকরি করবে। বাবাকে সহযোগিতা করতে আমি একটি ডিমের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করি। আন্দোলনের সময় সাগর সবসময় আমাকে দোকানে যেতে নিষেধ করতো। ও আমাকে বাধা দিয়ে নিজেই এখন সবকিছু হারিয়েছে। আমার ভাইয়ের এই অবস্থা হওয়ায় বাবা-মায়ের মন ভেঙে পড়েছে। সাগরকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। এখন জানি না জীবন কোনদিকে যাবে। বাবা কৃষিকাজ করে আবার মাঝে মাঝে মানুষের বাসায় কাজ করে। মা সংসার সামলানোর পাশাপাশি বাবাকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করেন। বাড়িতে একটা গরু ছিল সেটি ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করে ওর চিকিৎসা করানো হয়। প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। কোনো টাকা জমানো ছিল না যে সেটি দিয়ে ওর চিকিৎসা করাবো। বারো তারিখে ভাইকে নিয়ে এই হাসপাতালে নিয়ে আসি। আঠারো তারিখে ওর অপারেশন হয় এরপর থেকে এখানে চিকিৎসা খরচ ফ্রি করে দিয়েছে।

চাচাতো ভাই মোস্তফা কামাল বলেন, আমাদের আন্দোলনে সকাল এগারোটার দিকে যাওয়ার কথা ছিল। ঠাকুরগাঁও সদরে একটা বড় মাঠ আছে সেখানে সবাই একত্রিত হয়েছি। যত স্কুল-কলেজ ছিল সবাই এসেছিল। প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী ছিল বড় মাঠে। আমরা মাঠ থেকে বের হয়ে একটা পার্কের ভেতর থেকে জেলা শহরের দিকে যাই। রাস্তায় ফুটপাথে এসএসএফ পাইপ দিয়ে ঘেরাও দেয়া ছিল। সেই এসএসএফ পাইপের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল পুলিশের ব্যাড়িকেড। তাতে দেয়া ছিল বিদ্যুতের সংযোগ। বাইরে থেকে বোঝার এবং জানার কোনো উপায় ছিল না। সাগরসহ কয়েকজন পুলিশের ব্যারিকেডে হাত দিয়ে পার হতে যাচ্ছিল। হাত দেয়ার পরে একটা শব্দ হয়। আমরা কয়েকজন পিছনে ছিলাম মনে করেছি পুলিশ গুলি করেছে। পরে দেখি আমাদের থেকে বেশকিছু দূরে পুলিশের অবস্থান। প্রথমে যে হাত দিয়েছে সে ছিটকে নিচে পড়ে যায়, তার তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তখনো আমরা কেউ কিছু বুঝতে পারিনি কেন সে নিচে পড়ে গিয়েছে। পরে সাগরসহ আরও ৪ জন ব্যারিকেড ও এসএসএফ পাইপে হাত দিয়ে সামনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে সঙ্গে সঙ্গে ব্লাস্ট হয়। পাইপের বা ব্যারিকেডের কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু মানুষের শরীর পুড়েছে। স্পটেই দুজন মারা যায়। আরও দুইজনকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার ভাইকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সাগরের পায়ে যে জুতা পরা ছিল সেই জুতা পুড়ে পায়ের সঙ্গে  লেগে যায়। ওর ডান পায়ের অর্ধেক পুড়ে শেষ, আঙ্গুলগুলো নেই। আরেক পা ও হাতের অবস্থা খারাপ। চার তারিখও আওয়ামী লীগের লোকজন খুব হামলা ও হুমকি দেয় আমাদের। সাগরকে প্রথম দুই-তিনদিন ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারিনি ওদের ভয়ের কারণে। সরকার পতনের দিন সন্ধ্যা থেকে তাকে হাসপাতালে ঠিকমতো দেখাশোনা করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.